কেভেন্টার্সের ছাদের একেবারে শেষ মাথায়, কোনাচে জায়গাটা আমার সব থেকে পছন্দের। ওখান থেকে নিচে জিপ স্ট্যান্ড, চকের দিকে নেমে যাওয়া লাডেনলা রোড, ক্লক টাওয়ার আর পিছনের পাহাড় মিলিয়ে গোটা দৃশ্যটা ভারি মনোরম লাগে– গেলেই আঁকতে ইচ্ছে করে।
উত্তরবঙ্গ কিংবা সিকিম পাহাড়ের কোথাও বেড়াতে গেলে ফেরার পথে একবারটি দার্জিলিং ছুঁয়ে না-এসে পারা যায় না। আর দার্জিলিং-এ এলে নিদেনপক্ষে একটা সকাল আমাদের বরাদ্দ থাকে কেভেন্টার্সের জন্য। গুটি গুটি পায়ে গিয়ে খোলা ছাদের একটা টেবিল দখল করে বসি ব্রেকফাস্ট করার জন্য। ছাদের একেবারে শেষ মাথায়, কোনাচে জায়গাটা আমার সব থেকে পছন্দের। ওখান থেকে নিচে জিপ স্ট্যান্ড, চকের দিকে নেমে যাওয়া লাডেনলা রোড, ক্লক টাওয়ার আর পিছনের পাহাড় মিলিয়ে গোটা দৃশ্যটা ভারি মনোরম লাগে– গেলেই আঁকতে ইচ্ছে করে। এই লাডেনলা রোড ধরে একটু নামলেই রয়েছে আমাদের চেনা চায়ের দোকান ‘টি এম্পোরিয়াম’। দার্জিলিং-এর পুরনো বাসিন্দা মিত্তিররা তিন পুরুষ ধরে চালাচ্ছে, এখান থেকে আরও দু’পা গেলেই সোলটি– যেটা আমার দেখা একমাত্র চিনে রেস্তোরাঁ, যারা মাটন দিয়েও ওদের যাবতীয় খাবার বানিয়ে থাকে। মনে আছে, একবার কেভেন্টার্সের এই ছাদটার ধারে আমাকে দাঁড়িয়ে আঁকতে দেখে আমাদের দলের এক অতি উৎসাহী তরুণের সাধ হল সেটা ভিডিও করার, ভালই হচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্যামেরা নিয়ে তিনি এমন সব ভেলকি দেখাতে গেলেন যে, ছাদের পাঁচিল টপকে সটান নিচে পড়ে যেতে যেতে সে যাত্রায় কোনওক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন! এদিকে আমার আঁকার তখন যাকে বলে দফারফা!
আরও পড়ুন: কালীঘাট মানেই পুরনো কলকাতার স্বাদ-গন্ধ
আরও পড়ুন: ‘ওই দ্যাখ, তেনজিং নোরগে’, বলেছিল বাবা, আমি ক্লাস ফোরের চোখ দিয়ে দার্জিলিং দেখছিলাম
এই ছাদটাতে বসে ক’-বছর আগেও মাথা উঁচু করলেই দেখা যেত আগাগোড়া কাঠের তৈরি বড় বড় জানলাওলা প্লান্টার্স ক্লাবের ছড়ানো বাংলোটা। কেতাদুরস্ত সাহেবি আমলের গন্ধমাখা একটা উজ্জ্বল ছবি যেন ভেসে বেড়াত চোখের সামনে। আশ্চর্য লাগে, গোটা বাংলোটাকে একেবারে ধূলিসাৎ করে সেই জায়গায় এখন কংক্রিটের বেঢপ মার্কা একটা বাড়ি হয়েছে। অথচ ওই বাংলোতে ওঠার ঢালু রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে, সরু লোহার রেলিঙের ওপর স্কেচ খাতাটাকে কোনওমতে ঝুলিয়ে, কেভেন্টার্সের বাড়িটার একসময় কত ছবি এঁকেছি। অনেক দেখে-শুনে এখান থেকেই আঁকাটা সবথেকে সুবিধেজনক বলে মনে হত। দূর থেকে দেখে সাদার ওপর লাল আর সবুজ রং করা বাড়িটার সঙ্গে কেন জানি না আমি একটা ছোটখাটো স্টিমারের খুব মিল পাই বরাবর। শুয়োরের মাংস দিয়ে তৈরি কেভেন্টার্সের খাবার আগমার্কা বাঙালি টুরিস্টের কাছে যাকে বলে ‘হট ফেভারিট’। অতএব আমরাও থালা ভর্তি সসেজ, বেকন, সালামি ইত্যাদি আনিয়ে হাপুসহুপুস করে খাওয়াটাকে পবিত্র কর্তব্য হিসেবে দেখে থাকি, সেইসঙ্গে গোয়েন্দা ফেলু মিত্তিরকে স্মরণ করে এক পেয়ালা হট চকোলেট অর্ডার দিতেও ভুলি না। গুছিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে এরপর সাধারণত আমরা দুলকি চালে হাঁটতে বেরই, আর পরিষ্কার দিন থাকলে বেছে নিই জলাপাহাড়ের দিকটাকে। তা না হলে ম্যাল রোডে লাগাতার চক্কর মারা তো হাতের পাঁচ আছেই। তবে সে গল্প আপাতত তোলা থাক পরের বারের জন্য।