মাধ্যমিকের সময় একজনকে দেখলাম। গা চুলকোতে গিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ কাগজের টুকরো বেরিয়ে পড়েছে। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। হায়ার সেকেন্ডারির স্ট্যাটিসটিক্স পরীক্ষা অর্ধেক হয়েছে কি হয়নি– একজন ভদ্রলোক ঢুকলেন ক্লাসে। সিট পড়েছে অন্য স্কুলে, অচেনা লোকজন। তার ওপর তাঁর মুখও দেখা যাচ্ছে না, কারণ খান দশেক গাবদা পাঠ্যবই হাতে ভর দিয়ে নিয়ে এসেছেন। সেগুলো নাকি টয়লেটে পাওয়া গিয়েছে। আবার প্রমাণিত হল টুকলির পাপ কখনও চাপা থাকে না।
দাদার বন্ধুর কাছে প্রথম টোকাটুকির গল্প শুনি। ওঁর ইউনিভার্সিটি ক্লাস টেস্টের উত্তরপত্রর শেষ পাতার একটি অংশে নাম, রোল নং ইত্যাদি লেখার জায়গা থাকত। পাশে যে-বন্ধু বসেছেন, আধ ঘণ্টার পরীক্ষায় তিনি কিছুই লিখে উঠতে পারেননি। সারাক্ষণ কলম কামড়েছেন এবং অপেক্ষায় থেকেছেন কখন তাঁর প্রতিবেশীর লেখা শেষ হয়। ওয়ার্নিং বেল পড়ামাত্র খাতা কেড়ে নিয়ে টুকতে লেগেছেন। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু পরদিন স্যর খাতা ফেরত দেওয়ার সময় জানালেন যে, তিনি একটি অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। একজন ছাত্র খাতা জমা দেয়নি এবং অন্য আরেকজন দু’টি খাতা জমা দিয়েছে। আমার কাছে এই গল্পের নীতিবাক্য হল যে, টুকলি করতে গিয়ে নিজের নাম এবং রোল নাম্বার ভুলে যেও না।
কিন্তু বড়রা এই ধরনের গল্প শুনিয়ে থাকেন, যাতে ছোটবেলা থেকেই আমরা বুঝে যাই যে, টুকলি একটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভই হল টুকলিবিহীন জীবনের বীজ, যা ছাত্রছাত্রীদের মগজে ছোটবেলাতে বপন করা হলে বয়সকালে মহীরুহ হয়ে জ্ঞানের স্নিগ্ধ ছায়ায় শরীর-মন ঠান্ডা রাখবে। আমার স্কুলের বন্ধু বিমান এই আদর্শে দীক্ষিত ছিল, তা হলফ করে বলতে পারি। আমাদের বাংলা ব্যাকরণের স্যর একটু ভুলোমনা ছিলেন। তিনি প্রত্যেক বছর প্রায় নিয়ম করে আমাদের অব্যয় পড়াতেন, সিলেবাসে না থাকলেও। আর কেন জানি না এদিক-ওদিক খুঁজে বিমানকেই পাকড়ে বলতেন, অব্যয়যুক্ত একটি বাক্যের উদাহরণ দিতে। একবার বিমান বলল, ‘পরীক্ষায় ফেল করিব তথাপি টুকলিফাই করিব না।’ স্যর ভীষণ রেগে বকাঝকা করলেন এবং ক্রমাগত বলতে থাকলেন, ‘টুকলিফাই? অ্যাঁ? টুকলিফাই?’ বিমান বুঝতেই পারে না তার টেকনিক্যালি সঠিক বাক্য গঠনের জন্য কেন পাঁচকথা শুনতে হবে। তার শুভানুধ্যায়ীরা অনেক ভেবে চিনতে জানাল যে, ‘টুকলিফাই’ শব্দটা একটু ইংরাজি মার্কা শোনাচ্ছে, তাই বোধহয় স্যর রেগে গিয়েছেন। হাজার হোক বাংলার ক্লাস! যুক্তিটা বিমানের মনে ধরায় পরের বার সে একটু শুধরে নিল– ‘…তথাপি টুকলি করিব না।’ এবার কানমলা।
এইসব দেখে শুনে আমার বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল যে, ওই ‘টুকলি’ ব্যাপারটি গোলমেলে। শব্দের অভিঘাতেই যদি এমন ব্রহ্মাস্ত্র তেড়ে আসে, তাহলে ক্রিয়াটি করলে না জানি কী জুটবে কপালে। মাধ্যমিকের সময় একজনকে দেখলাম। গা চুলকোতে গিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ কাগজের টুকরো বেরিয়ে পড়েছে। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। হায়ার সেকেন্ডারির স্ট্যাটিসটিক্স পরীক্ষা অর্ধেক হয়েছে কি হয়নি– একজন ভদ্রলোক ঢুকলেন ক্লাসে। সিট পড়েছে অন্য স্কুলে, অচেনা লোকজন। তার ওপর তাঁর মুখও দেখা যাচ্ছে না, কারণ খান দশেক গাবদা পাঠ্যবই হাতে ভর দিয়ে নিয়ে এসেছেন। সেগুলো নাকি টয়লেটে পাওয়া গিয়েছে। আবার প্রমাণিত হল টুকলির পাপ কখনও চাপা থাকে না।
কিন্তু কাঁহাতক আর পারা যায়! বিএসসি অনার্সের পেপারে প্রদীপ্তকে কাতর অনুরোধ জানাই। সে খাতা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার আদর্শবোধ ছলাৎ করে ওঠে, ‘একটু বুঝিয়ে দিবি? তারপর টুকব।’ প্রদীপ্তর চোখ দপ দপ করে জ্বলে ওঠে। খাতা ঠেলে দিই। তাও পেরিয়ে গেলাম মোটের ওপর। কিন্তু পাস সাবজেক্টে কেমিস্ট্রি! ফেল করার সম্ভাবনায় আঁতকে উঠি। পরীক্ষায় ঈশ্বর ভরসা মাধ্যমিকের পরই পগার পেরিয়েছে। তাই দশ বছরের কোয়েশ্চন-আনসার এর বই ঘেঁটে, নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে (তখন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স জন্মায়নি) ২৬টি হোয়াট হ্যাপেন্স হোয়েন আর ২৮টি এক্সপ্লেন হোয়াই পকেটস্থ করি। তারপর প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার পর ওই সেকশনগুলির প্রশ্ন মগজে ঢোকাই। সময়মতো টয়লেটে গিয়ে ব্যক্তিগত ভাঁড়ার খুলি। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে সেই অমোঘ বাণী– ‘যাঃ শালা’। একটাও মেলেনি। যে টয়লেটে প্রায় কেউই প্রকৃতির কাজ করছে না, এদিক-ওদিক হাত মেরে বই বের করে আনছে, সেখানেই দেশি স্টাইল পায়খানায় চোরের মতো প্রবেশ করি। বারবার ফ্লাশ করার পরও টুকলির নৌকোরা যদিও ভেসেই থাকে।
তবে সত্যি বলতে, টুকলি ঈশ্বরের দয়ার শরীর। যে তাঁকে ছোটবেলায় পায়নি, তাকে বয়সকালে হাত খুলে দেন। গত ৩০ বছর তাই কপি-পেস্ট করেই কামিয়ে গেলাম।