Robbar

‘আরতি দাস’কে দেশভাগ নাম দিয়েছিল ‘মিস শেফালি’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 3, 2025 9:10 pm
  • Updated:March 3, 2025 9:10 pm  

এপারে আরতি দাস। ওপারে শেফালি। দেশভাগ শুধু নতুন নাম দেয়নি। পুনর্জন্ম দিয়েছে অনেককে। তেমনই পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাত্রা– নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার আরতি দাসের পুনর্জন্ম হয় শেফালি নামে কলকাতায়। শীতলক্ষ্যা নদীর পারের মেয়ের জায়গা হয় গঙ্গার ধার আহিরীটোলায়।

কামরুল হাসান মিথুন

৩.

‘বাঙালির মেয়ে হয়ে হোটেলে নাচবা?’

লালবাজারের পুলিশ অফিসারের এই প্রশ্নের জবাবে ১২ বছরের আরতি দাস উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ক্যান, আপনে আমারে খাওয়াইবেন? রাখবেন আপনার বাড়িতে? ঝি হইয়া কিন্তু থাকুম না, মেয়ের মতো রাখতে অইব। তাইলে আমি হোটেলে নাচুম না।’

এমন উত্তরের পর ডান্সার হিসেবে সহজেই লাইসেন্স পেয়ে যান আরতি দাস। ক্ষুধাকে জয় করার, মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াইয়ে– পরিবার, সংস্কার, সমাজকে পিছনে ফেলে হয়ে ওঠেন কলকাতার ক্যাবারে কুইন ‘মিস শেফালি’।

কলকাতার ক্যাবারে কুইন ‘মিস শেফালি’। ছবি: নিমাই ঘোষ

আরতি দাস থেকে মিস শেফালি হয়ে ওঠা রূপকথার গল্পের মতো। চরম দারিদ্রে দাসীবৃত্তিই যাঁর নিয়তি ছিল তিনি হয়ে উঠলেন কলকাতা শহরের রাতের সম্রাজ্ঞী। ফুলের গন্ধের মতো ছড়িয়ে পড়লেন কলকাতা শহরের চারিদিকে। সুরভিত স্মরণে স্মরণীয় হয়ে থাকলেন ৬-৭ দশকের শহরবাসের ইতিকথায়। ডান্স ফ্লোর থেকে চলচ্চিত্র, থিয়েটার, যাত্রাপালা। সব জায়গায় মিস শেফালি হিসেবেই ছিলেন। আমৃত্যু মিস শেফালি হয়েই থাকলেন। পেশাদার নৃত্যশিল্পী থেকে জাত-শিল্পী হিসেবে সমগ্র জীবন যাপন করলেন। নাচই ছিল তাঁর পেশা, নেশা এবং আত্মপরিচয়। ফিরপোজের লিডো রুম, ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলের প্রিন্সেস হল, কলকাতা, বোম্বে, মাদ্রাজ– সব শহরের বড় হোটেলের ডান্স ফ্লোর তাঁর পায়ের তালুর চেয়ে ছোট।

একান্তে, অবসরে: মিস শেফালি। ছবি: নিমাই ঘোষ

‘এক জাতি এক দেশ’ বলে যে তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছিল তার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল দেশভাগের বীজ। জাতির নামে বজ্জাতি বুঝি একেই বলে!

দেশভাগ বাঙালির ভাগ্যকেও যেন ভাগ করে দিয়েছে। আর বাঙালি সেই পোড়া ভাগ্যকে মেনেও নিয়েছে! সরকারের আইন অনুযায়ী, এপার-ওপার বাংলায় সকলের পক্ষে বাড়ি অদলবদল করা সম্ভব হয়নি। যাঁদের সম্ভব হয়নি তাঁদের পরিচয় হয়েছে ‘উদ্বাস্তু’ হিসেবে। কিছু বিত্তবানেরা তবু ঘর পেয়েছিল, বাকি সাধারণ মানুষের ভাগ্যে জুটেছে পথের কিনার, ঘুপচি কোঠা, অন্ধকার গলি।

আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে সর্বশেষ ট্র্যাজেডি হচ্ছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ। এ বছরই ভারতবর্ষ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। গুটিয়ে নেওয়ার আগে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল। তিনটি খণ্ডে দু’টি রাষ্ট্র করা হল অখণ্ড ভারতবর্ষকে। বাংলা আর পাঞ্জাব– দুই ভাগে দু’টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অংশ হল। বাংলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল কাঁটাতার। অসংখ্য মানুষ আজন্মের জন্য নিজের ভিটামাটি ছেড়ে গেল এপার থেকে নতুন দেশে নতুন মাটির খোঁজে।

কলকাতা আর নারায়ণগঞ্জ প্রায় কাছাকাছি বয়সের শহর। প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ। আদি নাম ছিল খিজিরপুর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রিয়পাত্র ভিখনলাল ঠাকুর খিজিরপুর বদলে নাম রাখেন নারায়ণগঞ্জ। এই নারায়ণগঞ্জ জন্ম নেন আরতি দাস ওরফে মিস শেফালি। ’৪৭ সালের দেশভাগের কিছু সময় পর ঠাকুরমার কোলে করে নিজের দ্যাশ ছেড়ে চলে যান আরতি দাস। নিজ শহরে আর কখনওই ফেরা হয়নি শেফালির পরিবারের।

ব্রিটিশ ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তিনটি দেশের সাক্ষী এমন কিছু ভঙ্গুর ভবন এখনও নারায়ণগঞ্জে বিদ্যমান

এপারে আরতি দাস। ওপারে শেফালি। দেশভাগ শুধু নতুন নাম দেয়নি। পুনর্জন্ম দিয়েছে অনেককে। তেমনই পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাত্রা– নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার আরতি দাসের পুনর্জন্ম হয় শেফালি নামে কলকাতায়। শীতলক্ষ্যা নদীর পারের মেয়ের জায়গা হয় গঙ্গার ধার আহিরীটোলায়। নারায়ণগঞ্জ যেমন আরতি দাসের শহর তেমনই ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রের নায়িকা সারাহ বেগম কবরীর শহর। কবরী একসময় এই শহরের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া মিনা পাল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে হিসেবে খ্যাত কবরী।

মিস শেফালির জন্ম শহর নারায়ণগঞ্জ। ১৯৫০ সালের ছবিতে– ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা শীতলক্ষ্যা নদী। ছবি : JEAN AND FRANC SHOR

শেফালি ফুলের আরেক নাম শিউলি। তেমনই আরতি দাসের আরেক নাম শেফালি। সবার অলক্ষে, রাতের আঁধারে ফোঁটা ফুল শেফালি। আবার পুব আকাশে আলো ফোটার আভাসে ঝরে পরে শেফালি। জগতে ফুল হচ্ছে পাখাহীন পাখি আর প্রজাপতি হল পাখাওয়ালা ফুল। আরতি দাস হচ্ছে সেই পাখাওয়ালা ফুল, প্রজাপতি, পাখি।

আহিরীটোলার প্রতিবেশী নার্স রানির সহযোগিতায় জীবনের অনুজ্জ্বল সকাল শুরু হয় চাঁদনি চকের একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বাড়িতে ঝি-এর কাজ দিয়ে আর জীবনের চকচকে দুপুর শুরু হয় ১২ বছর বয়সে ফিরপোজ হোটেলের লিডো রুমে ডান্স দিয়ে। অনেক বছর পর সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ চলচ্চিত্রে নার্সের চরিত্র অভিনয় দিয়ে রিয়েল লাইভ থেকে অভিনয় জীবন শুরু করেন মিস শেফালি। আবার ক্যাবারে জীবনের শুরু যে ফিরপোজ হোটেলে। সেই হোটেলের লিডো রুমেই শেফালির নাচের দৃশ্য চলচ্চিত্রায়ন হয় সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ সিনেমায়।

Miss Shefali | Cabaret queen passes away - Telegraph India
সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ চলচ্চিত্রে নার্সের চরিত্রে মিস শেফালি

চাঁদনি চকের যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন আরতি দাস সেই বাড়িতেই পরিচয় হয় মোকাম্বো রেস্তরাঁর কণ্ঠশিল্পী ভিভিয়ান হ্যানসনের সঙ্গে। এই বাড়িতে থেকে পালিয়ে ভিভিয়ান হ্যানসনের সহযোগিতায় ডান্সার হিসেবে কাজ পান চৌরঙ্গী রোডের ফিরপোজ হোটেলে। ফিরপোজ হোটেলের মালিক রামনাথ কপূর আরতি দাসের নাম রাখেন শেফালি।

