একটা মানুষ, দুটো নাম। অফিসে অমিতাভ ঘোষ, কলেজ স্ট্রিটে সিদ্ধার্থ ঘোষ। যাদবপুর থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে বিড়লা মিউজিয়ামে কাজ করে, কিন্তু মন পড়ে থাকে সবসময়ই অফিসের বাইরে। কল্পবিজ্ঞানের জগতে বেশ জনপ্রিয় লেখক, সিদ্ধার্থ ঘোষ ছদ্মনামে। সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক। ছাপাখানা, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা এবং পুরনো কলকাতার কারিগরি ইতিহাসের ওপর ওর অনেক কাজ।
১৮.
‘চাঁদ’ ব্যাপারটা তখন বাজারে বেশ গরম। নীল আর্মস্ট্রং সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে হিরো। আমরা তখন ওই চাঁদের মাটিতে মানুষের পায়ের ছাপ নিয়েই পোস্টার ইত্যাদি করে বাজার গরম করছি। বিড়লা মিউজিয়াম তখন আমার কর্মস্থল। আমাদের বিজ্ঞান প্রদর্শনীতে আমেরিকা থেকে মহাকাশচারীরা উড়ে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন জ্যান্ত। ডিসপ্লের কাঁচের বাক্সে সত্যিকারের চাঁদের মাটি। কিন্তু ভাবতে গিয়ে কেঁপে যাচ্ছি, সত্যিকারের চাঁদমামা বলে যাকে জানতাম, সেটা একটি বিশাল বস্তুপিণ্ড! যে জিনিস কল্পনার, সেটাতে পা রাখা যায়! সেখানে গিয়ে কেউ হেঁটে বেড়িয়েছে চাঁদের মাটিতে! আজ হলে যে কেউ বলবে– তো? ভাবখানা যেন, দুর্গাপুর এয়ারপোর্টে চাপলাম, চাঁদে গিয়ে নামলাম। অনুভূতি-টুতি আসলে আপেক্ষিক।
বিজ্ঞানের বন্ধু সিদ্ধার্থ ঘোষ বলল, “চলো আমরা দু’জনে চাঁদে যাই। তুমি সেখানে গিয়ে ছবি আঁকবে, নতুন ল্যান্ডস্কেপ।’ চাঁদের ল্যান্ডস্কেপ? আসলে চাঁদের তখনকার খানাখন্দ, বিশাল বড়-ছোট পুরনো ক্রেটার, তার ধুলোবালি মাটি, সবই আমাদের কাছে জলভাত। চাঁদে জল আছে কিংবা জল ছিল। বরফ আছে শুনছি, চাষ করা যায় কি না, এ সমস্ত আমাদের নখদর্পণে, হাতের মুঠোয়, কাজের টেবিলে। তাই বলে সত্যিকারের চাঁদে গিয়ে কি ছবি আঁকা যাবে? কীরকম হবে আবহাওয়া তেমন কিছুই তো ঠিক জানি না। আর্ট কলেজে মাস্টারমশাই গোপাল ঘোষ বলতেন, ‘রোদে গিয়ে বসো, গরমটাকে বোঝো, তারপরে ঝলমলে রোদের ছবি আঁকো।’ এখন সে কথাই মনে হচ্ছে। চাঁদে রোদ, মানে সে কত গরম? পুড়ে তো ছাই হয়ে যাব। রাতের অন্ধকারে জমে বরফ। শুনেছি, চাঁদের দিন রাত সে আমাদের ২৪ ঘণ্টার মতো নয়, তার এক দিন এক রাত হতেই মাসখানেকের মতো লেগে যায় আমাদের এখানকার সময়ে। যত মহাকাশচারী চাঁদে গেছে তারা সব গুনে গেঁথে, হিসেব করে ওই চাঁদের ভোরের দিকেই নেমেছে শুনেছি।
সিদ্ধার্থ ঘোষের সঙ্গে আমার এই চাঁদে যাওয়ার প্ল্যানটা হচ্ছে বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামে বসে। কখনও ওর অফিসের টেবিলে, কখনও আমার টেবিলে, আবার কোনওদিন অফিসের ক্যান্টিনে। আমরা দু’জনেই ওই সময় বিড়লা মিউজিয়ামে কাজ করতাম। চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারটায় আমি ইতস্তত করলেও সিদ্ধার্থ নাছোড়বান্দা। ও বলল, ‘ভাবো, ভাবো একটু সিরিয়াসলি ভাবো। রাতে স্বপ্ন-টপ্ন দ্যাখো একটু বেশি করে। ঠান্ডা গরমের চেয়ে নিস্তব্ধতা, ঘুটঘুটে অন্ধকার, হাত চালাতে গেলে হাতটাকে হালকা মনে হচ্ছে, ছবির লাইনগুলো, রং তুলি কীভাবে ভীষণ ধীরে ধীরে নড়বে– এসবগুলোর ওপর একটু জোর দাও।’ পরে ওর মতলবটা যখন শুনলাম তখন বুঝলাম যে, ও যাবে না, আমাকে একা চাঁদে পাঠাবে। আসলে চাঁদ নিয়ে প্রদর্শনীর সময়েই কল্পবিজ্ঞানের গল্প ওর মাথায়। একজন শিল্পী যদি একা একা চাঁদে গিয়ে ছবি আঁকে তাহলে কেমন হয় এটাই প্লট। আমাকে খেটেখুটে তারই রসদ সরবরাহ করতে হবে ওকে। এমন আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে পরেও। যেমন ‘গ্যাবনে বিস্ফোরণ’ লেখার বেলায় মহারাষ্ট্রের লোনার ক্রেটারের ছবি দেখে কীভাবে বিশাল ক্রেটারের কল্পনা এবং ছবি আঁকার কাজটা করা যায়, তা ভাববার কাজ দিয়েছিল। ঝন্টু মামার গল্প সিরিজের মধ্যেও নানা রকম মেশিন, যন্ত্রপাতি, লেখা শুরুর আগে আঁকা। গায়ককে মঞ্চে শায়েস্তা করতে কিংবা নাক ডাকার আওয়াজ শুনে তাকে ঘুম ভাঙিয়ে দেবে এমন মেশিন- টেশিন, লেখা শুরুর আগেই আমাকে আঁকতে হুকুম করত।
একটা মানুষ, দুটো নাম। অফিসে অমিতাভ ঘোষ, কলেজ স্ট্রিটে সিদ্ধার্থ ঘোষ। যাদবপুর থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে বিড়লা মিউজিয়ামে কাজ করে, কিন্তু মন পড়ে থাকে সবসময়ই অফিসের বাইরে। কল্পবিজ্ঞানের জগতে বেশ জনপ্রিয় লেখক, সিদ্ধার্থ ঘোষ ছদ্মনামে। সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক। ছাপাখানা, ফটোগ্রাফি, চিত্রকলা এবং পুরনো কলকাতার কারিগরি ইতিহাসের ওপর ওর অনেক কাজ। ও যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনার জগতের কবি।
সিদ্ধার্থর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর অফিসের কাজটা একেবারে পাল্টে গেল। সরকারি চাকরির ব্যাপারটা গেল একেবারে উল্টে। বিড়লা মিউজিয়ামে সময় কাটতে থাকল হু হু করে। ওকে সঙ্গ দিচ্ছি আমি, আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে ও। সাহিত্যের ব্যাপারে আমিও যেমন নতুন এবং ওর খুঁটিনাটি ব্যাপারে এগিয়ে যাচ্ছি, তেমনই আমার ছবি আঁকার ব্যাপারেও ওর সাহায্য নিচ্ছি। আমার ইংরেজিতে ভয়, লিখতে পারতাম না, বলতেও পারতাম না। একজন আমেরিকান দর্শক অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ আমার একটা ছবি কিনলেন। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান, কিন্তু আমি ইংরেজি বলতে পারি না! তাকে আমার অফিসে আসতে বললাম এবং সিদ্ধার্থ দোভাষির কাজটা করেছিল। এছাড়া দেশের অন্য জায়গাতেও ছবির ব্যাপারে আমার সম্বন্ধে কিছু লিখতে হলে কিংবা ইংরেজিতে লেখা চিঠির উত্তর দিতে হলে কাজটা সিদ্ধার্থ অনায়াসে করে দিত। অফিসের বার্ষিক কালচারাল প্রোগ্রামে নাটকও করতাম একসঙ্গে। মনে পড়ছে, একবার একটা নাটকে ও খলনায়ক, আমি নায়ক। ভিলেনের হাতে ঘুসি খেয়ে ছিটকে পড়েছিলাম মঞ্চে। আর একবার করেছিলাম ঢাকুরিয়ার অবন মহলে, মনোজ মিত্রের ‘নরক গুলজার’।
