দেশভাগের পর সম্ভাব্য ১৯৯২ সালে জুন মাসের দিকে একবার ঢাকায় আসেন যোগেন চৌধুরী। এরপর ২০১৪ সালের মার্চ মাসের দিকে সর্বশেষ নিজ গ্রামে এসেছিলেন। সেই যাত্রায় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন কলকাতা থেকে চিত্রসমালোচক অরুণ ঘোষ, সুনীল যশমান এবং ঢাকা থেকে যুক্ত হোন ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাত ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। সেই যাত্রা পথ ছিল ঢাকা-মাওয়াঘাট হয়ে পদ্মার জল ছুয়ে চলা ফেরিতে করে ডহরপাড়া গ্রাম ফেরা।
১.
যোগেন চৌধুরীর ছেড়ে যাওয়া নিস্তব্ধ গ্রাম ডহরপাড়া। এখানে মানুষ কম, প্রকৃতি বেশি। এই প্রকৃতি যোগেন চৌধুরীর ক্যানভাস জুড়ে থাকে। ডহরপাড়ার শৈশব-কৈশোর, নদী-মাঠ-আকাশ-ফুলপুকুর রঙে-রেখায় ধরা পড়ে যোগেন চৌধুরীর ছবিতে। যোগেনের ‘যো’ পোতা আছে এই মাটিতে– ডহরপাড়ার বাড়ির আঙিনায়। যোগেন চৌধুরীর আঁকা প্রথম দিকের ছবিতে যে লতা-পাতা, মাছ-গাছ-মুখ দেখতে পাই, এসব তাঁর মেঘমেদুর ছেলেবেলা।
যোগেন চৌধুরীর ছবিতে যে জল দেখা যায়, যে জলের রঙে যোগেন চৌধুরী ছবি আঁকেন, সেই জলের উৎস ঘাঘর নদী। ডহরপাড়া গ্রামকে ঘিরে আছে ঘাঘর নদী। এই নদীর প্রাচীন নাম ‘ঘর্ঘর’। পদ্মপুরাণ ও মনসামঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্তের বাস ছিল এই নদীর পূর্বপাশের গ্রাম ফুল্লশ্রীতে।
প্রমত্ত পদ্মা ডহরপাড়া থেকে ঢাকাকে যতটা দূরত্বে রেখেছিল, পদ্মাসেতু ঠিক ততটাই কাছে নিয়ে এসেছে। ঢাকা শহর থেকে বাসে তিন ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদের চৌরাস্তার মোড়। পূর্বে ফরিদপুর জেলার ভিতরে ছিল ডহরপাড়া। বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার আওতাধীন ডহরপাড়া গ্রাম।
যোগেন চৌধুরীর বাড়ির সন্ধানে এসে প্রথম খুঁজে পেলাম কোটালীপাড়া উপজেলার ‘শেখ লুৎফর রহমান কলেজ’-এর অধ্যাপক গৌরাঙ্গলাল চৌধুরীকে। গৌরাঙ্গ চৌধুরী সম্পর্কে যোগেন চৌধুরী জ্ঞাতি। এই ডহরপাড়ার জমিদার বাড়ির আরেক কৃতী সন্তান অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা গানের রচয়িতা মোহিনী চৌধুরী। যিনি একাধারে কবি, গীতিকার এবং চিত্রপরিচালক। মোহিনী চৌধুরীর লেখা কালজয়ী একটি গান হচ্ছে–
‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হল বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে।’
ডহরপাড়ার পাশের গ্রাম মনদপাড়। এই গ্রামের সন্তান বিজন চৌধুরী। যোগেন চৌধুরীর আরেক জ্ঞাতি শিল্পী বিজন চৌধুরী। পাশে ঊনশিয়া গ্রামে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক বাড়ি। বর্তমানে যোগেন চৌধুরীদের পৈতৃক বাড়িতে বসবাস করছেন মোতাহার সরদার। আগের সেই ঘর নেই। পথ আছে, রয়েছে পুকুর, দিঘি। বাড়ির পিছনের দিকে বাঁশঝাড়, বাড়ির সম্মুখে রক্তজবা গাছ।
দিঘির নাম ‘দেড় আনি দিঘি’। পুকুরের নাম ‘ফুলপুকুর’। বাড়ির পুজোর জল তোলা আর পুজোর বাসি ফুল জলে ফেলার জন্য এই পুকুরের নাম ফুলপুকুর। পুকুরের পাশেই বাঁশঝাড়। শৈশবে এই বাঁশঝাড় থেকে কঞ্চি কেটে বড়শি বানিয়ে মাছ ধরতেন যোগেন চৌধুরী। বর্ষায় নিজেদের নৌকায় করে দূরে চলে যেতেন। যোগেন চৌধুরীর বাবারও প্রিয় নেশা ছিল মাছ ধরা।
গোপালগঞ্জের আদি নাম রাজগঞ্জ। মকিমপুর এস্টেটের জমিদার রানি রাসমণির এলাকাধীন ছিল এই রাজগঞ্জ। কথিত আছে যে, রানি রাসমণির তাঁর স্নেহাস্পদ নাতি গোপালকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন এই রাজগঞ্জে। সেই ভ্রমণের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে রাজগঞ্জের ‘রাজ’ শব্দটির জায়গায় গোপাল নাম যুক্ত করে এলাকার নাম রাখা হয় গোপালগঞ্জ। কোটালীপাড়া নামেরও কিংবদন্তি রয়েছে। ‘কোটাল’ শব্দের অর্থ ‘যোদ্ধা’ বা ‘নগররক্ষক’ এবং ‘পাড়া’ শব্দের অর্থ ‘বসতি’। একদা কোটালীপাড়া ছিল প্রাচীন স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের একটি প্রাচীরঘেরা সুরক্ষিত নগরী।