কে কারে পায়। মিস শেফালির দিকে চেয়ে থেকে রাত ভোর করেছেন অনেক পুরুষই। কিন্তু মিস শেফালি চেয়েছেন একজনকেই। রবিন রুটল্যান্ড মিস শেফালির প্রথম প্রেমিক। বোম্বের রিৎজে কন্টিনেন্টাল হোটলে গান গাইতো রবিন। এরপর আরও অনেকের সঙ্গে প্রেম হয়েছে, সঙ্গী হয়েছে কিন্তু রবিনকেই আজন্মকাল ভালোবেসেছেন। বাংলাদেশের একজন সুতো ব্যবসায়ী, কাশিম নামে চট্টগ্রামের আরেক ব্যবয়ায়ীর সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য প্রেম হয় শেফালির। কোনও প্রেম, কোনও সম্পর্কই ‘মিসেস’-এ রূপ পায়নি।

আরতি নাকি ‘মিস শেফালি’। ছবি: নিমাই ঘোষ

যেমন উত্তম কুমারের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তেমনই সুপ্রিয়াদেবী, সুচিত্রা সেনের সঙ্গেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে শেফালির। পরিচালক দুলাল গুহ’র সিনেমা ‘দো আনজানে’ ছবির শুটিং করতে কলকাতায় এসেছিলেন অমিতাভ বচ্চন, রেখা। তখন অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় শেফালির। এবং পরিচালক দুলাল গুহর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুলাল গুহ’রও আদি বাড়ি ছিল বরিশাল।

বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদী। টানবাজার ঘাট, নারায়ণগঞ্জ

অতীতের পদচিহ্ন মুছে গেছে সময়ের কূলে। জীবনের স্রোতে দিন গিয়েছে চলে– মিস শেফালির ফেরা হয়নি কখনও নিজের জন্ম শহর নারায়ণগঞ্জে। বাবা রামকৃষ্ণ দাস নারায়ণগঞ্জের এক পাট ব্যবসায়ীর আড়তে খাতা লেখার কাজ করতেন। মা ছিলেন গৃহিণী। সুভাষিণীর গর্ভ থেকে বের হয়ে যে শহরে প্রথম আলো হাওয়া গায়ে মাখলেন সেই শহরের কোন দিকটায় দাস পরিবার বসবাস করতেন, তা এখন আর চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

নারায়ণগঞ্জ শহরের টানবাজার এলাকা, প্রধান সড়কে বাংলা ও উর্দুতে— স্বদেশী যুগে প্রতিষ্ঠিত ‘সাধনা ঔষধালয় লিঃ’ এর সাইনবোর্ড

ভাই গোপাল দাস, বড়দি রেণু পরিবারের কেউ কখনও দেশভাগের পর নারায়ণগঞ্জে ফিরে এসেছিলেন এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। শেফালির মেজদি দেশভাগের পর কিছু সময় ছিলেন পিসির বাড়িতে পরে মেজদি-সহ পিসিরাও চলে যান কলকাতার সোদপুরে। জন্মশহরটা আছে, জন্মভিটার কোনও স্মৃতিচিহ্ন নেই।

অতীতের আলোয়: মিস শেফালি। ছবি: নিমাই ঘোষ

শহরটা বদলাচ্ছে। শহরটা বড় হচ্ছে। আরও বড় হবে। বৃদ্ধ হবে। কিন্তু শহরের ইতিকথায় লেখা থাকবে মিস শেফালির জন্ম শহর হিসেবে নারায়ণগঞ্জের নাম। মিস শেফালির কথা বলার টান-টোনে আজন্মই ছিল দ্যাশের টান। ছিল জন্মভূমির টান। মাটির জয় বুঝি এখানেই। মাটি নড়ে। মাটি নড়ে।

দ্যাশের বাড়ি-র অন্যান্য পর্ব …

পর্ব ২: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় শৈশবের স্মৃতির নন্দা দিঘি চিরতরে হারিয়ে গেছে হাজীগঞ্জ থেকে

পর্ব ১: যোগেন চৌধুরীর প্রথম দিকের ছবিতে যে মাছ-গাছ-মুখ– তা বাংলাদেশের ভিটেমাটির