‘ব্ল্যাক ম্যাজিক‘ প্রসঙ্গটাই সযত্নে এড়িয়ে যেতে চাই। সে গল্প অনেক লম্বা। তার চেয়ে বরং ম্যাজিকে কালোর ব্যবহার নিয়ে দু’চার কথা বলা যেতে পারে। কালোর ব্যবহার ম্যাজিকে কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক, প্রয়োজন মতো অন্ধকার, মঞ্চের পিছনের পর্দা, কালো পোশাক, টেবিলের কালো ঢাকনা, কালো বাক্স, কালো টুপি এসব খুব দরকারি। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় মনোসংযোগ করতে গেলে কালো ভীষণ সাহায্য করে। এই প্রসঙ্গে আমার নিজের কথা অর্থাৎ আমার মাধ্যমের কথা না বলে পারছি না। জলরঙে ছবি আঁকাটাও আমার কাছে ম্যাজিক মনে হয়।
১১.
‘ম্যাজিক’ শব্দটার মধ্যে একটা জাদু আছে। জাদুকর বা বাজিকর-দের কাহিনি বলতে সুদূর অতীতের মেসোপটেমিয়া বা মিশর টানতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। ইতিহাস টেনে কথা বললেই সব সময় কেমন যেন একটা পড়াশোনা করার চাপ এসে পড়ে। আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করছি। তাই ম্যাজিকের পেছনে কোনও সত্যিকারের জাদু, মানে হিপনোটিজম, মন্ত্র-তন্ত্র আছে কি না, তা বোধ হয় আর কেউ মাথায় রাখে না। ভাগ্যি ভালো যে, দর্শক ওই ব্যাপারটাকে মাথা থেকে সরিয়ে রাখেন বলেই জাদুকর সত্যিকারের বিনোদন ব্যবস্থার সুযোগ পান। শিক্ষিত দর্শক যে এই শিল্পকর্মটির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন, মনোযোগী হচ্ছেন, সেটা কিন্তু একটা মস্ত উপহার। এটা আমি আমাদের দেশের কথা বলছি না সারা পৃথিবীর নিরিখে আজকাল আবার ম্যাজিক দেখার উৎসাহ বেড়েছে। এর মস্ত কারণ ডিজিটাল ব্যবস্থার উন্নতি। আপনি যদি আজকের ম্যাজিশিয়ান হন, মনে রাখবেন দর্শক যে তাঁদের মূল্যবান সময়টা আপনার জন্য ব্যয় করছেন তার জন্য আপনার বুদ্ধিমত্তা আর দক্ষতা সর্বশ্রেষ্ঠ হতে হবে, আপনার দর্শককে আনন্দ দেওয়াটাই হতে হবে মূল উদ্দেশ্য।
আমাদের দেশে ম্যাজিক যে আসলে পারফর্মিং আর্ট, সৃষ্টিধর্মী বিনোদনের শিল্প, সে হিসেবে এটাকে দেখা হয়নি বহুকাল। এটার নানারকমের নেগেটিভ ইমেজ। অনেকের ধারণা এটা একটা লোক ঠকানোর খেলা। প্রতারণা, মানুষের দুর্বলতা আর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে অনিষ্ট করা, ভয় দেখানো ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব, সেটাকে আবার পয়সা খরচ করে দেখতে যাওয়া, অসুবিধা আছে। তাছাড়া আধুনিক মানসিকতার অভাব, মঞ্চে প্রদর্শনী করার জন্য সরঞ্জাম ইত্যাদির অত্যধিক ব্যয়। নানা অসুবিধা। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকজন ম্যাজিকে সুনাম অর্জন করলেও ভারতের ক্ষেত্রে জাদুবিদ্যায় একটাই নাম, ‘পি. সি. সরকার’। দেশের বাইরে বিদেশেও তাঁর সুখ্যাতি। বিলেতে তাঁর প্রদর্শনী করার সময় লন্ডনের সমস্ত সংবাদপত্রে একটা সংবাদ তখন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে শহরে। জাদুকর নাকি মঞ্চে একটি মহিলাকে দু’টুকরো করে কেটে জনসমক্ষে মার্ডার করেছেন। আর ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাদুকরের নাম যদি বলতে হয় তাহলে আমি তো চোখ বন্ধ করে বলব– আমার প্রিয় মেজদা, পি. সি. সরকার, জুনিয়র। চোখ বন্ধ করে কী অসম্ভব কাণ্ডটাই না করতে পারেন তিনি। সেই মুখটাকে সামনে রেখে আমার আজকের এই কাহিনি।
ইতিহাসে না ঢুকলেও পৃথিবীর বিখ্যাত জাদুকরদের পেশাদারিত্ব আর সফলতার চটজলদি একটা ধারণা দিই এখানে। নামজাদা ম্যাজিশিয়ান অনেক আছেন সারা পৃথিবী জুড়ে, এখানে শুধু কয়েকজনের নাম করব।
– জাদুর জগতে সবচেয়ে পরিচিত পুরনো, উনিশ শতকের আমেরিকান ‘হ্যারি হুডিনি‘-র কথা ম্যাজিকপ্রেমীরা আজও ভোলেনি। স্টেজ ম্যাজিশিয়ান। শিকল, দড়ি দিয়ে বেঁধে তাঁকে আটকে রাখা যায় না। অভিনব উপায়ে পালিয়ে যাওয়াতেই তাঁর সুখ্যাতি।
– পরের আমেরিকান জাদুকর ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ নামে তাঁর খ্যাতি। ফোর্বস-এর মতে, তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে সফল জাদুকর। ৪০ বছরে এগারো বার গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম। এ পর্যন্ত তাঁর প্রদর্শনীর টিকিট বিক্রি প্রায় তেত্রিশ মিলিয়ন। আয় হয়েছে চার বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
– ২০১৪ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে শতাব্দীর সেরা জাদুকরদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন, মঞ্চে যিনি ভক্তদের কাছে ‘ডায়নামো’ নামে পরিচিত। ইংল্যান্ডের এই জাদুকর টেমস নদীতে জলের ওপর দিয়ে হেঁটে সবাইকে তাক লাগিয়েছেন। বার্ষিক আয় প্রায় উনিশ মিলিয়ন ডলার।
– ‘ক্রিস অ্যাঞ্জেল’, ৫০ বছর বয়সী এই আমেরিকান জাদুকর জীবনের প্রথম স্টেজ শো-তে অংশ নেন ১২ বছর বয়সে। সেই শো থেকে কামিয়েছিলেন দশ ডলার। অন্যান্য জাদুকরদের তুলনায় টেলিভিশন প্রাইম টাইমে তার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য।
– ‘ডেভিড ব্লেইন’ নামে পরিচিত, আমেরিকান জাদুকর, ইল্যুশনিস্ট এবং ধৈর্যশীল শিল্পী। পারফর্মারের বদলে দর্শকসারিতে বারবার ক্যামেরা ঘুরিয়ে তিনি দর্শককে দর্শকের প্রতিক্রিয়া দেখানোর নতুন এক পদ্ধতি প্রচলন করেন। নিজের প্রচারণার চেয়ে তিনি জাদুবিদ্যারই ব্র্যান্ডিং করে চলেছেন যেন।
পি. সি. সরকার, জুনিয়র এর সঙ্গে আমার আলাপ হয় এখন থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগে। ভাগ্যের পরিহাস একেই বলে। কী না করেছি ম্যাজিক শেখার জন্য! এমন একটা মানুষের নাম জপেছি এতদিন। এমন একটা মানুষের সান্নিধ্যের জন্য পাগল হয়েছি অথচ জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে যখন সেই বিষয়ের ওপরে আর আমার আসক্তি নেই, অন্য পেশায় জীবন বাহিত, তখনই আমি আমার প্রিয় জাদুকরের সামনাসামনি। যাকে বলে হাতসাফাইয়ের বিখ্যাত সেই মানুষটির হাত ছুঁয়েছিলাম। ওঁর সম্পর্কে আমার যে অভিজ্ঞতা, তা বলার জন্য মুখ খোলার আগেই উনিই প্রথমে মুখ খুললেন। আলাপের মুহূর্তেই উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি ছবি আঁকেন, আর যদি ছবিটা না আঁকতেন তাহলে আপনি ম্যাজিশিয়ান হতেন, তাই তো? ম্যাজিকের বই কেনার জন্য পয়সা জোগাড় করতে ছোটবেলায় খালে-বিলে আপনার কাঁকড়া ধরে বেড়ানোর ব্যাপারটা চমৎকার।’ অভিভূত হয়েছিলাম। এই তো প্রকৃত ম্যাজিশিয়ান, আসল, খাঁটি। পরিচয়ের আগেই উনি আমার সম্পর্কে বলে যাচ্ছেন শুনে আকাশ থেকে পড়েছিলাম সেদিন। উনি মন পড়ে ফেলতে পারেন দেখছি। থট রিডার, মাইণ্ড রিডার যাকে বলে তার চূড়ান্ত।
আলাপের অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম সেটা তার নিজের গুণে। অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বেশি কাজ করাতেই বিশ্বাসী ছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র। আমার চেয়ে বয়সে কিছুটা বড় তাই ওঁকে ‘মেজদা’ বলা শুরু করে দিয়েছিলাম প্রায় শুরুর দিন থেকে। এইখানে বলে নিই, আজকাল আমরা দেখছি, উনি মাঝে মাঝে উল্লেখ করেন যে, ওঁর নাকি নিজস্ব কোনও নামই নেই! শুরুতে ছিলেন পি. সি. সরকারের ছেলে। পরে পি. সি. সরকার হলেও নামের পেছনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে জুনিয়র। কখনও মানেকা কিংবা মুমতাজের বাবা, কখনো সহধর্মিণী জয়শ্রীর জহরদা। তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজ বলে কারও কারও কাছে মেজদা। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে তাঁর পাড়ার ডাকনাম ধরে ডাকা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে ওঁর নাকি আসলে নিজস্ব কোনও নামই নেই।
মিনিমাম এফর্ট, ম্যাক্সিমাম এফেক্ট, এই থিওরিটায় উনি বরাবর বিশ্বাসী। কারণ, দ্রুততা ম্যাজিকের একটা মন্ত্রের মতো। শুনলে মেজদা নিশ্চয়ই খুশি হবেন, যে ব্যাপারটা আমার সেদিন ভালো লেগেছিল সেটা হচ্ছে যে, আন্তরিকতা এবং যেকোনও অবস্থায় উনি একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে চান পরিবেশ এবং মানুষের সঙ্গে। ইনফরমেশন জোগাড় করতে চান, যেটা দীর্ঘ জাদুবিদ্যা চর্চার আসল কথা।
আমি সিনিয়র পি. সি. সরকারের ম্যাজিক শো কখনও মঞ্চে দেখিনি। জুনিয়র পি. সি. সরকার অর্থাৎ, মেজদার প্রথম শো দেখি কলকাতায় মহাজাতি সদনে। অনেক খেলাই ছিল নানারকম ম্যাজিশিয়ানের দেখা আগের খেলার মতো। কিন্তু যেটা কখনও মিলবে না সেটা হচ্ছে, পরিবেশনের চমৎকারিত্ব এবং বিশালত্ব। একটা লার্জার দ্যান লাইফ কিংবা মনুমেন্টাল কোয়ালিটি অথবা একটা ব্যাপক সমারোহ যাকে বলে। ফাঁকা টুপি বা বাক্স থেকে বলটা, ফুলটা যেমন বেরোতে দেখেছি আগে অনেকবার, ঠিক তেমনই মঞ্চে দেখলাম সেই বাক্সটা হয়ে গেল বিশাল বড়। চারটি দেওয়ালের মতো বড় ফ্রেমের দেওয়াল জুড়ে একটি বড় বাক্স এবং তার মধ্যে থেকে পায়রা নয়, খরগোশ নয় হঠাৎ বেরিয়ে এল একটি বিশাল প্রমাণ সাইজের সাদা ঘোড়া। ওঁর পোষা বিশাল চেহারার সিংহটিকেও এরকম কাজে অনেকবার লাগিয়েছেন। বাবার সেই বিখ্যাত খেলা, একটি মেয়েকে ইলেকট্রিক করাত দিয়ে দুখণ্ড করে কেটে আবার জোড়া লাগানোর খেলাটাও দেখেছি সেই মঞ্চে। বিশাল আয়োজন, গা ছমছম পরিবেশ সৃষ্টি। অন্যান্য ম্যাজিশিয়ানদের তুলনায় অনেক সুন্দর দেখতে, মানে সুদর্শন জাদুকর ছিলেন মেজদা। লাখ টাকার হাসি মুখে সর্বক্ষণ, আর কথার ফুলঝুরি। বডি মুভমেন্ট, মানে মঞ্চের মধ্যে চলাচল করা বা শরীর চালনার যে ছন্দ তা অসামান্য। সেদিন শোয়ের শেষে আমি ছিলাম হতবাক, একেবারেই নির্ভেজাল মুগ্ধ দর্শক।
মেজদার সঙ্গে আলাপের পরপরই দুই একবার মঞ্চে উঠে গেছি দর্শক হিসেবে। মঞ্চে উঠেছিলাম চোখ বেঁধে খেলা দেখানোর বেলায়। আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা এবং পরিষ্কার বুঝতে পারি ওঁরও জীবনের শ্রেষ্ঠ খেলা ওই চোখ বেঁধে ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা-জোখা। কী নেই সেখানে! অভিনয়, দ্রুততা, উপস্থিতবুদ্ধি, সেন্স অফ হিউমার, অঙ্কনবিদ্যার কৌশল আরও কত কি! আলো, মিউজিক, মঞ্চসজ্জা ও সহশিল্পীদের অভিনয় ইত্যাদি নিয়ে দাপিয়ে বেড়ান মঞ্চে ওই সময়। স্বচ্ছন্দ, সাবলীল, সাহসী, স্বতঃস্ফূর্ত আর শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার মানসিক অবস্থা আর অন্য কোনও খেলাতে কখনও দেখিনি। মঞ্চে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময়তেই উনি চোখ বাঁধা অবস্থাতে একটু এগিয়ে এসে আমাকে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘আসুন সমীরবাবু।’ তার মানে তো উনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন। উনি কী বোঝাতে চাইলেন? আমার এ কৌশল জানা, নাকি আমি মঞ্চে উঠেছি খেলাটা কীভাবে করা হয়, তা কাছ থেকে দেখে শেখার জন্য? কী ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন নাম ধরে ডেকে?
কয়েকদিনের মধ্যেই মেজদার সঙ্গে আর একবার দেখা একটা কমন পার্টিতে। আমন্ত্রিত আমরা দু’জনেই। প্রীতীশ নন্দীর জন্মদিন। পার্টিতে আরও বড় বড় লোকের সঙ্গে আছেন কলকাতার পিয়ারলেস গ্রুপের কর্তা, সিনেমা, সাহিত্য, সাংবাদিকতার বাঘা বাঘা মানুষ। সতীশ কৌশিক, অনুপম খের, কিরণ খের। মুকুল শর্মা, এস এন এম আব্দি। অনিল কাপুর এবং অমিতাভ বচ্চন। মেজদা যেহেতু বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, তাই খাওয়ার টেবিলে সেদিন অনেকের সঙ্গে আড্ডার ছলে অনেক গল্পই হয়েছিল। বিজ্ঞান অথবা অ-বিজ্ঞান বিষয়ক, অর্থাৎ কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে অনেক কিছুই। সাইবাবার সঙ্গে উনি ম্যাজিকের লড়াই করেছিলেন, সেটাও ছিল। মাইন্ড রিডিং, টেলিপ্যাথি, মানুষ এবং জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে মনের যোগাযোগ এবং দূরত্ব আর সময় অতিক্রম করে তাঁর অদ্ভুত অনুভূতির কথাও আলোচনা হয়েছিল। কথা হয়েছিল সায়েন্স মিউজিয়াম এবং ম্যাজিকের সায়েন্স প্রসঙ্গে। আমার কর্মজীবনে কলকাতার বিড়লা মিউজিয়ামে আমরা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রোগ্রাম করতাম। ভণ্ডামি ও ম্যাজিকের প্রয়োগ এবং তার মিথ্যে ব্যাপারটা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর প্রোগ্রাম। যেমন হাত ঘুরিয়েই রসগোল্লা বা বিভূতি দিচ্ছে কোন সাধু কিংবা চমকে দিচ্ছে জ্বলন্ত আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে। ভূতের কথা, সাপ এবং ওঝার মন্ত্রতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে খাওয়ার টেবিলে আড্ডার ছলে অনেক গল্পই হয়েছিল সেদিন।
‘ম্যাজিক’ শব্দটার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৫০-এর দশকের শেষভাগে। জন্মেছিলাম ২৪ পরগনার বালতি নামে ছোট্ট একটি গণ্ডগ্রামে। ঘরের পাশে ছোট্ট স্থির জলের নদী ‘সোনাই’। ওপারে গ্রামটির নাম ‘বয়ারঘাটা’। শোনা গেল ওপারের স্কুলে ম্যাজিক এসেছে। পাড়ার ছেলেপুলেরা সবাই চলে গেছে সেখানে। আমরা দু’ভাই খুব ছোট, আমি ছয়-সাত, ভাই পাঁচ। জল পেরিয়ে আমাদের যাওয়া নিষেধ। সবাই চলে গেছে কিন্তু ম্যাজিক কী জিনিস সেটা দেখা হবে না? ভাইকে নিয়ে চুপি চুপি বাড়ি থেকে লুকিয়ে যেখানে সোনাই নদী বাঁক নিয়েছে সেইখানে পৌঁছলাম। নদীতে জল কম। সত্যিকারের বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল। ভাইকে কাঁধে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে আস্তে আস্তে ওই জল পেরিয়ে ওপারে চলে গেলাম। ভীষণ বিপজ্জনক একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলাম। মাথায় ভারী ভাইকে নিয়ে আমার ওই বয়সে জলের মধ্যে পা টিপে টিপে মাটি আর কাদার অবস্থা বুঝে একটু একটু করে এগিয়ে সেই জল পেরোতে হয়। যদিও বড়দের সঙ্গে ওই জায়গা দিয়ে আগে জল পেরিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। ওপারে উঠে প্রায় আধ কিলোমিটার দৌড়ে দৌড়ে গেলাম সেই স্কুলে। ভেতরে জানালাগুলো প্রায় সব বন্ধ, আধো অন্ধকার। যা দেখলাম তা হল, একটা টেবিল কাপড় দিয়ে ঢাকা। ম্যাজিশিয়ান সেইটার ওপরে তার জিনিসপত্র সাজাতে ব্যস্ত। ম্যাজিকের সরঞ্জাম টেবিলের উপরে যা যা সাজানো হচ্ছিল তাতে দেখলাম কয়েকটা কৌটো, ফুল,বল, দু’চারটে বাক্স এবং অদ্ভুতভাবে একটি কঙ্কালের মুন্ডু, মানে মানুষের মাথার খুলি, সঙ্গে দুটো হাড়। সেইটা দেখে ভাইয়ের হাতটা চেপে ধরলাম। কেমন পা কাঁপতে লাগল। ভাইকে বললাম, বাড়ি যাবি? ভাই মাথা নাড়লো। আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাইরে গিয়ে যেমন এসেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি জোরে দৌড়ে সেই নদীর অংশে চলে গেলাম। ম্যাজিক দেখা আমাদের হয়নি কিন্তু ভয় ভয় গা ছমছম সেই পরিবেশটার দৃশ্য এখনও মাথার মধ্যে রয়ে গেছে।
বালতি গ্রাম থেকে বাস উঠিয়ে আমরা বসিরহাট টাউনে চলে এসেছি। কৈশোরে পা। ম্যাজিক শেখার জন্য পাগল হয়ে উঠলাম, কিন্তু শেখাবে কে? পাড়ায় তো কোনও ম্যাজিশিয়ান নেই, যাকে গুরু ধরে শিখব। একটা বুদ্ধি মাথায় এল। বইয়ের দোকানগুলোতে খোঁজ করা যেতে পারে যে, ম্যাজিকের কোন বই পাওয়া যায় কি না। শেষে বসিরহাটের স্কুল লাইব্রেরিতে একটা ম্যাজিকের বই পাওয়া গেল এবং সেটা বিখ্যাত জাদুকর পি. সি. সরকারের লেখা। বইটা দেখা যাবে না শুধু ওপর থেকে মলাটটা দেখা যাবে। কারণ, সেটা হলুদ রঙের সেলোফেনে মুড়ে আঠা দিয়ে বন্ধ। কিনলে তবেই খুলে ভেতরে যাওয়া যাবে। বইয়ের দামটা সাধারণ ছোটদের গল্পের বই এর চেয়ে একটু বেশি তাই তক্ষুনি কেনা গেল না। গ্রামে পয়সা নেই। কোথা থেকে পয়সা পাওয়া যায়? চায়ের দোকানে কাজ? চায়ের দোকানই নেই গ্রামে। নদীর চরে গরুর ঘাস কাটা যেতে পারে, তাতেও লোকে ক’টা পয়সাই বা দেবে। ঠিক হলো কাঁকড়া ধরা। গ্রামে খালে বিলের জলে তখন বেশ বড় বড় কাঁকড়া পাওয়া যেত। আমি আর জিতেন রোদে পুড়ে, জলে ভিজে কয়েকদিন ধরে অনেক কাঁকড়া ধরেছিলাম সেগুলো পাড়ায় বিক্রি করে ওই ম্যাজিকের বই কেনা।
ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। তাই নানা ভাবে, শুকতারা থেকে, কখনও কখনও শনি-রবিবারের খবরের কাগজের ছোটদের পাতা থেকে, এর ওর মুখ থেকে শুনে, মেলার ম্যাজিক, স্কুলের ম্যাজিক দেখে অনেকগুলো খেলা রপ্ত করে ফেলেছিলাম। ছুটির দিনে সেগুলোকে নিয়ে পাড়ার এক পোড়ো বাড়িতে ম্যাজিক দেখানো শুরু করলাম আমি আর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট জিতেন। আমি ম্যাজিশিয়ান তাই আমার একটা আলাদা কদর। অদ্ভুতভাবে আমার ম্যাজিক টিকিট কেটে দেখতে হত। যদিও সেই টিকিটের মূল্য ছিল হয়তো পাঁচ পয়সা। কারণ ফাঁকা কৌটো থেকে ফলটা ফুলটা যে বেরোচ্ছে সেটা তো আর সত্যিকারে হাওয়া থেকে বের হত না, ওইসব জিনিসপত্রগুলো আগে থেকে জোগাড় করতে হত সেইখানে কিছু খরচা, সেই খরচা টিকিটের পয়সা থেকে আসত। ছোটদের ভয় দেখানোর জন্য কখনও-সখনও আমরা মানুষকে মন্ত্রবলে রাক্ষস বানানোর একটা খেলা দেখাতাম।
ডিজিটাল আর কম্পিউটার যুগে ইদানীং দেখছি টেলিভিশনে আজকাল প্রচুর পরিমাণে ম্যাজিকের নানা রকমের শো দেখা যাচ্ছে। অত্যাধুনিক আয়োজন, টেলিভিশন, ক্যামেরা এবং এ আই-এর সাহায্য নিয়ে ব্যাপক হইচই। হাইব্রিড মানুষ, জানোয়ার এমনকী বিশাল প্রাগৈতিহাসিক জন্তু, ডাইনোসর ইত্যাদি এসে যাচ্ছে মঞ্চে। আমরা যাকে হাতসাফাই বা ভানুমতীর খেল বলতাম তারও নতুন অবতার। ছোট ছোট টেবিল টপ কিংবা পার্টিতে কাছাকাছি দু’জনের মধ্যে ক্লোজআপ ম্যাজিকও নতুন করে ভিডিও আকারে দেখতে পাচ্ছি। রেস্তোরাঁয় টেবিলের নুনের পাত্র ম্যাজিশিয়ান এর হাতের মুঠোয় হয়ে উঠল ডিম, পরক্ষণে ডিম হয়ে গেল সুন্দর রঙিন একটি জ্যান্ত পাখি। এমনকী মঞ্চের বড় আয়োজনের খেলাগুলোর যন্ত্রপাতি সমেত হঠাৎ দেখছি স্ট্রিট ম্যাজিক হিসেবে। যেমন একটা মেয়েকে করাত দিয়ে কেটে দু’খানা করে তারপর আবার জুড়ে দেওয়া দেখাতে একটা বিশাল আয়োজন ছিল মঞ্চে। সেটাকে একেবারে রাস্তায় এনে ফেলেছে। রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ চাকাওয়ালা বড় একটা টেবিল চলে এল। রাস্তার দর্শকদের ভিড় থেকে একটি সুন্দরী মহিলাকে বেছে নিয়ে তাকেই টেবিলে শুয়ে দিয়ে কেটে দু’খানা করে ফেলল ম্যাজিশিয়ান। তার স্বামীটা তো ভয়ে আধখানা। মাঝখানে অদ্ভুত নাটক। হঠাৎ কাটার পরে টেবিলটা দু’ভাগে দুটো টেবিল। একটিতে মাথা আর একটিতে পা। পাওয়ালা টেবিলটাকে দেখলাম কে একজন ঠেলাগাড়ির মতো ওখান থেকে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মুড়ো নেবে না ল্যাজা নেবে, সেরকমই মনের অবস্থা মেয়েটির স্বামীর।
‘ব্ল্যাক ম্যাজিক‘ প্রসঙ্গটাই সযত্নে এড়িয়ে যেতে চাই। সে গল্প অনেক লম্বা। তার চেয়ে বরং ম্যাজিকে কালোর ব্যবহার নিয়ে দু’চার কথা বলা যেতে পারে। কালোর ব্যবহার ম্যাজিকে কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক, প্রয়োজন মতো অন্ধকার, মঞ্চের পিছনের পর্দা, কালো পোশাক, টেবিলের কালো ঢাকনা, কালো বাক্স, কালো টুপি এসব খুব দরকারি। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় মনোসংযোগ করতে গেলে কালো ভীষণ সাহায্য করে। এই প্রসঙ্গে আমার নিজের কথা অর্থাৎ আমার মাধ্যমের কথা না বলে পারছি না। জলরঙে ছবি আঁকাটাও আমার কাছে ম্যাজিক মনে হয়। কত অল্প কাজে অনায়াসে দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করা যায়। দু চারটি ফুল আঁকলাম কি আঁকলাম না, পেছনে রঙিন জলের উপরে কেবল জলের ছিটে দিয়েই তৈরি হয়ে গেল দিগন্ত ব্যাপি ফুলের বাগান। শুধুমাত্র কাগজে ঘোলা জল দিয়েই বুঝিয়ে দেওয়া যায় কুয়াশা ঘেরা গাছের জঙ্গল কিংবা মনটাকে নিয়ে যাওয়া যায় দূর থেকে দূরান্তরে। আমার জলরঙে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে কালো রঙ। কোনও জায়গাকে বেশি উজ্জ্বল করে দেখাতে এবং কোনও অংশ না দেখাতে কালোর অবদান অনেক।
মনে পড়ছে আরও একটা অনেকদিনের পুরনো কথা। টেলিভিশনে শুরুর দিকে সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রোগ্রাম শুরু করেছিলেন প্রীতীশ নন্দী। ‘দি প্রীতিশ নন্দী শো’। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নেওয়ার শুরুতে তাঁদের পরিচয়ের আগেই একটি করে মুখের ছবি দেখানো হত। অভিনব কায়দায় শুরু থেকে ধীরে ধীরে ছবিটা আঁকা হয়ে উঠত পর্দায় সবার চোখের সামনে। সেটি জলরঙে আঁকা হত আর সেই কাজটা করতাম আমি। এই সিরিজে বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে পি. সি. সরকার জুনিয়রও ছিলেন। ওঁর পোর্ট্রেটটাও করেছিলাম সে সময়ে। দুঃখের ব্যাপার, আমাদের বাড়িতে তখন একটি ছোট্ট টেলিভিশন, সেটি আবার সাদা কালো। তাই রঙিন ছবিটা দেখার জন্য প্রত্যেকবারই আমার বন্ধুর বাড়িতে যেতাম ওই প্রোগ্রাম দেখতে।
ম্যাজিকের অনেক কথাই তো হল। একটু পিছিয়ে গিয়ে ভাবতে চাই– থট রিডিং, মাইন্ড রিডিং, মানুষকে বশে আনার মত খেলা কি আর আজকাল একেবারেই হয় না? নিশ্চয়ই হয়। মানুষের মন পড়ার জন্য আছে বিভিন্ন উপায়। তার মধ্যে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি হল, অন্যের তথ্যে উঁকি দেওয়া, মানে খোঁজখবর। একজন ব্যক্তির চিন্তাভাবনা বা তার চেহারা, শারীরিক ভাষা এবং অন্যান্য সংকেতের উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত তথ্য জোগাড় করা। জাদুকরদের আর এক কৌশল হল, দর্শকের মধ্যে আগে থেকে তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া। নানারকম অকারণ কথা বলে, প্রশ্ন করে মনটাকে ঘুরিয়ে দেওয়া, বিভ্রান্ত করা। প্রয়োজনে সহকারীর সাহায্যে জাদুকরের নিজের ইচ্ছেগুলো জোর করে দর্শকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………
সবশেষে আসল কথাটাই খুলে বলি– আদ্যিকাল থেকেই সমাজে মানুষ অন্যকে কষ্ট দিতে, ভয় দেখাতে, অনিষ্ট করতে অথবা উপকার করতে, আনন্দ দিতে, ভালবাসতে যে কাজটা সবসময় করে আসছে সেটা হল, থট রিডিং বা মাইন্ড রিডিং। মানুষের শারীরিক ভাষা এবং মন না বুঝতে পারলে কাজগুলো করা অসম্ভব। পৃথিবীর সব মানুষই তাই এক একজন কমবেশি জাদুকর।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৫: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।