ডেকে পাঠিয়েছেন ‘চন্দ্রবিন্দু’কে নিজের দপ্তরে। কী বলতে পারেন ঋতুপর্ণ, সেই নিয়ে আমাদের মনের ভিতর তোলপাড়। দুটো সিনেমা করে ঋতুপর্ণ তখন খ্যাতির মেঘে ভাসমান, আর আমরা, তিন তিরিক্ষে বাংলা ব্যান্ড, একইরকম এবড়োখেবড়ো, রুক্ষ ও অসমান। লিখছেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়।
১.
উপলের বাড়ির ফোন বাজল ঝমঝমিয়ে। ওপারে পরমা। খুব উত্তেজিত। ‘অ্যাই শোনো, ঋতুদার ভীষণ ভাল লেগেছে তোমাদের গান। একদিন আমাদের অফিসে আসতে বলেছে।’ ‘ঋতুদা’– মানে ঋতুপর্ণ ঘোষ, ‘আমাদের অফিস’ মানে আনন্দলোক দপ্তর। দুলেন্দ্র ভৌমিকের পর ঋতুপর্ণ দায়িত্ব নেওয়ায়, আনন্দলোক-এর তখন বিরাট বোলবোলা। সেই অফিসে এখন পরমাও কাজ করে। হপ্তাখানেক আগে নজরুল মঞ্চে একটা শো ছিল ‘চন্দ্রবিন্দু’র। গান যে কীরকম হয়েছিল মনে নেই, তবে স্টেজে বিস্তর পাকা পাকা কথা বলেছিলাম, মনে আছে। সেই ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ? কই দেখিনি তো! যে সময়ের কথা লিখছি, তখন ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উনিশে এপ্রিল’, ‘দহন’ হয়ে গিয়েছে। মননশীল ছবি কীভাবে দর্শকস্রোতকে এভাবে হলমুখী করল, তা নিয়ে হইচই চাদ্দিকে! ‘এসথেটিক্স’ শব্দটাও খুব ঘোরাফেরা করছে ফিল্মি আড্ডার ঠোঁটে। গড়িয়াহাটে পাওয়া যাচ্ছে উনিশে এপ্রিল নাইটি। দেবশ্রী রায় ‘সেরা অভিনেত্রী’ জাতীয় পুরস্কারে, তাঁর মতো করে সকলে ‘থ্যাঙ্ক্স’ বলা প্র্যাকটিস করছে, ‘দহন’-এ ঋতুপর্ণা-অভিষেকের ‘ম্যারিটাল রেপ’-এর দৃশ্য দেখে বাঙালির চোখ ছানাবড়া, ওদিকে জোড়া জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর বাংলা কমার্শিয়াল ছবির ঋতুপর্ণা-ইন্দ্রাণীকেও দর্শক অন্যভাবে আবিষ্কার করতে শুরু করেছে, এসবের নেপথ্য-নায়ক যিনি, বহুদিন পর সেই অবিশ্বাস্য প্রতিভাবানকে ঘিরে কলকাতা উত্তাল! সে হেন এক মানুষ আমাদের গান শুনে পছন্দ করেছেন! দেখাও করতে চেয়েছেন! আচ্ছা! উপল, চন্দ্রিল, আমি নানারকম টেনশন জিন্সের পকেটে ঢুকিয়ে রওনা দিলাম আনন্দবাজার আপিসের দিকে। দীর্ঘকাল ফ্রিল্যান্স করার দরুন আমি বা চন্দ্রিল– দু’জনেই জানি ওই আপিসের রিসেপশনটি কেমন বেয়াড়া। ফলে পরমাকে বলেছিলাম নিচে দাঁড়াতে। চন্দ্রবিন্দুরও তখন দু’-দু’টি অ্যালবাম বেরিয়ে গিয়েছে। গভীর দুঃখের বিষয়, তা সত্ত্বেও কেউ আমাদের পথেঘাটে চিনতে পারে না। দুটো সিনেমা করে ঋতুপর্ণ তখন খ্যাতির মেঘে ভাসমান, আর আমরা, বাংলা ব্যান্ডের তিন তিরিক্ষে, একইরকম এবড়োখেবড়ো, রুক্ষ ও অসমান। ফলে একটা লজ্জাও কাজ করছিল। খুব বড়লোক আত্মীয়র বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে গেলে যেমন হয়।