আমার জীবনের নানা অগোছালো পর্বের মধ্যে একটা হল– এই সিদ্ধার্থ পর্ব। অফিসে একসঙ্গে আছি। মাঝে মাঝে আমার টেবিলে ও কিংবা ওর টেবিলে আমি। কলেজ স্ট্রিট থেকে আমাকে এনে দিত বিখ্যাত লেখকদের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান পত্রিকার জন্য সেসব লেখা। ছবি এঁকে ওকেই দিয়ে দিতাম, মাঝে মাঝে কিছু পয়সা এনে দিত। বাড়তি উপার্জন। তখন তো ফটোকপির নাম শুনিনি, যা কিছু সব হাতে লেখা। লেখকরা হয় কার্বন কপি করে রেখে দিতেন, অথবা খসড়াটা রেখে দিয়ে ফেয়ার কপিটা দিয়ে দিচ্ছেন। হারিয়ে গেলে খসড়া থেকে আবার লেখা যাবে। বড় বড় সাহিত্যিকদের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি পড়তে, ছুঁয়ে দেখতে একটা শিহরণ। লাইনের সোজা বাঁকা, হাতের লেখা, মার্জিন ইত্যাদিতে প্রত্যেকটা মানুষের চরিত্র ধরা পড়ত। রাবার ব্যান্ডের সময় নয় তখন, তাই পাটের দড়ি, সুতুলি দিয়ে হাতে লেখা কাগজগুলো লম্বালম্বি ভাঁজ করে পেটে বেঁধে রাখা হত। কাগজগুলো এমনি যদি সোজা রাখা হয় তাহলে তার মধ্য থেকে কোনও পাতা খসে পড়ার ভয় থাকে। ভাঁজ করে পেটে দড়ি দিয়ে বাঁধলে ভাঁজ খুলে কাগজ পড়ে যায় না। সবখানে বিজ্ঞান দেখছি তখন।
হাতের লেখা দড়ি বাঁধা পাণ্ডুলিপি বলতে আমার আর একটা কথা মনে পড়ছে। প্রবাসীর সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম একদিন। কলকাতায়, এক নম্বর উড স্ট্রিট। রামানন্দ-র পরিবারের তপন চট্টোপাধ্যায় আমাদের কাছাকাছি বয়সের বন্ধু, আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়েও ভীষণ পুরনো, মানে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে, কার কার নাম করি, তাঁদের হাতে লেখা গাদাখানেক পাণ্ডুলিপি দেখেছিলাম। তা দেখে, ছুঁয়ে কেমন যেন নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার ব্যাপার। পুরনো দিনের খ্যাতনামা শিল্পীদের অনেক কাজ ছাড়াও আর একটা জিনিস দেখেছিলাম, নন্দলাল বসুর হরিপুরা কংগ্রেসের পোস্টার। বড় একখণ্ড প্লাইউডের ওপর আঁকা অরিজিনাল নন্দলাল বসুর ছবি, ওদের বাড়ির ঢোকার মুখেই।
হবি তো হ, বসবাসটাও কাছাকাছি। আমি থাকি যোধপুর পার্কের প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে, সিদ্ধার্থ যাদবপুরে। মাঝখানে পোদ্দার নগরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পাঁচ থেকে সাত মিনিট। অতএব বাউন্ডুলেপনায় সোনায় সোহাগা। দিন নেই রাত নেই, শনি-রোববার নেই। সিদ্ধার্থ একদিন আমাকে নিয়ে যাবে বলল হেমেন বসুর বাড়ি খুঁজতে। চুলের তেল ‘কুন্তলীন’-এর প্রস্তুতকারক হেমেন্দ্রমোহন বসু ওরফে এইচ বোস। সেখানে পাথরে খোদাই করে সিঁড়িতে কী লেখা আছে, তা দেখানোর জন্য। আমার তো, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। কোনও কোনও দিন আমাকে বলছে, ‘চলো যাই দেখে আসি এক আধটা আলোর খুঁটি বেঁচে আছে, কলকাতার অতি প্রাচীন চিহ্ন।’ আবার একদিন বলল হঠাৎ, ‘রোদে রোদে ঘুরে বেড়াই চলো, চলো খুঁজি, রোববারে ধর্মতলা থেকে গড়ের মাঠ।’ সেখানে ব্রিটিশ আমলে মহানগরের ঘোড়সওয়ারদের যাত্রা পথে তৃষ্ণায় ঘোড়ার জল খাওয়ার জন্য ছাঁচে ঢালাই লোহার যেসব জলপাত্র ছিল, তা নাকি কোথাও কোথাও এখনও আছে। ধাতুবিজ্ঞানের উদাহরণ, আজও মরচে ধরে না সেই লোহায়।
………………………………………………..
