আজকের দিনে ভারতে ধর্ম নিয়ে ভেদ-বিভেদ, তা ওই সময়ে দাঁড়িয়ে বিসমিল্লার মধ্যে একফোঁটাও ছিল না। বিসমিল্লা বলেছিলেন, আমি সকালে গঙ্গাস্নান করি, তারপর মসজিদে নমাজ পড়ি, তারপর আমি বালাজি মন্দিরে গিয়ে সারাদিন সানাই বাজাই। এই পুরো ব্যাপারটাকেই একটা সাংগীতিক যাত্রা হিসেবে দেখতেন তিনি, যেখানে ধর্মকে আলাদা, বিচ্ছিন্ন করে দেখতেন না। বিসমিল্লা যখন বালাজি মন্দিরে বাজনা বাজিয়ে ধানমুণ্ডির মধ্য দিয়ে যেতেন, সেই ধানমুণ্ডিতে রসুলন বাই, সিদ্ধেশ্বরী বাই– এঁরা গান গাইতেন। বিসমিল্লা বলেছিলেন, যখন ধানমুণ্ডি দিয়ে যেতাম, আমার কান পবিত্র হয়ে যেত সেই সংগীত শুনে।
১৪.
১৯৮৯ সাল। গৌতম ঘোষ তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন বিসমিল্লাকে নিয়ে। নাম: ‘মিটিং অ্যা মাইলস্টোন’। এই ছবির কাজে ডাক পড়েছে আমারও। কিন্তু সেবার বেনারস পৌঁছতে খানিক দেরি হয়েছিল। কলেজের ফাইনাল পরীক্ষা মিটিয়ে হাজির হতে এক-দু’দিনের বিলম্ব। সেবার আমি বেনারসে গিয়েছিলাম ৮-১০ রোল ফিল্ম নিয়ে। রশিদ খান বিসমিল্লাকে ইন্টারভিউ করছিল। রশিদের ঘাম হচ্ছিল, আর তা বারেবারেই মুছে দিচ্ছিলাম আমি। মেক-আপ ম্যানের কাজ, শট লেখার কাজ ছাড়াও শুটিংয়ের অন্যান্য কাজ করতে হয়েছিল সে যাত্রায়। এতসব করেও আমি ছবি তুলেছিলাম। কিছু ছবি তখনই ব্যবহার করা হয়েছিল। আর বাকি ছবিগুলো ‘প্রতিক্ষণ’ থেকে প্রকাশিত ‘গৌতম ঘোষের বিসমিল্লা ও বানারস’ বইতে ব্যবহার করা হয়েছিল।
সেবারে ইউনিট ছিল দুটো। একটা ইউনিটে ৩৫ এমএম ক্যামেরা। আরেকটা ছোট ইউনিট ছিল যারা ১৬ এমএম-এ শুট করছিল। বিসমিল্লা বেনারসের যে যে জায়গা নিয়ে কথা বলছিলেন, সেসব জায়গার শুট করত এই দ্বিতীয় ইউনিট। আর বিসমিল্লার বাড়ির শুটটা হত ৩৫-এ। দুটো ইউনিটেই আমি কাজ করে চলেছিলাম সমান্তরালে।
আমার কাছে বিসমিল্লার তথ্যচিত্রটা খুবই জরুরি, কারণ সেই প্রথম কোনও ছবিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আমার নাম গিয়েছিল।
আজকের দিনে ভারতে ধর্ম নিয়ে ভেদ-বিভেদ, তা ওই সময়ে দাঁড়িয়ে বিসমিল্লার মধ্যে একফোঁটাও ছিল না। বিসমিল্লা বলেছিলেন, আমি সকালে গঙ্গাস্নান করি, তারপর মসজিদে নমাজ পড়ি, তারপর আমি বালাজি মন্দিরে গিয়ে সারাদিন সানাই বাজাই। এই পুরো ব্যাপারটাকেই একটা সাংগীতিক যাত্রা হিসেবে দেখতেন তিনি, যেখানে ধর্মকে আলাদা, বিচ্ছিন্ন করে দেখতেন না। বিসমিল্লা যখন বালাজি মন্দিরে বাজনা বাজিয়ে ধানমুণ্ডির মধ্য দিয়ে যেতেন, সেই ধানমুণ্ডিতে রসুলন বাই, সিদ্ধেশ্বরী বাই– এঁরা গান গাইতেন। বিসমিল্লা বলেছিলেন, যখন ধানমুণ্ডি দিয়ে যেতাম, আমার কান পবিত্র হয়ে যেত সেই সংগীত শুনে।
আমি যেটুকু দেখেছি, এমন অসামান্য লোক প্রায় দেখিনি বললেই চলে! কেন জানেন? তবে একটা ছোট্ট ঘটনা বলি।
একটা লম্বা ট্রলি শট হচ্ছে। শটের মাঝে মাঝে খট খট করে আওয়াজ পাচ্ছি আমরা। বোঝা যাচ্ছে, কীসের আওয়াজ– কিন্তু শট চলছে বলে তা আর আটকানো হয়নি। আসলে সেই শব্দ করছিল গৌতমদার ছেলে, ঈশান, তখন সে খুবই ছোট। ট্রলির কাঠের টুকরো সে একে একে ফেলছিল। শটটা ‘কাট’ হওয়ার পর ওকে বকাঝকা করা হয়। রাতারাতি সে বেচারা কাঁদতে শুরু করে। বিসমিল্লা তখন জিজ্ঞেস করেন, ‘ও কাঁদছে কেন?’ বলা হয়, ‘আপনার শটের মাঝে, দূরে একটা জিনিস ফেলছিল ছুড়ে, ফলে আওয়াজ আসছিল।’ বিসমিল্লা জবাব দেন, ‘হ্যাঁ, আমি তো জানি একটা আওয়াজ হচ্ছিল, কিন্তু ওই আওয়াজটা এক্কেবারে তালে ছিল।’
এইরকমই ছিলেন বিসমিল্লা! তাঁর গ্রহটা আমাদের নীল রঙের গ্রহের মতো নয়। সেই গ্রহ তৈরি হয়েছিল তাল ও সুর দিয়ে। তিনি থাকতেন সেখানেই, মাঝে মাঝে হয়তো আমরা ঢুকে পড়তে পারতাম, এইটুকুই, তার বেশি কিছু নয়।
…ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৩। মৃণাল সেনকে এক ডলারেই গল্পের স্বত্ব বিক্রি করবেন, বলেছিলেন মার্কেস
পর্ব ১২: পুরনো বাড়ির বারান্দায় মগ্ন এক শিল্পী
পর্ব ১১। প্রায় নির্বাক গণেশ পাইন আড্ডা মারতেন বসন্ত কেবিনে
পর্ব ১০। আজাদ হিন্দ হোটেল আর সুব্রত মিত্রর বাড়ির মধ্যে মিল কোথায়?
পর্ব ৯। শান্তিনিকেতনের রাস্তায় রিকশা চালাতেন শর্বরী রায়চৌধুরী
পর্ব ৮। পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved