অদূর ভবিষ্যতে যিনি কিনা পর্দা কাঁপাবেন, বিশ্বের প্রথম সারির সুপুরুষদের তালিকায় যাঁর নাম উঠবে, গ্রাম-থেকে-আসা ধর্মেন্দ্র প্রথম দিন শুটিংয়ে অন্তর্বাস পরে আসেননি। শহরে আসার আগে তিনি কখনও মোজাও পরেননি। লিখছেন অম্বরীশ রায়চৌধুরী ও উদয়ন ঘোষচৌধুরি।
সালটা ১৯৫৮। হিন্দি সিনেমার দুনিয়া কাঁধে ধরে রেখেছেন তিন স্তম্ভ– রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার। কিন্তু, দূরদর্শীরা বুঝেছিলেন, যে কোনও চলমান ইন্ডাস্ট্রির মতো, সিনেমাতেও তাজা রক্তের জোগান সবসময়েই দরকার। অচিরে, ফিল্মফেয়ার ঘোষণা করল তারা একটা ট্যালেন্ট হান্ট কন্টেস্ট স্পনসর করবে।
পাঞ্জাবের ফাগওয়ারা গ্রামে এক জাট যুবক কল্পনা করতেন তিনিও একদিন নায়ক হবেন। অথচ, কস্মিনকালে তিনি স্টেজে ওঠেননি, কোনও ধরাবাঁধা ট্রেনিং নেননি কোথাও। ফিল্মি পত্র-পত্রিকায় বা সিনেমার পোস্টারে নায়ক-নায়িকাদের ছবি দেখতেন, আর ভাবতেন একদিন তাঁকেও ওভাবে দেখা যাবে। সে যুগের, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের, রীতি অনুযায়ী ততদিনে তাঁর বিয়ে-থা হয়ে, এক ছেলে হয়ে গিয়েছে। প্রতিযোগিতা হবে শুনে, যুবক বুঝলেন স্বপ্ন সাকার করার এই একমাত্র সুযোগ! দিনরাত বিড়বিড় করে নিজেকে বলতে থাকলেন, ‘আভি নেহি তো কভি নেহি!’ তাঁর একমাত্র সহায় ছিল সুচারু পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, লোকজনকে দেখে ভাবভঙ্গি নকল করতে পারতেন। আর, সম্বল বলতে, ছিল দীর্ঘ পেটাই চেহারা।
প্রতিযোগিতার পিছনে মূল মাথা ছিলেন দু’জন– বিমল রায় আর গুরু দত্ত। তাঁরা যুবককে ডেকে পাঠালেন বম্বেতে। গুরু দত্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নতুন সুদর্শন নায়ককে নিয়ে বানাবেন ‘বাহারেঁ ফির ভি আয়েঙ্গি’। কিন্তু, বিধি বাম। শুটিং শুরু হওয়ার আগেই গুরু দত্ত মারা গেলেন। পরে, সেটা পরিচালনা করেছিলেন শহিদ লতিফ। বিমল রায় সেই যুবককে ডাকলেন স্ক্রিন টেস্টের জন্য, মোহন স্টুডিওতে। সেখানে তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন গুলজার, দেবু সেন, রঘুনাথ ঝালানির মতো তুখোড় মানুষ। যুবককে কয়েকটা দৃশ্যের সংলাপ দেওয়া হল; তিনি জান-প্রাণ লড়িয়ে নিজেকে নিংড়ে দিলেন। ওদিকে, প্রযোজক-পরিচালক রায়বাবু সর্বক্ষণ শুধু চেস্টারফিল্ড সিগারেট ফুঁকতেই ব্যস্ত রইলেন। যুবকের কাজ দেখে স্টুডিওর কেউ-ই কোনও প্রতিক্রিয়া দিলেন না। জাট যুবক মুষড়ে পড়লেন, তাহলে কি কিছুই হল না! তাহলে কি আবার গ্রামে ফিরে গিয়ে চাষবাস-ই করতে হবে!