পরমা আমাদের বহুদিনের বন্ধু। যেমন গান গায়, তেমন কথা বলতে ভালবাসে। চন্দ্রবিন্দুর দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘গাধা’-তে ‘বন্ধু তোমায়’, ‘তোমারই সামনে নতজানু আমি’, ‘ফাঁকা নাকি’– এই গানগুলোতে অপূর্ব সব ব্যাকআপ লাইন গেয়েছে। তাই আমাদের গানের সঙ্গে ওর আবেগও জড়িয়ে অনেকটা। কেন ডেকেছে রে? গল্প করতে ডেকেছে। ঋতুদা কতরকম বিষয় নিয়ে গল্প করতে ভালবাসে। পুরনো আনন্দলোক অফিসে আলাদা কোনও বসার জায়গা ছিল না, ঋতুপর্ণর অন্য মিটিং চলছিল, আমরা করিডোরে চুপ করে দেওয়ালের পেইন্টিং দেখছিলাম। কী বলতে পারেন ঋতুপর্ণ, সেই নিয়ে মনের ভিতর একটা তোলপাড়ও চলছিল। আমাদের গান নিয়ে এর আগে কোনও প্রশংসা পাইনি, এমন তো নয়। অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক অজিত চৌধুরি বলেছিলেন, এই নাকি পোস্টমডার্ন গান, কবি জয়দেব বসু জনে জনে বলে বেড়িয়েছে আমাদের গানের কথা, এমনকী, কবিতাও লিখেছে চন্দ্রবিন্দুকে নিয়ে। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ভাল লাগা ছিল ‘আর জানি না’, ‘গাধা’ অ্যালবাম নিয়ে, কত সন্ধের মদ-আড্ডা-পাগলামি জড়িয়েছিল তাঁর সঙ্গে। ফলে বিদ্বজ্জনের কাছে একটু একটু করে একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হচ্ছে আমাদের। এখন দেখার ঋতুপর্ণর কী অভিমত গানগুলো প্রসঙ্গে।
পরমা মাঝে মাঝেই এসে বলে যাচ্ছিল, ‘আর একটু’, ‘আর একটু’। এডিটরের ঘর খালি হলেই। এর মধ্যে আর একটা কাণ্ড ঘটল! একজন পরমাসুন্দরী মেয়ে এবং তার মা এসে আনন্দলোক দপ্তরের সামনেই দাঁড়াল। তাদের দেখে শশব্যস্ত হয়ে যে সাংবাদিক বেরিয়ে এলেন, তাঁকে আমি চিনি, স্বপনকুমার ঘোষ। নিয়মিত বাইলাইন ছাড়াও ওঁর লেখা বেরত ‘স্ব কু ঘো’ নামে। বোঝা গেল, এরাও ঋতুপর্ণর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছে। মেয়েটিকে কাচের মতো সুন্দর দেখতে, এমন একটা বাঙালি আভা ছড়িয়ে তার বেশভূষায়, বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল তার দিকে। অপেক্ষা এখন আর ততটা অসহনীয় নয়, অন্তত মেয়েটি আসার পর। কিন্তু একটা টেনশন তার সঙ্গে ঢুকে গেল। এরা কি আগে যাবে? তাহলে তো আরও কিছুক্ষণের ঝক্কি। পরমাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজের ডেস্কে।
উপল, আমার চন্দ্রিলের মধ্যে সব কথাই হচ্ছে হাবেভাবে, কারণ এই অফিসটায় উঁচু গলায় কথা বলে না কেউ। দপ্তরের বাকিরা আমাদের দেখছে, ঠিক বুঝতে পারছে না, তিনটি শালিখ কেন ওয়েট করছে আনন্দলোকের চালে। আমি আড়চোখে মেয়েটির দিকে চাইলাম। তার দৃষ্টি মাটিতে। এ তো মেয়ে, মেয়ে নয়, হিরোইন নিশ্চয়। স্বল্প পরিচিত তিন অনিশ্চিত গায়ক ও একজন ‘নির্ঘাৎ নায়িকা’ অনির্দিষ্টের প্ল্যাটফর্মে মাটিতে চোখ মিশিয়ে আরও খানিকক্ষণ কাটানোর পর, ক্যাঁচ শব্দে এডিটরের ঘরের পাল্লা খুলল, স্বকুঘো হালকা বিরক্তি নিয়ে ডাকলেন, ‘অ্যাই, তোমরা এসো।’
প্রতি রবিবার, ‘ইতি কলেজ স্ট্রিট’ প্রকাশিত হয় রোববার.ইন-এ। কলেজ স্ট্রিট, পুরনো কলকাতা, লেখক-প্রকাশকের চিঠি, প্রকাশকের চোখে দুরন্ত এক প্রকাশনা গড়ে তোলার স্বপ্ন– সব মিলিয়ে এই কলাম যেন এক মায়াবি ট্রাম, যা লেখকদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করছে অনবরত। পাঠক সেই ধারাবাহিক পড়েই লিখেছেন আন্তরিক এক চিঠি।