এই অনুষ্ঠানটা করার সময়ই একবার স্টেজে আগুন ধরে গেছিল। যিশুর জন্মের ঘরটা সরাতে গিয়ে আগুন লেগেছিল। রবীন্দ্র সদনে। আমি সেদিন স্ক্রিন ফেলিনি। এগরোশো জন সেদিন বসে দেখেছিল কীভাবে ওরা আগুন নিভিয়েছিল। আমি চেয়েছিলাম লোকে দেখুক। অজানাকে মানুষ ভয় পায়। আমি চাইনি কেউ ভয় পাক। আমি স্টেজে দাঁড়িয়েছিলাম গোটা সময়টা। আমার ছেলেরা সেদিন আগুন নিভিয়েছিল।
৭.
কাজী নজরুল ইসলামের ওপর একবার একটা নৃত্যানুষ্ঠান করেছিলাম, ‘গাহি সাম্যেরও গান’। এটার সংগীতায়োজন করেছিলেন কালিকাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। ওরা ভীষণ ভালোবাসত কালিকাকে। কালিকা ওদের সঙ্গে যেভাবে মিশেছিল, তা কখনও ভোলার নয়। শুধু রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে যিশুখ্রিস্টের ওপর আরও একটা অনুষ্ঠান করেছিলাম। সম্রাট অশোকের ওপরও একটা আয়োজন করেছিলাম। এই প্রত্যেকটা নৃত্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমি ওদের শেখাই, প্রতিটি আয়োজনই বার্তাবহ।
আমি খুবই আবেগপ্রবণ মানুষ। সত্যি বলতে, আমি বুদ্ধি দিয়ে চলি না। আর মাথা দিয়ে কাজ করলে এই কাজটা করতে পারতাম না হয়তো। কথায় বলে, যেটা তুমি দেবে, সেটাই পাবে। আমি আবেগ দিয়ে চলেছি বলে, আবেগটাই ফেরত পেয়েছি। ফেরত পেয়ে চলেছি আজও। ওরা যখন এই বার্তাবহ নৃত্যানুষ্ঠানগুলোর রিহার্সাল করে, দিনের পর দিন, অজান্তেই ওদের মধ্যে এই বার্তাগুলো প্রবেশ করতে থাকে। ওরা হয়তো কনশাস নয়, কিন্তু কথাগুলো গেঁথে যাচ্ছে ওদের মধ্যে। ওরা একটু একটু করে অনুভব করতে শুরু করে। ওরা ভাবতে থাকে। পুরোটাই অজান্তে।
একটা ছেলে একবার আমাকে বলেছিল, মা তুমি তো এগুলো আমাদের দিয়ে করাচ্ছ আমাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আমাদের খুব ভালো লাগছে। তখন ষিশুখ্রিস্টের রিহার্সাল চলছিল। বারবার ক্রস নিয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে পড়ে যাচ্ছে, ভারী তো! তখন বলছে, মা, তবে যিশুখ্রিস্টের মতো ভালো হতে পারব না। এত মার খেতে পারব না। এত মারলে উল্টে মেরে দেব। আমি তো হেসেই গড়িয়ে পড়ছি তখন। একই সঙ্গে বুঝতে পারছি যে, গোটাটা ওরা আত্মস্যাৎ করছে।
এই অনুষ্ঠানটা করার সময়ই একবার স্টেজে আগুন ধরে গেছিল। যিশুর জন্মের ঘরটা সরাতে গিয়ে আগুন লেগেছিল। রবীন্দ্র সদনে। আমি সেদিন স্ক্রিন ফেলিনি। এগরোশো জন সেদিন বসে দেখেছিল কীভাবে ওরা আগুন নিভিয়েছিল। আমি চেয়েছিলাম লোকে দেখুক। অজানাকে মানুষ ভয় পায়। আমি চাইনি কেউ ভয় পাক। আতঙ্ক ছড়াক। কিছু করা না গেলে তো অ্যানাউন্স করেই দেব। আমি স্টেজে দাঁড়িয়েছিলাম গোটা সময়টা। আমার ছেলেরা সেদিন আগুন নিভিয়েছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ একটু জল অবধি এগিয়ে দেয়নি। খালি পায়ে, খালি হাতে নিজেদের সঙ্গে থাকা জল দিয়ে ওরা আগুন নিভিয়েছিল। আগুন নিভিয়ে ওরা আবার পারফর্মও করেছিল। ওটা আমাদের একশোতম পারফরম্যান্স ছিল।
পরদিন আমি জেলে গেছি ওরা ঠিক আছে কি না জানতে। আমি তো দেখেছিলাম কীভাবে হাত দিয়ে পা দিয়ে ওরা আগুন নিভিয়েছিল। একটা ছেলের হাতটা পুড়ে গেছিল। আমি ওর হাতটা নিয়ে ওকে আদর করে দিচ্ছি, ছেলেটি আমাকে বলল, মা, কালকে আমি মন তৈরি করে ফেলেছিলাম। যদি আগুন সেভাবে জ্বলে যায়, নিজে পুড়ব, কিন্তু আগুন নেভাব। কাউকে পুড়তে দেব না। আমার এটা জানানোর আছে যে, কারও যদি প্রাণ নিয়ে থাকি, তাহলে প্রাণ বাঁচাতেও শিখেছি।
ওরা সবসময় প্রমাণ করতে চায় যে ওরা ভালও করতে পারে। সেজন্য সেদিন আগুনে পুড়ে যেতেও রাজি ছিল। আমি ভেঙে পড়েছিলাম সেদিন। সম্পূর্ণভাবে। আমি জানি না আমার মতো সুন্দর জীবন আর কেউ পেয়েছে কি না। আমার এখন ৭৩ বছর বয়স। জানি না কতদিন এই কাজটা করে যেতে পারব। কিন্তু ওরা যখন বলে, মা তুমি যদি পারো, আমরাও পারব। এই বয়সে এত এনার্জি আমাদের থাকবে কি? আমি তখন ওদের বলি, এই এনার্জিটা আমি তোমাদের থেকে পাই। তোমরা যদি এভাবে না থাকতে, আমি কি পারতাম? ইউ কিপ মি চার্জড।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved