মুখোমুখি আমরা দু’জন। আমার সামনে স্বয়ং এলাহাবাদের রাজা বাহাদুর, ভারতের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ। আরও কিছু ছবি মনের পর্দায় দ্রুত সরে গেল। মুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয়ে প্রধানমন্ত্রী। যদিও সামনাসামনি ততটা বাঘের মুখোমুখি হয়েছি বলে মনে হয়নি। আমাকে ফোন করে সুদর্শন নামক যে ভদ্রলোক এখানে আনিয়েছেন, তিনি কিন্তু ধারে-কাছে নেই, যা কিছু ফোনে। তিনি রাজনৈতিক দলের সুবাদে পরিচিত প্রিয়জন। আমি সরাসরি চলে এসেছি এবং সিকিউরিটি চেক, পুলিশি তল্লাশি সমস্ত পেরিয়ে ওঁর ঘরে। উনি আর আমি।
১৬.
অপ্রত্যাশিত এবং কল্পনার বাইরে কেউ আমাকে খুঁজছে। নয়ের দশকের গোড়ার কথা। আমি তখন উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ার পাশের অঞ্চল দত্তবাগানের শ্বশুরবাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছি। কলকাতায় সে সময় টেলিফোন তত সহজ নয়, নয় মোবাইলের যুগ। পাশের বাড়ি থেকে একটা ছেলে এসে বলল, আপনার ফোন, বম্বে থেকে। আশ্চর্য! প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। পাড়ার গলিতে একটি ছোট্ট বাড়ি, তাদের বাড়িতে ফোন আছে। আমি গেলাম। গিয়ে দেখলাম সত্যিই তো আমাকে খুঁজছে। ফোনে কিন্তু আমার চেনা-শোনা, মানে আমার অফিস বা অন্য কোনও কাজের ব্যাপারে কেউ ছিল না, একেবারেই অচেনা একজন মানুষ, নাম সুদর্শন। সুদর্শন আমাকে বললেন, আপনি কবে বম্বে ফিরছেন? আমি বললাম, দিন চারেক পরে। কেন? বললেন, মিস্টার ভি পি সিং আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। ভি. পি. সিং? ভি. পি. সিং, মানে আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। মনে হল রং নাম্বার অথবা শ্বশুরবাড়ি পাড়া থেকেই চ্যাংড়া ছেলেদের পিছনে লাগা। কিন্তু ও-প্রান্তে যিনি কথা বলছেন, তিনি তো ভারী গলায় পরিষ্কার হিন্দিতে কথা বলছেন, কলকাতার মানুষদের হিন্দির মতো নয়। উনি বললেন যে, আপনার জলরঙের কাজ ওঁর খুব পছন্দ আর উনি অবসরে ছবি আঁকেন। বম্বেতে কিছুদিন থাকবেন, আপনার কাছে জলরঙে আঁকা শিখতে চান। বাবা! অবাক হলাম, কোথা থেকে খুঁজে খুঁজে কোথায় এসে যোগাযোগ। পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, মন্ত্রী– এঁদের কাছে কোথাও কাউকে খুঁজে বের করাটা একেবারেই কঠিন কাজ নয়। এ আবার প্রধানমন্ত্রী বলে কথা। কিন্তু আমার কাছে ছবি আঁকা শিখবেন! মাথাটা অনেকক্ষণ ভারি হয়ে রইল। আবার মনে হল এমন একজনের সঙ্গে দেখা করার একটা সুযোগও বটে।
জীবনে প্রথম রাজভবনে প্রবেশ করলাম। কলকাতায় অনেকবার রাজভবনের গেটের সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেছি। বেঙ্গালুরুর রাজভবনের আশপাশে ঘুরেছি। কাছ থেকে রাজ্যপাল দেখেছি, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এর অ্যানুয়াল এগজিবিশনের উদ্বোধনে আসতেন। রাজভবনের মধ্যে ঢোকা হয়নি কখনও। মুম্বইয়ের রাজভবন মেরিন ড্রাইভের পাশে মালাবার হিলের মধ্যে, সমুদ্রের ধারে। মেরিন ড্রাইভ শেষ করে বাঁদিকে মালাবার হিলে ওঠার শুরুতে ওয়ালকেশ্বরে। রাজভবনের গেটে আমার নাম লেখানো ছিল। গেট পেরিয়ে ডানদিকে সিকিউরিটির অফিস। এরপর লম্বা একখণ্ড জমি সোজা চলে গিয়ে একেবারে আরব সাগরে ঢুকে গেছে যেন গাড়ি পার্কিং, অফিস-কাছারি, বাড়ি-ঘর-বাগান সমেত। রাস্তায় এদিকে-ওদিকে ময়ূর ঘুরে বেড়ায়, রাজভবন বলে কথা। একেবারে শেষ প্রান্তে সমুদ্রের ধারে সরকারি কাজে আসা বিশেষ অতিথিদের জন্য গেস্ট হাউস। ভেতরে পাঁচতারা হোটেলের মতো নয়, আবার রাজার বাড়ির মতোও নয়, ছিমছাম পরিচ্ছন্ন একটি স্যুট। বড় করে হলঘর, বসার এবং মিটিং করা যায় এমন। ছোট কাজের ঘর, বেডরুম আর ডাইনিং রুম। ছোট করে আরেকটি রুম দরজা দিয়ে ঢুকেই, সেটা সুরক্ষা বাহিনীর লোকজনদের চব্বিশ ঘণ্টা থাকার ব্যবস্থা।
……………………………………………………………
এমনি করে ডে টু, ডে থ্রি করতে করতে প্রায় পাঁচ-ছ’-বছর ধরে অনিয়মিত আমরা মিলিত হয়েছি। শুধু ছবি আঁকার কারণে নয়, কখনও ছবি দেখা, প্রদর্শনীতে যাওয়া এমনকী, ছোটখাটো বেড়ানো এবং পিকনিক পর্যন্ত। আর ছিল নানা গল্প। ওঁর গল্পের শেষ নেই, আমারও। রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিয়েছেন। শরীরটা ভালো নেই। মূলত চিকিৎসার কারণেই উনি মুম্বইয়ে আসেন মাঝে মাঝে এবং থেকে যান দু’-তিন সপ্তাহ একটানা। কখনও একা, কখনও সহধর্মিনী সীতা দেবীও আসেন সঙ্গ দিতে। সীতা দেবী থাকলে একেবারে ঘরের মতো নিজের হাতে চা করে খাওয়ান, আবার বেশ একা একা উল বোনেন, একেবারে আমাদের চেনা ছবির মতো।
…………………………………………………………..
মুখোমুখি আমরা দু’জন। আমার সামনে স্বয়ং এলাহাবাদের রাজা বাহাদুর, ভারতের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ। আরও কিছু ছবি মনের পর্দায় দ্রুত সরে গেল। মুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয়ে প্রধানমন্ত্রী। যদিও সামনাসামনি ততটা বাঘের মুখোমুখি হয়েছি বলে মনে হয়নি। আমাকে ফোন করে সুদর্শন নামক যে ভদ্রলোক এখানে আনিয়েছেন, তিনি কিন্তু ধারে-কাছে নেই, যা কিছু ফোনে। তিনি রাজনৈতিক দলের সুবাদে পরিচিত প্রিয়জন। আমি সরাসরি চলে এসেছি এবং সিকিউরিটি চেক, পুলিশি তল্লাশি সমস্ত পেরিয়ে ওঁর ঘরে। উনি আর আমি। হাসি হাসি মুখে হাত জোড় করে নমস্কার করলেন, আমিও প্রতি-নমস্কার। বসলাম। দেখলাম সময়ের ব্যবহার এখানে বেশ মেপে মেপে। অন্তত তাই মনে হল শুরুতে ঘরের পরিবেশ দেখে। মেঝেতে একটা আসন পেতে জলরঙের কাজ করার আয়োজনটা করাই রয়েছে। বোর্ডে পিন দিয়ে কাগজ আটকানো, পাশে জলরঙের রং তুলি এবং দুটো বাটি, কাজের জলপাত্র। মনে হল, যেন বসে আঁকো প্রতিযোগিতা কিংবা যেন ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। হ্যাঁ, তবে ইন্টারভিউ কে কাকে নিচ্ছে– সেটা মাথায় ঢুকছে না। খুব সহজ করেই একটি ল্যান্ডস্কেপ করলাম। কাজের ফাঁকে ঘোলা জল, মানে তুলি ধোঁয়া নোংরা জলের ছোট্ট বাটিটা উনি নিজেই বারবার বেসিনে গিয়ে পরিষ্কার করে আনছেন, আমাকে আসন ছেড়ে উঠতে দিচ্ছেন না। খুবই অসোয়াস্তির ব্যাপার। উত্তরপ্রদেশীয় ভদ্রতা? রাজা বাহাদুর আর রং বাহাদুর গুলিয়ে যেতে লাগল। পরে জেনেছিলাম, আমরা দু’জনেই সেদিন নাকি নার্ভাস ছিলাম। এই ছিল আমাদের ‘ডে ওয়ান’।
এমনি করে ডে টু, ডে থ্রি করতে করতে প্রায় পাঁচ-ছ’-বছর ধরে অনিয়মিত আমরা মিলিত হয়েছি। শুধু ছবি আঁকার কারণে নয়, কখনও ছবি দেখা, প্রদর্শনীতে যাওয়া এমনকী, ছোটখাটো বেড়ানো এবং পিকনিক পর্যন্ত। আর ছিল নানা গল্প। ওঁর গল্পের শেষ নেই, আমারও। রাজনীতি থেকে সন্ন্যাস নিয়েছেন। শরীরটা ভালো নেই। মূলত চিকিৎসার কারণেই উনি মুম্বইয়ে আসেন মাঝে মাঝে এবং থেকে যান দু’-তিন সপ্তাহ একটানা। কখনও একা, কখনও সহধর্মিনী সীতা দেবীও আসেন সঙ্গ দিতে। সীতা দেবী থাকলে একেবারে ঘরের মতো নিজের হাতে চা করে খাওয়ান, আবার বেশ একা একা উল বোনেন, একেবারে আমাদের চেনা ছবির মতো। চিকিৎসার ব্যাপারে তো আসতেন দিল্লি থেকে, কিন্তু চিকিৎসা নিয়ে কি মনে মনে খুব খুশি থাকতেন? আমাদের মতো ছাপোষা মধ্যবিত্ত মনোবৃত্তির মানুষের মতো সন্দেহবাতিক আচরণ করতে দেখেছি ওঁকে। একবার উনি ব্রিচ ক্যান্ডি, বম্বে হসপিটাল, যশলোক এবং হিন্দুজা হসপিটাল থেকে একই রক্তপরীক্ষা চারবার করালেন। চার জায়গা থেকে চার রকম রেজাল্ট এল, সেই নিয়ে হাসিঠাট্টা হল খানিক। এমনি করে আমাদের মধ্যে ব্যবধান কমে আসতে থাকল। বুঝলাম, আমরা দু’জন রক্ত-মাংসের মানুষ। আমি ওঁকে ‘রাজাসাহেব’ বলে ডাকতাম আর উনি আমাকে ডাকতেন ‘গুরুজি’ বলে। সামাজিক মর্যাদার সীমারেখা মুছে যেতে থাকল ধীরে ধীরে।
মনে পড়ছে, শুরুর দিকে প্রথম যেদিন আমরা রাজভবন থেকে বাইরে গেলাম, সেদিনের কথা। একটা ছবির প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম দু’জনে মুম্বইয়ের তাজমহল হোটেলের মধ্যেকার একটা গ্যালারিতে। তাজ আর্ট গ্যালারি। রাজভবন থেকে বেরিয়ে কোনও গন্তব্যে পৌঁছনোর ব্যাপারটা অদ্ভুত, আমার কাছে নতুন ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রীর কনভয়। আর সেই রাজকীয় সফরে কোন এক ভিআইপি গাড়িতে বসে আছি আমি, সে এক শিহরণ! তাজমহল হোটেল, গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার কাছে। পৌঁছে আমরা কিন্তু মেইন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম না। বিল্ডিংয়ের পাশে আর একটা গেটের সামনে গাড়ি দাঁড়াল। আমি ছিলাম অন্য গাড়িতে। উনি প্রথমে ঢুকে গেলেন। পরে অন্য গাড়িতে ওঁর সঙ্গে আর যাঁরা আছেন, তাঁরা নামলেন। গেটে ঢুকতে একটা ছোট্ট ভিড় আর প্রচুর পরিমাণে পুলিশের ব্যবস্থা আগে থেকেই আছে। একটা অবাক করা কাণ্ড ঘটল! আমি গেটের মধ্যে ঢোকার মুখে ভিড়ে আটকে আছি। দূরে ভেতরে দেখলাম রাজাসাহেব, ফিরে আসছেন। ফিরে এসে আমাকে ইঙ্গিতে ‘আসুন আমার সঙ্গে’ বললেন। সিকিউরিটির লোক বুঝে গেল। ওঁর সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলাম ভিতরে। যাওয়ার সময় হাঁটতে হাঁটতে আমার প্রায় কানে কানে বললেন, আমি জানতাম ওরা আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে দেয়নি এবং গেটে আটকেও দিতে পারে, ঢুকতে না-ও দিতে পারে। বাইরে ওঁর সঙ্গে যাওয়ার সময় আগে থেকেই উনি কোথায় যাবেন কে কে সঙ্গে থাকবে, তার লিস্ট করা থাকত। থাকলেও ওঁকে যতটা সতর্কতার সঙ্গে ঠিকমতো পৌঁছে দিত, ততটা অন্যান্য সঙ্গীর বেলায় ঠিক নিয়মে সবসময় হত না। পরে অবশ্য ওঁর স্পেশাল পার্সোনাল গার্ড আমাকে চিনতেন এবং তিনিও আমাকে ‘গুরুজি’ বলেই ডাকতেন।
শিল্পপতি এবং বণিক শ্রেণির মানুষ সর্বক্ষণ রাজনৈতিক দলের অথবা পদাধিকারবলে শক্তিশালী মানুষদের তোয়াজ করতে চান। আর.পি.জি. গ্রুপের চেয়ারম্যান হর্ষবর্ধন গোয়েঙ্কা একবার তাঁদের কালেকশনের অনেক শিল্পকর্ম ওরলির হেড অফিসে সাজিয়ে সবাইকে দেখাচ্ছিলেন। আমন্ত্রিত রাজাসাহেব। ছবি আঁকার সূত্রে হর্ষ গোয়েঙ্কার সঙ্গে আমাদেরও ভালো সম্পর্ক। গেলাম দু’জনে। কাজের শেষে ওঁর জন্য কিছু জলখাবারের আয়োজন করা হয়েছে। মিস্টার গোয়েঙ্কা আমাকে বললেন, গুরুজি একটু ম্যানেজ করুন। বাঙালিদের মতোই পরিষ্কার বাংলা বলেন, কলকাতায় পড়াশোনা। একটা নতুন ফ্যাসাদ হয়েছে। জনসমক্ষে ঘনঘন রাজাসাহেব সোচ্চারে বলেন, গুরুজি কোথায়? এই যে গুরুজি, তাহলে এবারে বেরনো যাক? কিংবা আর কিছু করার আছে? আপনার তো বাড়ি যাওয়ার আছে ইত্যাদি। পাশের ঘরে চায়ের ব্যবস্থা। সেখানে ঢুকে যথারীতি খাদ্য নিরাপত্তার সিকিউরিটি সিস্টেমের মধ্য দিয়ে গিয়েই তবে সেই চা এবং স্ন্যাক্স। একটু টুকিটাকি গল্প গুজব শেষ না হতেই ওঁর স্পেশাল গার্ডও আমাকে আলাদা করে ডেকে কানে কানে কখনও বলেন, গুরুজি অনেক সময় হয়ে গেছে এবার যেতে হবে, একটু ম্যানেজ করুন। ওস্তাদজি, পণ্ডিতজির মতো আমার নতুন ডাকনাম, গুরুজি।
গিয়েছিলাম পিকনিকে একবার। বাগান সমেত প্রশস্ত বাড়ি মুম্বইয়ের শহরতলিতে। একটা ঘরের মেঝেতে থেবড়ে বসে খানিক ছবি আঁকাও হল। মাঝে মাঝে খাওয়া-দাওয়া, বাইরে ছোট্ট একটা জলাশয় তার পাশে বসে আড্ডা সারাটা দিন। আর একবার বিয়েবাড়িতেও গিয়েছিলাম। অনেক লোকজন সমেত বিয়েবাড়িতে খাবার নেমন্তন্ন। আলাদা সিকিউরিটির কথা বলতে হয় এ বিয়েবাড়ির ব্যাপারে। দুটো জিনিস কিন্তু নজরে আছে সর্বক্ষণ। এক, কেউ যদি ওঁকে কোনও ফুলের স্তবক দিয়ে সংবর্ধনা জানাতে চায় বা স্বাগত জানাতে চায় তাহলে ফুলটা সরাসরি ওঁর হাতে সব সময় দেওয়া যায় না। ফুলটা নেবে বডিগার্ডদের কেউ একজন। খাওয়ার সময় যে খাবার দেওয়া হবে, আগে থেকে তা আলাদা পাত্রে তুলে সিকিউরিটির লোকরা টেস্ট করে দেখবে, তারপর ওদের নজরদারিতেই সেই চেক করা পাত্রগুলোই ঠিক ঠিক খাবারের সময় ওঁর টেবিলে যাচ্ছে কি না, সেগুলো খুব সাবধানে নজরে রাখা হয়। তাছাড়া চিকিৎসার জন্য সবরকম খাবারের অনুমোদনও থাকত না।
