শ্রীকৃষ্ণর চেয়েও বোধহয় বেশি নামে ভাত আর পায়েস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে, শুধু এই ভারত উপমহাদেশেই পায়েসকে অন্তত দশ রূপে দেখা যায়। সাধারণ চাল থেকে বাদামি বা কালো চাল– সব দিয়েই পায়েস বানানো হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে। কয়েকশো বছর আগেও লাতিন আমেরিকায় ভাত দামী খাবারের পর্যায়ে পড়ত, তাই সেখানে উদ্বৃত্ত ভাত বা বাসী ভাত ফেলে না দিয়ে তাই দিয়েও পায়েস বানিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
১৩.
ভাতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সেই আবহমানকাল থেকে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা খুঁজে বের করেছেন কিছু নিদর্শন, যা থেকে প্রমাণ মেলে ১২,০০০ বছর আগে থেকেই ধানের চাষ হত– এশীয়দের মূল খাবার ভাত সে কারণেই। আর এশিয়া থেকে ইউরোপ-আফ্রিকা, পরে ‘কলোম্বিয়ান বিনিময়’-এর ফলে আমেরিকায়। নিজের খাবার থেকে ঈশ্বরকে নিবেদনের ভোগে ভাত দেখতে পাই বিভিন্ন নামে আর বিভিন্ন রূপে। নবদ্বীপের মহাপ্রভু বাড়ি আমার কাছে মামার বাড়ির এক্সটেনশন ছিল, কারণ মামাদের সেখানে পালা পড়ত। সেখানে অবারিত দ্বার থাকার জন্য, ভোগ খাওয়াতেও কোনও আলাদা উত্তেজনা ছিল না, বরং এড়িয়ে চলতাম এক নিপীড়নের দুপুরের স্মৃতির জন্যে। তখন বয়স বছর বারো, এক দুপুরে সেখানে ভোগ খেতে বসেছি। যে পরিবেশন করছিল, তার কাছে ভাত চাইতে মা সজোরে একটা চিমটি কাটলেন। কোনও বড় গোলমাল করলে মা আমাকে কন্ট্রোল করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সবার চোখ এড়িয়ে এই অস্ত্র প্রয়োগ করতেন, তাই আমি ঘাবড়ে গেলাম। মা সেই লোকটাকে ডেকে আমাকে অন্ন দিতে বললেন। নিচু গলায় মা-কে দুটোর তফাত জিজ্ঞেস করতে মা গম্ভীরভাবে জানালেন ভাত সকড়ি, মন্দিরে তার প্রবেশ নেই। ভাত আর অন্ন-র তফাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। দেখি পাতে পোলাও দিয়ে চলে যাচ্ছে। আরও একটু পোলাও চাইতে আবার চিমটি। অবাক হয়ে মা-র দিকে তাকাতে মা জানালেন পোলাও মাংসের হয়, পল অর্থাৎ মাংস দিয়ে পোলাও হয়, মন্দিরে উচ্চারণ করতে নেই। ভোগে পুষ্পান্ন পরিবেশন করা হয়। শেষপাতে যখন পায়েস এল, আর রিস্ক না নিয়ে আঙুল দেখিয়ে মা-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটাকে কী বলে?’ মা জানালেন, পরমান্ন।
শ্রীকৃষ্ণর চেয়েও বোধহয় বেশি নামে ভাত আর পায়েস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে, শুধু এই ভারত উপমহাদেশেই পায়েসকে অন্তত দশ রূপে দেখা যায়। সাধারণ চাল থেকে বাদামি বা কালো চাল– সব দিয়েই পায়েস বানানো হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে। কয়েকশো বছর আগেও লাতিন আমেরিকায় ভাত দামী খাবারের পর্যায়ে পড়ত, তাই সেখানে উদ্বৃত্ত ভাত বা বাসি ভাত ফেলে না দিয়ে তাই দিয়েও পায়েস বানিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সাহেবরা যখন এই দেশে আসে, এখানকার খাবার দেখে তাদের আক্কেলগুড়ুম হলেও একটা খাবার দেখে তারা বেজায় অবাক হয়েছিল– তাদের পরিচিত রাইস পুডিং। ওদের দেশে তখনও চাল বেশ মহার্ঘ, তাই উচ্চবিত্তের হেঁশেলের অংশ ছিল, আর চালের পায়েস বা রাইস পুডিং এখানে পাওয়া যায় দেখে বেশ অবাক হয়েছিল, কারণ পুডিং ওদের হেঁশেলে দীর্ঘদিন ধরে পাওয়া গেলেও এই পদের সঙ্গে তাদের পরিচিতি তখন সদ্য হয়েছে। অষ্টম হেনরির আমলে তৈরি ফল আর বাদাম ছড়িয়ে খাওয়া এই পদের নাম তখন ‘ওয়াইট পট’– রাইস পুডিং নাম তখনও ব্যবহৃত হয়নি।
রোমান রাজত্বে পাতলা দুধে চাল ফুটিয়ে যে বিস্বাদ মিশ্রণ বড়লোকরা পেটের গোলমাল হলে খেত, সেটা কোনওভাবেই সাধারণ মানুষের রুচি আর সামর্থর মধ্যে ছিল না। পুডিং বলতে ইংরেজরা বাকিদের মতো ব্ল্যাক বা ব্লাড পুডিং বুঝত, যা স্বাদে নোনতা তৈরি হত। সেই পদের উল্লেখ তিন হাজার বছর আগে লেখা হোমারের ইউলিসিসে শুয়োরের অন্ত্রের মধ্যে রক্ত আর চর্বি পুড়ে আগুনে ঝলসে খাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। গ্রিকদের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই পদ পরে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে আর ক্রমে অ্যাংলো-স্যাক্সনদেরও প্রিয় খাবার হয়ে ওঠে। অ্যাংলো স্যাক্সনরা ব্ল্যাক পুডিং বানানোর পদ্ধতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে আরও সুস্বাদু বানানোর জন্য। শুয়োরের অন্ত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে, তাতে গোলমরিচ গুড়ো, জিরে, ময়দা আর মাখনের মিশ্রণ ভেতরে পুড়ে দীর্ঘ সময় জাঁক দিয়ে আগুনে ভাপিয়ে বানানো হত। শরৎকাল থেকে এই ব্ল্যাক পুডিং বানানো শুরু হত– এই পদ হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের পালাপার্বণের দিনের খাবার। তাই ওদের দেশে যে খাবারের দিকে জুলজুল করে চেয়ে থেকেছে আর জিভের জলে বুক ভেসেছে, সেই পায়েস (ওদের ভাষায় ‘রাইস পুডিং’) আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ঘরে পায়েস বানানোর ধুম দেখেই বোধহয় সাহেবরা ঠিক করেছিল এই দেশ দখল করতে হবে, এখানে মাটিতে সোনা ফলে!
দুর্গাপুজো-লক্ষ্মীপুজো আর কালীপুজো-জগদ্ধাত্রীপুজোর মাঝের এই পুণ্যলগ্নে মহামহিম পূজ্যপাদ তারাপদ রায় বর্ণিত দুই এলাকায় আলাদা নাম নিয়ে দৌরাত্ম দেখানো ষাঁড়কে সশ্রদ্ধচিত্তে প্রণাম জানিয়ে আর সবাইকে দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়ে পায়েসের গপ্প শেষ করা যাক– পরমান্ন খেতে হবে যে!