কলকাতায় টেলিভিশন আসছে আর ওই রাধা ফিল্ম স্টুডিওই হবে তার ঠিকানা। আমার প্রথমেই মনে হল, ওরে বাবা! অতখানি জায়গা আছে ওর ভেতরে! কারণ তার আগে আমি তো দেখে এসেছি দিল্লির টেলিভিশন সেন্টার। সেটা ১৯৬৮। আমরা শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘের দল দিল্লি গেলাম রবীন্দ্র রঙ্গশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তখনই দিল্লি টেলিভিশনে ছোট একটা নাচের অনুষ্ঠান করেছিলাম। ওখানেই আমার প্রথম টেলিভিশন মেকআপ, যা পরবর্তীকালে নিত্যদিন করতে হত। শুরু হল নতুন কলাম ‘কেয়ার অফ দূরদর্শন’। আজ প্রথম পর্ব।
১.
আমাদের গল্ফ ক্লাবের বাড়ি থেকে হাঁটা পথ রাধা ফিল্ম স্টুডিও। জঙ্গলে ঘেরা রহস্যাবৃত ওই জায়গাটা কেন জানি না আমায় টানত।
কলেজ শুরুর দিনগুলিতে আমাকে রাসবিহারী ঘুরে দোতলা ৯ নম্বর বাস ধরতে হত। কিছুদিনের মধ্যেই চালু হল ৩৭ নম্বর বাস, আরও পরে ১ এ আনোয়ার শাহ রোড থেকে। যাতায়াতের সুবিধে হল। আরও সুবিধে হল, ওই স্টুডিওর সামনে দিয়ে দু’বেলা যাওয়া আসা করার, ফেরার পথে একবার দাঁড়াতাম ওর সামনে। মনে আছে একটা কদম গাছ ছিল গেটের ঠিক বাইরে। একদিন বিকেলে বেণি দুলিয়ে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে ফিরছি, দেখি গেট খোলা! পা আটকে গেল, কৌতূহল বাড়ল, ধীরে ধীরে এগোই, বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ, ভুতুড়ে কোনও বাড়িতে প্রবেশ করছি যেন, একটু এগোতেই বুঝতে পারি সাফাইয়ের কাজ চলছে।
ক’দিন পরেই অবাক হওয়ার মতো এক খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে আর ওই রাধা ফিল্ম স্টুডিওই হবে তার ঠিকানা। আমার প্রথমেই মনে হল, ওরে বাবা! অতখানি জায়গা আছে ওর ভেতরে! কারণ তার আগে আমি তো দেখে এসেছি দিল্লির টেলিভিশন সেন্টার। সেটা ১৯৬৮। আমরা শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘের দল দিল্লি গেলাম রবীন্দ্র রঙ্গশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তখনই দিল্লি টেলিভিশনে ছোট একটা নাচের অনুষ্ঠান করেছিলাম। ওখানেই আমার প্রথম টেলিভিশন মেকআপ, যা পরবর্তীকালে নিত্যদিন করতে হত।
যে কথা বলছিলাম, ভেতরে যে অত বড় জায়গা সত্যিই নেই সে বুঝলাম আরও পরে যখন কাজের সূত্রে ওখানে গেলাম।
একদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের করিডরে দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলোক এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন, বললেন, তাঁর নাম পঙ্কজ সাহা, আরও বললেন যে তাঁরা ‘ট্যালেন্ট হান্ট’-এ বেরিয়েছেন, টেলিভিশনের জন্য। আমি আমার নাম, ধাম, কী করি, সবই বললাম। দু’দিন পর শর্মিষ্ঠাদির টেলিফোন, শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্তকে ছেলেবেলা থেকে চিনি একসঙ্গে নাচের সূত্রে, প্রথমে সুরঙ্গমায় ও পরে আশ্রমিক সঙ্ঘে। ফোনে যা বললেন তার সারমর্ম হল এই যে, সেদিন পঙ্কজদা আমাকে দেখে মনে করেছেন যে আমি টেলিভিশনে কাজের জন্য উপযোগী, চেহারা ও কথা বলায়, শর্মিষ্ঠাদি আমাকে চেনেন বলায় যোগাযোগের আরও সুবিধে হয়েছে। আমাকে দেখা করতে বলেছেন ওঁদের অফিসে।
নির্দিষ্ট দিনে লাল জরিপাড় মেরুন রঙের টাঙ্গাইল শাড়িতে সেজে আমি পা রাখি আমার এতদিনের সেই রহস্যে ঘেরা স্থানটিতে। গেট দিয়ে ঢুকতেই বাঁদিকে ক্যান্টিন। ঘন জঙ্গলের বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই, বরং একটা কাঠচাঁপা গাছ তার ডালপালা বিস্তৃত করে ফুল ফুটিয়েছে অনেক, যার বেশ খানিক পড়ে আছে রাস্তা জুড়ে। গাছের দিক থেকে চোখ ফেরাই সামনের দিকে, নাক বরাবর যে ঘরটি তার সামনে লেখা আছে ‘রিসেপশন’, সেখানে বসে রয়েছেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক, তাঁর কাছে গিয়ে নাম লেখাই। চৈতালি সেন লিখতেই বলেন তাঁরও এক পদবি। পঙ্কজ সাহার নামটি লিখতে লিখতে বলি যে উনি এসে আমাকে দেখা করতে বলেছেন, কারণ আমি বুঝতেই পারছিলাম এ বিষয়ে কিছু বক্তব্য রাখবেন। ঘরটি ঠিক কোথায় তার হদিশ দিতে বলি এবং এগিয়ে যাই।
ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াই সংকোচ ভরে, সামান্য অস্বস্তি তো হচ্ছিলই, যাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছি তিনি ছাড়াও আরও কয়েকজন ছিলেন সেখানে, ঢোকা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিলাম না, সাহস করে বিনীত ভঙ্গিতে বলি, ‘আসতে পারি?’ ‘এসো তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এদের সবাইকে বসিয়ে রেখেছি, এরা হল তরুণ ভাস্কর’, বললেন পঙ্কজ সাহা। আমার সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন, কোথায় আমাকে আবিষ্কার করলেন সে গল্পও বললেন, আরও একটি কথা বললেন যা শুনে আমি রীতিমতো লজ্জায় পড়ি, বললেন, ‘অনুষ্ঠানের বিষয় যখন ভাস্কর্য তখন ওর মুখের গঠনটি বেশ মানাবে বলে আমার মনে হয়’, ওঁর কথা বলার ভঙ্গিটি অত্যন্ত পরিশীলিত। আমায় বুঝিয়ে দিলেন যে ভাস্কর দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী সম্পর্কে ‘তরুণদের জন্য’ অনুষ্ঠান আমায় সংযোজনা (এঁদের ভাষায় compere করতে হবে) করতে হবে আর এই তরুণ ভাস্করদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। এছাড়াও বাইরে গিয়ে আরও কারও কারও মূলত তরুণ-তরুণীদের সাক্ষাৎকার নিতে হতে পারে প্রয়োজন হলে। কাজটা প্রথমে আমার বড়ই কঠিন বলে মনে হল, কিন্তু ঘাবড়ালাম না।
শেষ পর্যন্ত এই কাজটি আর করা হয়ে ওঠেনি। অনুষ্ঠানটিও হয়েছিল বলে মনে পড়ছে না। ভাস্কর্য নিয়ে তরুণদের জন্য এই কাজের আগে ডাক পড়ল মিউজিক সেকশন থেকে। এই বিভাগের প্রযোজক ছিলেন ইন্দ্রাণী বটব্যাল (পরে রায়), আর তাঁর সহযোগী ছিলেন শর্মিষ্ঠাদি।
জুলাই মাসের এক বর্ষণসিক্ত সন্ধেয় শর্মিষ্ঠাদি আর পঙ্কজদা (ততদিনে প্রযোজক পঙ্কজ সাহাকে পঙ্কজদা বলে ডাকতে শুরু করে দিয়েছি) এলেন আমাদের বাড়িতে।
সাতের দশকে এ অঞ্চলটা বড়ই নির্জন ছিল, বসতি তেমন ছিল না, বেশিরভাগটাই ছিল জংলা জমি। কোনও গাড়ি যাওয়ার আওয়াজ হলেই ছুটে বারান্দায় যেতাম, সেদিনও হল তাই, বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামতে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি, ওঁরা দু’জন ঢুকছেন আমাদের বাগানের ছোট গেট দিয়ে, রীতিমতো অবাক হই। এরপর ওঁরা যা বললেন সেটা আরও আশ্চর্যের। পরের দিন সকালবেলা আমাকে যেতে হবে টেলিভিশন স্টুডিও-তে একটা প্রোগ্রাম রেকর্ডিংয়ের জন্য। শান্তিনিকেতন থেকে আসছেন বিশিষ্ট কয়েকজন মানুষ তাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠান। এর চেয়ে বিস্তারিত কিছু জানা গেল না। শর্মিষ্ঠাদি শুধু বললেন, ‘অসুবিধে হবে না, তোর সব পরিচিতরাই আসছেন।’
আমায় ভাবনায় রেখে ওঁরা চলে গেলেন।
(চলবে)
অভিনেতা হিসেবে অভিনয়ের যে জায়গাগুলো তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যা আমি আগেও বলেছি, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা, জয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সাধারণ মানুষ যা প্রকাশ করতে পারে না চট করে। মনোজ মিত্র তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তাকে বড় করে দেখিয়েছেন।