উনি আসতেন আমার আমন্ত্রণেও। মুম্বইয়ের জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারিতে আমার এটা বড়সড় প্রদর্শনীতে এসেছিলেন। আবার দিল্লিতে ডিসেম্বরের একেবারে শেষে কনকনে ঠান্ডায়, ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টারে আমার একক প্রদর্শনী, উনি এসেছিলেন সেখানেও। এসেছিলেন পরিবারের লোকজন সমেত, খুব ঘরোয়াভাবে, একেবারে আপনজনের মতো। আমার স্ত্রী মধুমিতা, এমনকী, আমাদের ছেলেমেয়েদেরও চিনতেন। ওই সময়ের মধ্যে বিদেশে গিয়েছেন কয়েকবার। যখনই বাইরে যেতেন আমার জন্য হয় একটু রং না হলে কোনও ছোটখাটো স্যুভেনির আনতেন মনে করে। কোনও কোনও রঙে অ্যালার্জি ছিল ওঁর। একবার আমার জন্য এনেছিলেন, জলরঙে ছবি আঁকি বলে, জল মেশানো তেলরং। উইনসর অ্যান্ড নিউটন কোম্পানির ওয়াটার মিক্সেবল অয়েল পেইন্ট।
ঘরের মধ্যে ছবি আঁকা শেখানো যত, তার চেয়েও বেশি ছবি নিয়ে কথাবার্তা হত। আসলে ছবি আঁকার চেয়ে বড় কথা এমনই একটা পরিবেশের মধ্যে উনি রাজনীতির বাইরে থাকতে চাইতেন। কবিতা লিখতেন। ফোটোগ্রাফি করতেন খুব ভালো। ওঁর উর্দু কবিতার বইও এখান থেকেই ছাপা হয়েছিল, যার প্রচ্ছদ আমার। অন্যান্য নামকরা পত্রিকার প্রচ্ছদেও আঁকছি তখন রাজাসাহেবের মুখ। সব মিলিয়ে মজার পরিবেশ। পুরনো ছবি নিয়ে আলোচনা, এমনকী, দিল্লিতে থাকাকালীন যেসব ছবি আঁকতেন সেগুলোও বয়ে আনতেন মুম্বইতে আমাকে দেখানোর জন্য। সেগুলোর ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা হত। এমনও হয়েছে আমি অন্য কোথাও আঁকছি, সেটাও উনি দেখতে যেতেন। একটা ওয়ার্কশপে আমি হাতে-কলমে কাজ করে দেখাচ্ছিলাম একবার। মুম্বইয়ের সেঞ্চুরি বাজারে বিড়লা আর্ট গ্যালারিতে ওয়ার্কশপ এবং জলরঙে ছবি আঁকার ডেমোনস্ট্রেশন। উনি সেখানে এসেছিলেন এবং সবার সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে মিশে পুরো সময়টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন।
রাজাসাহেবের সঙ্গে যত জায়গায় কোথাও গিয়েছি, তার মধ্যে সবচেয়ে মজার অংশটাই হচ্ছে সফর। খুবই উপভোগ করতাম সেই রয়্যাল জার্নি। কোন পথে, কোন দিকে যেতে হবে– সেটা আমাদেরও যেমন একেবারেই জানার বাইরে, রাজাসাহেবের নিজেরও কোনও অধিকার নেই সেখানে নাক গলানোর। কে কোন গাড়িতে উঠবে, উনি কোন গাড়িতে উঠবেন, সেটাও নিজে ঠিক করতে পারবেন না। ঘর থেকে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গে ওকে কোন এসকর্ট নিয়ে যাবে গাড়ি পর্যন্ত। এই সময়ের কাজটা সর্বক্ষণই খুব দ্রুততার সঙ্গে করা হবে। আসুন আসুন করে একজন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, আগে থেকে আর একজন একটি গাড়ির দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা, দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে সেটা বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি কাজগুলোর সমস্তটাই সিকিউরিটির লোকজন নিখুঁতভাবে করে। ঠিক