প্রথমবার অনুষ্ঠানের আগে জেলের ভেতরে সে কী হইহই ব্যাপার। নিমেষে বদলে গেল চারপাশ। চারিদিকে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে, চারিদিকে সে কী ব্যস্ততা। এদিকে কস্টিউম তৈরি হচ্ছে তো অন্যদিকে ডান্ডিয়া তৈরি হচ্ছে।
২.
সবাই যে নাচ করছে, তা নয়। একটি ছেলে ছিল ওদের মধ্যে, যে নিজের মতো গান লিখত, গাইত। মাঝে মাঝে এসে আমাকে গান শোনাত। কবিতাও লিখত একজন। আমাকে নানা কিছু লিখে দিত। প্রথম যে কবিতাটা আমাকে লিখে দিয়েছিল সে, আমার আজও মনে আছে– ‘তুমি আসলে পাথরেও ফুল ফোটে।’ তারপর ধীরে ধীরে কবিতার সঙ্গে সে ছবি আঁকাও শুরু করেছিল। যে ছেলেটি গান গানত, তাকে আমি বললাম একটা নতুন গান লিখে ও সুর দিতে। সে দু’দিনে করে ফেলেছিল। আমরা রেকর্ডিং করলাম সেই গানটা। তারপর ওই গানেই নাচ জুড়ে দিলাম। জুড়ে দিলাম ডান্ডিয়া, ভাংড়া, বাউল নাচ, সাঁওতাল নাচ, রবীন্দ্র নৃত্য। প্রায় ৫০ মিনিটের একটা পারফরম্যান্স। বুঝতে পারলাম, এবার আমরা প্রস্তুত স্টেজে ওঠার জন্য। ততদিনে সাত মাস কেটে গিয়েছে। ঠিক করলাম অনুষ্ঠানটা ভেতরেই করব।
ওদের মধ্যে একজন ছেলে খুব ভাল সেলাই জানত। ওকেই দায়িত্ব দিলাম কস্টিউম বানানোর। ও কাপড় কেটে দিত, অনেকে মিলে সেলাই করত সেগুলো। এখনও ওই-ই আমাদের সব কস্টিউম বানায়। ওর জন্যই আমার প্রথম বড়বাজার যাওয়া। ও যেমন যেমন বলে দিয়েছিল, তেমন তেমন কাপড় কিনে আনলাম। জেলের ভেতরটা নিমেষে বদলে গেল। চারিদিকে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে, চারিদিকে সে কী ব্যস্ততা। এদিকে কস্টিউম তৈরি হচ্ছে তো অন্যদিকে ডান্ডিয়া তৈরি হচ্ছে।
আমি তখনও নতুন, জেলের সব নিয়মকানুন জানি না। জানতে পারলাম ছেলেরা আর মেয়েরা নাকি একসঙ্গে একই জায়গায় আগে কখনও আসেনি। ফলে ভেতর থেকে নানা বাধা এল। অনুষ্ঠানটা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তবে কিছু মানুষও ছিলেন, যাঁরা সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন যাতে অনুষ্ঠানটা হয়। সে কারণেই এটা এগতে পেরেছে। তারপর দেখলাম, জেলের ভেতর এটা সত্যি বড় একটা ইস্যু। ছেলেরা যদি মেয়েদের জন্য জল এনে দিত, সেটা আগে আমার হাতে দেবে, আমি সেটা মেয়েদের হাতে দেব। ক্যান্টিন থেকে খাবার আনলেও আনলেও একই পদ্ধতিতে দেওয়া-নেওয়া হত। বুঝলাম ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা আলাদাভাবে ডান্ডিয়ায় নাচাতে হবে। আলাদা রো করে দিলাম ওদের জন্য, যাতে বাইরে থেকে কেউ আর অসুবিধা জানাতে না পারে। ছেলেরা ছেলেদের সঙ্গে, মেয়েরা মেয়েদের সঙ্গে।
শুনেছিলাম, মেদিনীপুর জেলের কয়েকজন ছৌ নাচ নাচতে পারে। আমি গেলাম মেদিনীপুরে। ওদেরকে নিয়ে এলাম কলকাতায় এই অনুষ্ঠানটটার জন্য। তবে ওরা আর ফেরত যায়নি। এরপর তো অনুষ্ঠান লেগেই থাকত, তাই ওরা আর ফিরে গেল না। এই জেলেই ওদের স্থান হল।
শেষমেশ অনুষ্ঠানটা হওয়ার দিন এগিয়ে এল। বাইরে থেকে পাঁচজন এসেছিলেন। এর বেশি লোকের অনুমতি ছিল না। সেই পাঁচজনের মধ্যে আমার মা-ও ছিলেন। সন্ধেবেলা অনুষ্ঠানটা শুরু হল। দেখতে এল কনভিক্টরা। আন্ডার ট্রায়ালদের আসতে দেওয়া হয়নি। অনুষ্ঠানটা হওয়ার পর বাইরে থেকে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন বললেন, আমরা উদয়শঙ্কর ডান্স ফেস্টিভ্যালে কেন এই পারফরম্যান্সটা করছি না? আমার উত্তর ছিল সেদিন, করতে দিলেই আমি করব। মি. শর্মাকে বলা হল। উনি এককথায় রাজি হয়ে গেলেন।
প্রথমবার আমাদের বাইরে আসার প্রস্তুতি শুরু হল। রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠান। প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা গার্ড। বাসে করে যাওয়া হচ্ছে। আমিও এদের সঙ্গেই যাচ্ছি। সবার বিশ্বাস ছিল, আমি গেলে কোনও দুর্ঘটনা ঘটবে না। আমি বসলাম ওদের সঙ্গে। পৌঁছলাম রবীন্দ্র সদনে। গোটা অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকবার ড্রেসচেঞ্জ ছিল। কিন্তু মঞ্চের পাশে ড্রেসচেঞ্জের অনুমতি ছিল না ওদের, ওই জায়গাটা অন্ধকার বলে। সাইডের করিডোরে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে ওদের জন্য। এই উইংস থেকে ওই উইংস-এ যাচ্ছে গার্ডের হাত ধরেই। তার মধ্যেই ওরা করল। সেবার আমি নাচিনি। কিন্তু পরেরবার থেকে আমাকে করতেই হল। ওরা সবাই চাইল ওদের সঙ্গেই আমি মঞ্চে উঠি। অনুষ্ঠানটা শেষ হওয়ার পর, কার্টন কলের মিউজিক ছিল। ৭ মিনিট কেটে গিয়েছে, মিউজিক শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু হাততালি আর থামছে না। সবাই স্ট্যান্ডিং অবেশন দিচ্ছে। গোটা দর্শকাসন দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেদিনের ওই অনুভূতি আমি কখনও ভুলব না। সেদিন আর গৌড়প্রাঙ্গনে ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ করা– এই দুটো দিন আমি কোনও দিন ভুলব না। আমার সঙ্গে থেকে যাবে চিরকাল।