নিজের কাজ সেরে, স্টুডিওর এক কোণে মনমরা বসেছিলেন যুবক। একদিক থেকে আরেক দিকে হন্তদন্ত যেতে যেতে, ওভাবে তাঁকে দেখে দেবু সেন ইশারায় বললেন, ওপরতলায় যাও! দুরুদুরু পায়ে যুবক ওপরে পৌঁছে দেখলেন, সেটা বিমল রায়ের অফিসঘর। পাশে একটা ছোট্ট লকার রাখা। একজন কর্মচারী এসে, লকার খুলে, বিমলবাবুকে দুপুরের খাবার বেড়ে দিয়ে গেলেন। বিমলবাবু টেবিলে মাথা গুঁজে কিছু একটা লিখছিলেন; মাথা তুলে নবাগতকে দেখে ডাকলেন, ‘আও ধর্মেন্দু, আও…’ যুবক মিনমিনে গলায় আপত্তি জানালেন, ‘দাদা, মেরা নাম ধর্মেন্দর হ্যায়…’ সাংঘাতিক সফল পরিচালক প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে জোর গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা-ই তো বলছি, ধর্মেন-দু… আও, তুমহারা বউদি নে আজ মাছের ঝোল ভেজা হ্যায়, খাও…’
ধর্মেন্দ্র তখন মনে মনে বিপদ গুনছেন, ভাবছেন এঁরা কেউ অডিশনের রেজাল্ট নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করছেন না কেন! কোনওরকমে, ঢোক গিলে, তিনি খেতে বসলেন। ওদিকে বিমলবাবু যেন খেতে ও খাওয়াতেই মশগুল। এটা সেটা নিয়ে নানা কথা বলতে বলতে, খাওয়ার মাঝপথে, ফস করে বলে উঠলেন, ‘শুনো, তুম বন্দিনী কর রহে হো…’ শুনে, ধর্মেন্দ্র হাঁ; খুশিতে তাঁর খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।
শুরু হল ‘বন্দিনী’-র শুটিং। একটা দৃশ্যে নায়কের পরনে ছিল স্যুট, পরের দৃশ্যে পরনে থাকবে ধুতি। কস্টিউম ডিপার্টমেন্টে ড্রেসম্যান ছিলেন ভোঁসলে, তিনি ধর্মেন্দ্রকে ধুতি পরতে সাহায্য করছিলেন। আচমকা ভোঁসলের হাত লেগে গেল বেজায়গায়। ড্রেসম্যান আঁতকে উঠলেন; বেজায় বিরক্ত হলেন; মুহূর্তে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, ‘এ কী! ছিঃ ছিঃ! তুমি জাঙিয়া পরো না?’ অদূর ভবিষ্যতে যিনি কিনা পর্দা কাঁপাবেন, বিশ্বের প্রথম সারির সুপুরুষদের তালিকায় যাঁর নাম উঠবে, ‘বলিউডের হি-ম্যান’ গ্রাম-থেকে-আসা ধর্মেন্দ্র তখন আসলে অন্তর্বাসের ঠিকঠাক ব্যবহারটাই বুঝতেন না; শহরে আসার আগে তিনি কখনও মোজাও পরেননি। যুবক ফের চোখে অন্ধকার দেখলেন, ড্রেসম্যান যদি এবার রায়বাবুর বা তাঁর কোনও অ্যাসিস্ট্যান্টের কানে নালিশটা তুলে দেন! কেলেঙ্কারি হবে!
ধর্মেন্দ্র কাকুতিমিনতি জুড়লেন ভোঁসলের কাছে; প্রায় হাতে-পায়ে ধরে বললেন, ‘এখন আপনিই আমার ভগবান! প্লিজ, ব্যাপারটা একটু সামলে দিন!’ রাগে গজগজ করতে করতে সেই ড্রেসম্যান, সেদিন আন্ধেরির বাজার থেকে, নায়কের আন্ডারওয়্যার কিনে এনেছিলেন। তারপর থেকে, যখনই কোনও টেক ‘ওকে’ হয়ে যেত, ধর্মেন্দ্র হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে ডাকতেন তাঁকে, ‘আও ভোঁসলেসাব, আমাকে ধুতি পরিয়ে দিয়ে যাও…’
যদিও ধর্মেন্দ্র বম্বে এসেছিলেন বিমল রায়ের ডাকে, তবে ‘বন্দিনী’ মুক্তি পাওয়ার আগেই তাঁর আরও ছ’টা সিনেমা রিলিজ হয়েছিল। সেই জাট যুবকের ছটা এখনও অমলিন।
১৯২৫ সালের মে মাসে ফরিদপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণে চিত্তরঞ্জন দাশ ঘোষণা করলেন যে, সরকারের সঙ্গে সম্মানজনক সহযোগ করতে তিনি প্রস্তুত। নেতৃত্বের মোহ যখন মানুষকে আচ্ছন্ন করে তখন মহৎ মানুষের অবদান বা তাঁর থেকে দেশের আরও প্রাপ্তি আমরা বিস্মৃত হই না কি?