বিজ্ঞানের নানা রকম ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে ম্যাজিকের সরঞ্জাম বানিয়ে সেটা কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞানে পুজো সংখ্যার সঙ্গে বিনামূল্যে উপহার দেওয়া হত। সেটা দিয়ে বিজ্ঞাপন, সেটা নিয়েই পোস্টার। আইডিয়া সিদ্ধার্থের, ছবি দিয়ে ডিজাইন করে সেটাকে দাঁড় করানোর কাজটা ছিল আমার। অফিসের বাইরে শুরু হল কিছু কিছু অদ্ভুত মজার কাজ। প্রেমেন্দ্র মিত্র তখন লিখছেন তার শেষ কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি, ‘মৌ কা সা বি স‘। পাশাপাশি শুরু হলো সিদ্ধার্থ ঘোষের প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে, তাঁর প্রিয় চরিত্রকে নিয়ে ঘনাদা ক্লাব, শৈব্যার অফিসেই।
………………………………………………..
কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় আমার দ্বিতীয় জন্ম, দ্বিতীয়বারের প্রবেশ সিদ্ধার্থর হাত ধরে। প্রথমবার আর্ট কলেজের শুরুর দিকে ঢুকেছিলাম খালেদদা মানে প্রখ্যাত শিল্পী খালেদ চৌধুরীর হাত ধরে। তখন কলেজের শুরুতে শিল্প বিষয়ে শিশু, আঁকতে তো পারি না কিছুই, কিন্তু রোজগারের দরকার। খালেদদা পাঠিয়েছিলেন কথাশিল্প-র অবনীবাবুর কাছে, অবনীরঞ্জন রায়। বইপাড়ায় একেবারেই ছবি আঁকার অ আ ক খ। ইতিহাস ভূগোল ব্যাকরণ বইয়ের মলাট। ছোটদের ইতিহাস বইতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা আলেকজান্ডারের মুখ ট্রেস করে আঁকা। গণিতের বইয়ে একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র। এক, একটি মার্বেল; দুই, দুইটি বিড়াল এবং তিন, তিনটি মোমবাতি ইত্যাদি।
পেশাদারিত্বের সঙ্গে শুরু হল কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় দ্বিতীয় দফার কাজ। শৈব্যা প্রকাশনীর কর্ণধার, রবীন বল এবং ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ পত্রিকা, দুটোই পেলাম সিদ্ধার্থ ঘোষের কাছ থেকে। কাজের সঙ্গে আড্ডা, মজা, চা-ঝালমুড়ি। কখনও সখনও ঝাঁজালো কী সব ড্রিংকস নিয়ে আড্ডা হত রবীনবাবুর অফিসে। লিমকা বা ওই জাতীয় কিছু ঠাণ্ডা পানীয়র সঙ্গে বেশ খানিকটা চাট মশলা মিশিয়ে তৈরি বস্তুটি স্ট্র দিয়ে খেতে দারুণ। মেজাজে যেন, ‘একটি ছটাক সোডার জলে এক পোয়াটাক হুইস্কি’।
বিজ্ঞানের নানা রকম ধর্ম ইত্যাদি নিয়ে ম্যাজিকের সরঞ্জাম বানিয়ে সেটা কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞানে পুজো সংখ্যার সঙ্গে বিনামূল্যে উপহার দেওয়া হত। সেটা দিয়ে বিজ্ঞাপন, সেটা নিয়েই পোস্টার। আইডিয়া সিদ্ধার্থের, ছবি দিয়ে ডিজাইন করে সেটাকে দাঁড় করানোর কাজটা ছিল আমার। অফিসের বাইরে শুরু হল কিছু কিছু অদ্ভুত মজার কাজ। প্রেমেন্দ্র মিত্র তখন লিখছেন তার শেষ কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি, ‘মৌ কা সা বি স’। পাশাপাশি শুরু হলো সিদ্ধার্থ ঘোষের প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে, তাঁর প্রিয় চরিত্রকে নিয়ে ঘনাদা ক্লাব, শৈব্যার অফিসেই।
রবিনবাবু এবং সিদ্ধার্থর উৎসাহে এরপর শুরু হল আমার লেখালেখি, বিজ্ঞানভিত্তিক ধাঁধা, মজা, ম্যাজিক নিয়ে কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞানের নতুন কলাম, ‘বুদ্ধিশুদ্ধি’। বুদ্ধিশুদ্ধি ছোটদের জন্য, কিন্তু খেলছে তাদের মা-বাবা, খেলছে বড়রা। খুব জনপ্রিয় হল সেই সহজ-সরল ভাষায় লেখা গল্পে গল্পে বিজ্ঞানের নানা দিক। সেই নিয়ে প্রতিযোগিতা এবং বুদ্ধিশুদ্ধি প্রতিযোগিতায় যারা জয়ী হত সেই খুদে পাঠকরা সারা বছর বিনা পয়সায় পেত কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি সংখ্যা। বিড়লা মিউজিয়ামের লাইব্রেরির বই নিয়ে গিয়ে কলেজ স্ট্রিটে বিক্রি করে দিলাম যেন। দেখলাম বিজ্ঞান শুধু কঠিন কঠিন ফর্মুলা নয়, এর মধ্যে মজা আছে। সেগুলোকেই লিখে লিখে ছোটদের দিয়েছি। কিশোরদের জন্য এমন একটা আনন্দের আয়োজনের খুব অভাব বোধ করি আজকাল।
ফিলাটেলি কিংবা অটোমেশন, জাহাজ এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে বড়দের জন্য ভারী কাজও আমাকে দিয়ে করিয়েছে সিদ্ধার্থ। তখনকার দিনের বিখ্যাত পত্রিকা এক্ষণে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছাপাখানার বিষয়ে বড় করে প্রবন্ধ লেখে সিদ্ধার্থ। সেখানে হাফটোন এবং কোয়ার্টার টোনের ছাপার পদ্ধতি নিয়ে গ্রাফিকের কাজগুলো করেছিলাম আমি। ‘প্রস্তুতিপর্ব’, সুকুমার সংখ্যার জন্য সত্যজিৎ রায়, শোভন সোম, অরণী বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মত বড় লেখকের পাশাপাশি আমাকে দিয়েও লিখিয়েছিল সিদ্ধার্থ। সাহিত্যে সুকুমার রায়ের সচিত্রকরণ নিয়ে আলোচনা। এমনকী আমি যখন কলকাতা ছেড়ে প্রবাস জীবনে ব্যাঙ্গালোর হয়ে বম্বেতে– তখনও সিদ্ধার্থ আমাকে অফার দিয়েছিল আনন্দমেলার জন্য মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প নিয়ে রঙিন কমিক্স করার। দেখলাম যে, সব গল্প ঠিক ছোটদের জন্য উপযুক্ত নয়। সেই কাজটা আমি পরে একটি বিখ্যাত বড়দের কাগজে করেছিলাম দীর্ঘদিন। এমনই অনেক উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য আমি ওর কাছে ঋণী।
কিছু কিছু কাজ আছে একা একা করা যায় না। অনেকগুলো জায়গা আছে যেখানে একা একা শুরুতে ঢোকা যায় না। কারও কাঁধে হাত রেখে, কারও হাতে হাত ধরে, কারওর কোমর বা ধুতির খুট ধরে, আবার কারও ছায়ায় ছায়ায় ঢুকে পড়তে হয়। সেভাবেই ঢুকেছিলেন সবাই। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, অমর্ত্য সেন। ঋত্বিক, শক্তি, সুনীল, সমরেশ, সুভাষ, মলয় রায়চৌধুরী। তারপর অভ্যেস হয়ে গেলে, বলা ভালো নেশা হয়ে গেলে, তখন সে সব জায়গায় একা একা যাওয়া যায়। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস তেমনই এক মহান আড্ডাঘর। সিদ্ধার্থর সঙ্গে এই কফি হাউসে প্রথম ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই জায়গাটাকে কী করে উপভোগ করা যায় তার শিক্ষাও ওই দিয়েছিল। তারপরে তো কফি হাউসের মধ্যে বসেই সমস্ত কিছু। প্রেম করা, প্রুফ দেখা, বিজ্ঞান চর্চা, কবিতার খসড়া বিচার। উর্দিধারী বেয়ারা, কফি কাটলেটের অনুভূতি। সাংবাদিকতা থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধক্ষেত্র।
ওর অনুসন্ধানের এই উৎসাহ এবং সান্নিধ্য পরবর্তীকালে আমাকে দিয়েছে কন্সেপচুয়াল আর্টের বোধ। দুঃখের বিষয়, বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল সিদ্ধার্থ। ৫৪ বছরটা কি চলে যাওয়ার বয়স? বিস্তারিত বলতে চাই না, ব্যক্তিগত জীবন সিদ্ধার্থের তেমন সুখের ছিল না। তারই মাঝে রেখে গেল বিজ্ঞান বিষয়ে বাঙালি পাঠকদের জন্য অনেক উল্লেখযোগ্য রচনা। ‘কারিগরি কল্পনা ও বাঙালি উদ্যোগ’, ‘কলের শহর কলকাতা’, ‘ছবি তোলা– বাঙালির ফোটোগ্রাফি-চর্চা’ যেমন, তেমনই ছোটদের জন্য গণিত ও ধাঁধা, ‘অঙ্ক আতঙ্ক নয়’, ‘মজার খেলা অঙ্ক’, ‘অঙ্কের ম্যাজিক খেলার লজিক’, ‘লুইস ক্যারলের ধাঁধা’, ‘স্যাম লয়েডের অঙ্কের ধাঁধা’। কল্প বিজ্ঞান, ‘গ্যাবনে বিস্ফোরণ’, ‘অসম্ভবের গল্প’, ‘ই টি রহস্য’, ‘চাঁদের মাঠে ওয়ান ডে’, ‘ঝন্টু মামার কাণ্ড’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইতো সেদিনের কথা। ওর জন্য খুব মন খারাপ হয়। একা একা জঙ্গলে, মাঠের ধারে ধারে, যেখানে লোকবসতি নেই, সেখানে কী সব খুঁজে বেড়াতেন বিভূতিভূষণ। অন্ধকার, শামুকের খোল, ঝরে পড়া পাতা, ফুলের পাপড়ি, বীজ কিংবা গাছের চারা! মাঝে মাঝে মনে হয়, এখন সিদ্ধার্থও খুঁজে বেড়াচ্ছে কত কী! আলো। সিভিলাইজেশান। প্রযুক্তি। অলিতে গলিতে, চাকার দাগ, ল্যাম্পপোস্ট, ধাতুর ঢাকনা, ফেলে দেওয়া আবর্জনার মধ্যে থেকে মানুষের কীর্তি, অনেক দিন আগেকার মানুষের ইচ্ছাগুলো। মানুষের ছোঁয়া, ছাপ, চিহ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে আবিষ্কার, দক্ষতা, যুক্তি-বুদ্ধি-আইকিউ।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ ‘কাজের মানুষ’ হয়ে উঠুক। এই ‘কাজের মানুষ’ হয়ে উঠতেই নিজেকে বাবার আরব্ধ কাজে সমর্পণ করেন রথীন্দ্রনাথ। পিছনে পড়ে থাকে তাঁর নিজের স্বপ্নপূরণের ইচ্ছা। পিতার নির্দেশই হয়ে ওঠে তাঁর কাছে অপ্রতিরোধ্য, অবশ্য পালনীয়। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে এই বিশেষ নিবন্ধ।