কোন গাড়িতে উনি উঠবেন এমনকী কোন দরজা দিয়ে গাড়ির মধ্যে ঢুকবেন তার নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ ওদের হাতে। যাওয়ার সময় যে গাড়িতে উনি উঠলেন আসার সময় ঠিক সেই গাড়িতেই ফিরবেন তার একেবারেই নিশ্চয়তা নেই। দরজা বন্ধ হওয়ার পরমুহূর্তে যাত্রা শুরু। একেবারে সামনে সাইরেন বাজিয়ে গাড়ি, দু’পাশে দুটো মোটরবাইককে আমার সবসময় রাজার শোভাযাত্রার হাতি-ঘোড়া মনে হত। পরপর অনেকগুলো একই রকম দেখতে এক রঙা গাড়ি, তার পিছনে আরও গাড়ি অন্য রঙের, তার পরে পুলিশ ভ্যান অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি। সময় এবং জায়গা বুঝে নতুন নতুন সিকিউরিটি ডিজাইন। পুরো কম্পোজিশনটা আমার কাছে একটা ঝড়ের মতো মনে হত। দারুণ উত্তেজনা। কখনও কখনও ভয়ও করত, মনে হত সার্কাসের জ্বলন্ত রিঙের মধ্যে দিয়ে লাফিয়ে চলে যাওয়া, একটু এদিক-ওদিক হলেই আগুন জ্বলে যেতে পারে।
‘জ্বালাতন’ শব্দটাও কিন্তু বড় মাপের মানুষদের সঙ্গে সঙ্গেই চলে। এই নিয়ে ওঁর সঙ্গে সহজ সরল রঙ্গ রসিকতা, ঠাট্টা, তামাশাও মাঝে মাঝে হত। ছোটবেলার বন্ধুরা আপনাকে কখনও জ্বালাতন করে না? অ্যাই, তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস, আমার জন্য এটা করে দে, সেটা করে দে। বলে না এরকম? উনি বললেন সে তো করে বটেই। একটা গল্প শোনাই। আমার এক ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু, তার অবস্থা খুব খারাপ। তাদের গ্রামে গেছি অফিসিয়াল কাজে, আমাকে বলল যে তুই আমাকে একটা ব্যাঙ্ক লোন পাইয়ে দে আমি ছাগলের ব্যবসা করব। দিয়েছিলাম একটা ব্যবস্থা করে। পরের বারে যখন গেছি সে এসে হাউমাউ করে কাঁদছে। বলল, জানিস ছাগলের ব্যবসা করেছিলাম, কিন্তু সব ছাগল কী একটা অসুখে মারা গেল। এই দ্যাখ তুই বিশ্বাস করবি না বলে আমি এটা রেখে দিয়েছি। দেখলাম, বাঁশের খুঁটির গায়ে ছোট্ট ছোট্ট দুটো ছাগলের লেজ কেটে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে দিয়েছে।
বন্ধুরা নানারকম অদ্ভুত আবদার করে। ওঁকে বলে পার্লামেন্ট দেখতে যাব। কেউ বলল পার্লামেন্টের ক্যান্টিনে খাব, কেউ বলল বাবু জগজীবনরামের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে, হ্যান্ডশেক করব। এইরকম আবদারের লম্বা লিস্ট। আমার জানতে ইচ্ছে করেছিল, আচ্ছা এই যে বিভিন্ন জায়গায় যান, রাস্তাঘাট সাজিয়ে, আপনাকে খুশি করার জন্য দেওয়াল পাঁচিল রং করে আহ্বান জানানোর যে ব্যবস্থা করে, নানা রকমের নাটক করে, কান্নাকাটি করে, সেসবের মধ্যে আচরণে যে মিথ্যে থাকে সেগুলো আপনি বুঝতে পারেন? উনি বললেন, নিশ্চয়ই। খুব সোজা, কারণ আমি তো জন্মেই প্রধানমন্ত্রী হইনি। আমরাও ওইসব করেই এখানে এসে পৌঁছেছি।
প্রশ্ন হল, এত যে আঁকাআঁকি, তা ছবিগুলোর কী হল? সবশেষে হল সেই আসল কাজটা। রাজাসাহেবের ছবির প্রদর্শনী। মুম্বইয়ের বিখ্যাত জাহাঙ্গির আর্ট গ্যালারিতে বিশাল বড় মাপের প্রদর্শনী হয়েছিল। চিরকালই আমাদের প্রদর্শনীর উদ্বোধন করার জন্য, নিজেরা ধন্য হওয়ার জন্য বিখ্যাত মানুষ, মহান ব্যক্তির সান্নিধ্য চেয়েছি। উল্টো কাজটা হল এখানে। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের প্রদর্শনী প্রদীপ জ্বেলে উদ্বোধন করার সম্মান জুটল আমার কপালে। সঙ্গে সেদিন বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে মুম্বইয়ের বিশেষ শিল্পীরাও ছিলেন। উনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ামে কাজ করেছেন এবং মুম্বই, দিল্লির অন্যান্য শিল্পীদের কাছ থেকেও সাহায্য নিয়েছেন। বিভিন্ন মিডিয়ামে কাজের এই বিশাল প্রদর্শনী দিল্লিতেও মহাসমারোহে করা হয়েছিল।
শেষ করার আগে একটা মধ্যাহ্নভোজের গল্প আছে। সেদিন ডাইনিং হলে আমরা দু’জন। আমাদের খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে খাকি পোশাকে সিকিউরিটির লোক। পাশাপাশি দুটো চেয়ারে আমরা। সামনে খাবার সাজানো, থালাতে-বাটিতে। রাজাসাহেব যে কান্ডটি করলেন, তাতে চার্লি চ্যাপলিনের ছবির একটা দৃশ্য মনে পড়ছে, যেখানে বরফে আটকে পড়া ঘরের মধ্যে খাদ্যের অভাবে শেষে জুতো সেদ্ধ করে চার্লি তার বন্ধুর সঙ্গে খাচ্ছিলেন। জুতো, কিন্তু কোন অংশটা যে ভালো খেতে সেটা বুঝতে না পেরে প্লেটটা বারবারই বন্ধুর অজ্ঞাতে বদল করে নিচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন বন্ধুর অংশটাই বেশি ভালো হবে। এখানে ঠিক সেই কায়দায় আমার পাশের জন আমার সঙ্গে থালা বদল করে নিলেন আমার সামনেই। আমি খুব অবাক হলাম। চার্লি যেটা ভালো মনে করছিলেন, সেটা নিচ্ছিলেন। এখানে ইনি এটা করলেন অন্য কারণে। আমার খাবারটা নাকি কম, আমার খাবারে নাকি চিকেনের সাইজটা অনেক ছোট, তাই উনি বদলে নিলেন থালা। বললেন, আমাকে সব সময় ওরা যত্ন দেখাতে চায়। সে আন্তরিকতার কথা কখনও ভুলব না। ঠিক যেমন কেউ স্নেহভাজনকে ভালোটা, বড়টা খাওয়াতে চান, তেমন আচরণ। আমাদের কোনও সাক্ষী নেই, সেদিন দুপুরে খাওয়ার টেবিলে শুধুমাত্র আমরা দু’জন।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল
শেষের দিকে তাঁর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন তাঁর মেয়ে শিষ্যরা—শান্তি হিরানন্দ, অঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়, রীতা গাঙ্গুলি। সকলেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন, বেগম আখতার তাঁদের মাতৃসম স্নেহে মুড়ে রেখেছিলেন। এ মাতৃত্ব তাঁর ওপর কেউ চাপিয়ে দেয়নি। এ মাতৃত্ব তিনিই বেছে নিয়ে হতে পেরেছিলেন শিষ্যদের প্রিয় ‘আম্মি’।
বীরভূমের লেখক-গবেষকেরা মনে করেন, বীরভূমের লাভপুরের কাছে দেবী ফুল্লরাতেই সেই পীঠের অধিষ্ঠান আবার বর্ধমানের গবেষকেরা দাবি করেন, ঈশানী নদীর বাঁকে বর্ধমানের দক্ষিণডিহিতেই দেবীর ওষ্ঠপাত ঘটেছিল। তবে ভক্তদের কাছে দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র এবং অলৌকিক শক্তি দুই জায়গাতেই বর্তমান।