শিল্পী যোগেন চৌধুরীর জন্ম ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯ সাল। গোপালগঞ্জে কোটালীপাড়ার ডহরপাড়া গ্রামে। নয় বছর বয়স পর্যন্ত এই গ্রামেই ছিলেন। পড়াশোনার প্রথম পাঠ এই গ্রামেরই পাঠশালাতে। বাড়ির আটচালা ঘরের এক অংশে পাঠশালা বসত। পাঠশালায় আধবেলা পড়ার পাট থাকত। সেই পাঠশালার অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। কিন্তু আবহ আছে। পাশের গ্রামে রয়েছে ‘কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইন্সটিটিউশন’ সবাই ডাকে ‘বালিয়াভাঙা স্কুল’ নামে। প্রতিষ্ঠাকাল ইংরেজি ১৮৯৮ সন। এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় চৌধুরী বাড়ির অবদান রয়েছে। এই স্কুলের প্রথম দিকের সভাপতি শ্যামাকান্ত চৌধুরী।
যোগেন চৌধুরীর পিতা প্রমথনাথ চৌধুরী, মাতা আলপনা চৌধুরী। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের দিকে মা, ছোট বোন নমিতা চৌধুরী, ছোট ভাই মণীন্দ্র চৌধুরী চলে যান কলকাতায়। পাঁচের দশকের শুরুর দিকে ঠাকুরমা, বাবা চলে যান কলকাতায়। ডহরপাড়ার সঙ্গে বৈষয়িক সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়।
যোগেন চৌধুরীর শৈশবে এই গ্রামে বড় আয়োজনে দুর্গাপুজো হত। পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে যাত্রা, গ্রাম থিয়েটারও হত। এই থিয়েটারের জন্য মঞ্চসজ্জার বিভিন্ন দৃশ্য আঁকা, চরিত্র সাজাতে বিভিন্ন প্রপস তৈরি করা এবং মঞ্চে নারী-চরিত্রে অভিনয় করতেন যোগেন চৌধুরী বাবা প্রমথনাথ চৌধুরী।
যোগেন চৌধুরী ছেলেবেলার প্রথম যে শিল্পীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে, তিনি তাঁর বাবা। বাবার হাতেই যোগেন চৌধুরীর শিল্পপাঠের হাতেখড়ি। বলা যায়, যোগেন চৌধুরী শিল্পপাঠের শুরু ডহরপাড়ার নিজ বাড়ির আঙিনায়।
যোগেন চৌধুরীদের বাড়ি ছিল কাঠের দোতলা। এই ফরিদপুর অঞ্চল এবং নিকটবর্তী বরিশাল-বিক্রমপুর বা পদ্মার এপার-ওপারের বাড়ির কাঠামো সবই কাঠের দোতলা ঘর। কীর্তিনাশা পদ্মা নদীর গতিপ্রকৃতিকে মাথায় রেখেই এমন ঘর তৈরি করা হয়ে থাকে।
ডহরপাড়া গ্রামকে ঘিরে প্রায় ৪৫০ বছরের জমিদারি ছিল যোগেন চৌধুরীদের। চৌধুরী বংশের জমিদারিতে আড়াই হাজার বিঘা জমি ছিল, এমনকী প্রমথনাথ চৌধুরীর সময়েও। তাঁর পূর্বপুরুষদের পদবি ছিলো ‘মিশ্র’। সুদূর অতীতে রাজা বিক্রমাদিত্যের আমলে উত্তরপ্রদেশের কনৌজ থেকে পাঁচ মিশ্র ব্রাহ্মণ এসেছিলেন এখানে। মিশ্র থেকে চক্রবর্তী, জমিদারি পাওয়ার পর হোন চৌধুরী। মিশ্ররা ছিলেন বৈদিক শ্রেণিভুক্ত, পূর্বপুরুষেরা সবাই বেদচর্চা করতেন। স্বনামধন্য হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, যিনি মহাভারতের টীকা-টিপ্পনী লিখে খ্যাত, তিনি ছিলেন চৌধুরী পরিবারের সন্তান। সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তী ছিলেন যোগেন চৌধুরীর কাকিমার জামাইবাবু।
দেশভাগের পর সম্ভাব্য ১৯৯২ সালে জুন মাসের দিকে একবার ঢাকায় আসেন যোগেন চৌধুরী। এরপর ২০১৪ সালের মার্চ মাসের দিকে সর্বশেষ নিজ গ্রামে এসেছিলেন। সেই যাত্রায় তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন কলকাতা থেকে চিত্রসমালোচক অরুণ ঘোষ, সুনীল যশমান এবং ঢাকা থেকে যুক্ত হোন ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসনাত ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। সেই যাত্রা পথ ছিল ঢাকা-মাওয়াঘাট হয়ে পদ্মার জল ছুয়ে চলা ফেরিতে করে ডহরপাড়া গ্রাম ফেরা। এখানেই ফিরে আসেন বারবার যোগেন চৌধুরী। ওপারে যে বাংলা, এপারে সেই বাংলাদেশ।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………