মেয়েদের শুচিতার বাতিকটি নিকোনো উঠোন, একশোবার ধুয়ে-মুছে সাফ বারান্দা-রান্নাঘর-বৈঠকখানা ছাড়িয়ে কদ্দুর যেতে পারে– তার কোনও আন্দাজই পশ্চিমা মহিলাদের নেই। প্রথমত, এই অভ্যাসটিকে এবং পায়ে হাতে ‘হাজা’ নামক ঘেয়ো নোংরামোকে স্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য নাগালের মধ্যে দু’চারটি পুকুর, খাল, বিল, নদী থাকা একান্তই জরুরি। খেয়াল করলে দেখবেন, এই প্রত্যেকটি লোকেশনে ভূত-পেতনি কিলবিল করছে, এবং সকলের পরনেই চট করে জলে নেমে টুক করে একটা ডুব দিয়ে আসার জুতসই পোশাক।
৩.
ভূশণ্ডির মাঠে নাদু মল্লিক যাঁদের দেখে ফিদা হয়েছিলেন, তাঁদের প্রথমটি শাঁকচুন্নি। তিনি ‘একটা গামছা পরিয়া আর একটা গামছা মাথায় দিয়া এলোচুলে বকের মতো লম্বা পা ফেলিয়া হাতের হাঁড়ি হইতে গোবর-গোলা জল ছড়াইতে ছড়াইতে’ মন মজিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বেটি ডাকিনী। তিনি সাদা থান জড়িয়ে খেজুরের ডাল দিয়ে ক্ষীরী-বামনীর পরিত্যক্ত ভিটার রোয়াক ঝাঁটাচ্ছিলেন। তবে প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেও, যাঁর সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা চলতেই পারে বলে নাদুর মনে হয়, তাঁর আপাদমস্তক ঘেরাটোপে ঢাকা। রাজশেখর বসু ফালতু শব্দ খরচ করার বান্দা নন। অতএব প্রেতলোকে সাফাই-কাজে পুরোদস্তুর মনোনিবেশের যে চিত্রটি তিনি এঁকেছেন, সেটি বাস্তবানুগ এবং বাহুল্যবর্জিত। এটি ভৌতিক বাস্তবতা নয়, জাদুবাস্তবতাও তখন গ্রামবাংলায় অনাবিষ্কৃত! এটি একেবারেই বাঙালির নিজস্ব প্রাত্যহিকতার ছবি। বাঙালি মহিলাদের ‘নোংরা’ এবং ‘অশুচি’ নিয়ে যে ভয়খানি আজন্ম ধোয়া-পাখলার ফলে জাতীয় আতঙ্কে পর্যবসিত, উনি আলগোছে সেইটিই গল্পের ফাঁকে বর্ণনা করেছেন মাত্র। তাতে ভূতেদের চিনতে সুবিধা হয়েছে, পাঠক শাড়ি গামছা জড়ানো, বারুণ, ন্যাতা, গোবর লেপার তোবড়ানো হাঁড়ি-সহ পরিবারের মহিলাদের গল্পের চরিত্র হয়ে উঠতে দেখে বারবার উল্লসিত হয়ে ‘ওই তো সেজ কাকিমা’, বা ‘এ তো দেখছি একেবারে মেজদিদা’ বলে সমস্বরে হেঁকে উঠেছে।
সার কথাটি হল, ঢেঁকি যখন স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, বাঙালি মহিলাদের প্রেতাত্মারাই বা সাফসুতরো থাকবেন না কেন? তাছাড়া ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে বাতিকটিকে ওঁয়ারা যে-কালে নিখুঁত শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন, তার খানিকটা পরকালের উঠোন-হেঁশেলে আমদানি করলেই বা ক্ষতি কী? পুরুষরাও যে কম যান, তা তো নয়! ছায়া না মাড়ানোর সুপ্রাচীন ঐতিহ্যটি ইদানীং তাঁদের কল্যাণে আসমুদ্রহিমাচল বেশ লাভজনক ব্যবসা। বাঙালি বামুন শূদ্রের পিছনে ঝাঁটা বেঁধে দেননি বটে, তবে হুঁকো-কল্কে থেকে নিমন্ত্রণ বাড়িতে পাত পাড়ার সময় অবধি সবেতে হিসেব কষে ভাগ-বাটোয়ারায় তার অদ্যাবধি বিশেষ উৎসাহ। মুখে বলেন ‘না’, এই যা।
আরও পড়ুন: তবু সে দেখিল কোন ডাইনোসর!
মেয়েদের শুচিতার বাতিকটি নিকোনো উঠোন, একশোবার ধুয়ে-মুছে সাফ বারান্দা-রান্নাঘর-বৈঠকখানা ছাড়িয়ে কদ্দুর যেতে পারে– তার কোনও আন্দাজই পশ্চিমা মহিলাদের নেই। প্রথমত, এই অভ্যাসটিকে এবং পায়ে হাতে ‘হাজা’ নামক ঘেয়ো নোংরামোকে স্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য নাগালের মধ্যে দু’চারটি পুকুর, খাল, বিল, নদী থাকা একান্তই জরুরি। খেয়াল করলে দেখবেন, এই প্রত্যেকটি লোকেশনে ভূত-পেতনি কিলবিল করছে, এবং সকলের পরনেই চট করে জলে নেমে টুক করে একটা ডুব দিয়ে আসার জুতসই পোশাক। বাংলাদেশে বালি দিয়ে বাসন মাজার অভিজ্ঞতা মা বোনেদের হয়নি– চোদ্দোবার চান করতে বারমেঢ়, জয়সলমেঢ় ইত্যাদি এলাকার মহিলাদের মতো প্রতি দফা যাতায়াতে কুড়ি-বাইশ মাইল পথ অতিক্রম করতে হলে শুচিতার আহ্লাদ পথিমধ্যে শুঁটকি মেরে ধুলোঝড়ে ক্রমশ সূক্ষ্মতর এবং ঝকঝকে সাফ হাড়গোড়ে পরিণত হত। অতএব নাকানিচোবানি-মূলক শুদ্ধতার বাতিকটি তারা ভেজা বাংলায়, যাকে বলে খুব সহজেই ‘অ্যাফোর্ড’ করতে পেরেছে।
দ্বিতীয়ত, সাফাই অভিযানে নামার কোনও একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে হাইজিনের সঙ্গে চিত্তশুদ্ধির আবশ্যিক সম্পর্ক রচিত হলে বাঙালি ব্যাপারটাকে ধর্মের দুর্ভেদ্য মোড়কে পুরে ফেলতে সক্ষম হয়। অতঃপর যুগে যুগে হিন্দু বাড়ির শুচিতা রক্ষা-পনার্থায় সম্ভবামি-মুসলমান অতিথিদের চায়ের কাপ-ডিশ বাথরুমে রাখা শুরু হয়। হিঁদুর বাড়ি, মুসলমানের হাঁড়ি বলে কথা– শাস্ত্র তো আর মিথ্যে হতে পারে না! অথচ উনিশ শতক থেকে আঁতুড় নিয়ে যে ক’টি লেখা মনে পড়ছে, সবক’টি সমান ভয়াবহ। তা সে ঠাকুরবাড়িই হোক বা সাধারণ গেরস্তের দু’কামরা বিশিষ্ট মঞ্জিল, আঁতুর থেকে জ্যান্ত মানুষ সন্তান-সহ বেড়াত এটাই আশ্চর্যের! অথচ বাঙালি গত শতাব্দীর গোড়াতেই সর্বত্র নোংরা আবিষ্কার করায় রীতিমতো মাহির হয়ে উঠেছে। তাঁর রুমাল প্যারিসের ধোপাবাড়ি থেকে কেচে আসছে, জমাদারের বাড়িতে প্রবেশের আলাদা সিঁড়ি, অভিধান থেকে রোজকার আরবি-ফারসি শব্দ বাদ পড়ছে বেশুমার। গন্ধটা খুব সন্দেহজনক সে বিষয়ে তর্কের অবকাশ নেই, কারণ শহরের শেষ খাটা পায়খানাটি আটের দশক অবধি চালু ছিল, মেথরদের যাতায়াত এবং ভোর রাতে ওয়েলিংটনের মোড়ে তাঁদের সঙ্গে বিপদপ্রাজ্ঞ মাতালদের ঝুটঝামেলাও লাগত প্রায় রোজই। আকণ্ঠ মদ্যপান করার ফলে বাহ্যজ্ঞান সম্পূর্ণ লুপ্ত অবস্থাতেও নেপালবাবুর যুক্তি ছিল অকাট্য! তিনি প্রতিদিন মেথরদের দাঁড় করিয়ে বলতেন, ‘আরে বাবা, যেখানে ফেলবি সেখানেই হাগিস না কেন? বালতি ভরে টানাটানি করে বেড়াতে লজ্জা হয় না?’
এই স্বর্ণযুগ থেকে মধ্যবিত্তের আলমারি, টেবিল ফ্যান, ভিআইপি নামক সুটকেস, সিলিং ফ্যান, শোকেস, কেরানিবাবুদের টিফিন কৌটো, জলের কুঁজো, স্কুটার, ১৬৫ লিটারের ফ্রিজ, পুরনো সরস্বতীর মূর্তি, ছেলের জন্মদিনে উপহার পাওয়া দুটো এক্সট্রা ওয়াটার বট্ল এবং বাঘ বা জেব্রার ছবিওলা চাইনিজ কম্বল ইত্যাদি প্রায় সমস্ত কিছুর ‘কভার’ অবধি পৌঁছনোর গল্পটিতে রোমাঞ্চ নেই। পৃথিবীর কোনও বিমা কোম্পানির বাপের ক্ষমতা ছিল না বাঙালির মতো এতরকমের কভার ভেবে ওঠা! সব বাড়িতে অতএব গত ৩০ বছর বেশ কিছু জিনিস কভার পরানো অবস্থাতেই ঝুলে আছে যাতে ধুলো পড়ে নষ্ট না হয়ে যায়। নিয়মিত সেগুলোর ধুলো ঝাড়া হয়, তবে ফেলে দেওয়ার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। এবং তার ফলে গাঙ্গেয় পশ্চিমবাংলায়, বিশেষ করে শহুরে জীবনে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠা, সাফাই অভিযানে পটু বাঙালির জীবনে তৃতীয় অধ্যায়ের সূত্রপাত – নোংরা, জঞ্জাল থেকে অনেকখানি সরে এসে ‘অদরকারি’ অর্থে আবর্জনার সঙ্গে ঘর করতে শেখা নব্য বাবু-বিবি হঠাৎ পাল্টে দিল সাফসুতরো থাকার আদত ধাঁচাটাকেই। পেয়ার দিওয়ানা হোতা হ্যায়, মস্তানা হোতা হ্যায় রে ভাই!