রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
Published by: Robbar Digital
Posted on: March 5, 2024 4:52 pm
Updated: March 5, 2024 5:05 pm
রণেনকাকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসে তুলছ?’ বললাম, ‘ফিল্মে।’ আমি যেভাবে ছবি তুলি, খানিক কথা বলে, ডিরেকশন দিয়ে– এখানে বসুন, ওখানে বসুন, এখানে আলোটা ঠিক আসছে না, ইত্যাদি প্রভৃতি। রণেনকাকা খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব কথা শুনেছিলেন। একবিন্দু বিরক্ত হননি। পরে ছবিটা প্রিন্ট করে দিয়েছিলাম যখন, ভীষণ খুশি হয়েছিলেন! ওই ফোটোগ্রাফ নিয়েও অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, সেসবই ছবির টেকনিক্যাল ব্যাপার। সবথেকে বড় কথা, ছবি তুলতে গিয়ে বুঝেছি, ওঁর কোনও ‘শিল্পীর ইনসিকিউরিটি’ ছিল না
সঞ্জীত চৌধুরী
৩.
১৯৯৯ সাল। শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে। পাড়ায় পাড়ায় ইতিউতি গজিয়ে উঠছে সাইবার ক্যাফে। বিশ্বের একমাথা থেকে আরেকমাথায় ধাঁ করে চলে যাচ্ছে ডকুমেন্ট, ছবি, কথাবার্তা, ভালোবাসা-অপ্রেম। এই হঠাৎ বদলে যাওয়া দেখছিলাম। খবর পেলাম, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডিলিট দেওয়া হচ্ছিল কয়েকজনকে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মৃণাল সেন, গিরিজা দেবী, বসন্ত চৌধুরী এবং রণেন আয়ন দত্ত। আমার বাবা, বসন্ত চৌধুরী, আমাকে বললেন, ‘আমাকে ডিলিট দিচ্ছে রবীন্দ্রভারতী। তুমি যাবে?’ ‘না’ করার কোনও প্রশ্নই নেই! সঙ্গে গেলাম। সেই অনুষ্ঠানেই দেখা রণেন আয়ন দত্তর সঙ্গে। বলা ভালো, ঠিক করে পরিচয় সারা হল। তিনি আমাকে হয়তো প্রথমবার দেখেছিলেন এই ঘটনার বছর ১০ আগে।
আমার বাবা হাতে-গোনা মাত্র কয়েকজনকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন। সেই মাত্র ক’জন ‘তুই’-এর মধ্যে একজন– রণেন আয়ন দত্ত। রণেনকাকাও অবশ্য ‘তুই’ই বলতেন বাবাকে। ওঁদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল গত শতকের মধ্য পঞ্চাশে– দু’জনেই যখন ব্যাচেলার। যদিও আমার সঙ্গে রণেনকাকার যোগাযোগ দীর্ঘকাল গড়ে উঠেনি, কারণ বাবার বাকি বন্ধুদের মতো তিনি আমাদের বাড়িতে প্রায়শই আসতেন বা গল্প করতেন, এমন নয়। কর্মসূত্রে বাইরেই অনেকটা সময় কাটিয়েছেন রণেনকাকা।
আমি যেভাবে ছবি তুলি, খানিক কথা বলে, ডিরেকশন দিয়ে– এখানে বসুন, ওখানে বসুন, এখানে আলোটা ঠিক আসছে না, ইত্যাদি প্রভৃতি। রণেনকাকা খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব কথা শুনেছিলেন। একবিন্দু বিরক্ত হননি। পরে ছবিটা প্রিন্ট করে দিয়েছিলাম যখন, ভীষণ খুশি হয়েছিলেন! ওই ফোটোগ্রাফ নিয়েও অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, সেসবই ছবির টেকনিক্যাল ব্যাপার। সবথেকে বড় কথা, ছবি তুলতে গিয়ে বুঝেছি, ওঁর কোনও ‘শিল্পীর ইনসিকিউরিটি’ ছিল না– কথায় মিশে ছিল স্নেহের পরশ।
বল এসে পড়ল আমার কোর্টে। আমার বেডরুমে সত্যিই ছবিটা রয়েছে। বহু বছর ধরে, এমনকী, এখনও। প্রসঙ্গ আসায় ছবিটা নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম আমি। অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল ওই ছবিটা নিয়ে। স্ট্রোক, ছবির আলো ইত্যাদি ইত্যাদি। সেসব জিজ্ঞেস করছি, আর রণেনকাকা যথাযথ কৌতূহল মেটাচ্ছেন। একসময় বললেন, ‘তুমি তো আর্টিস্টের মতো কথা বলছ।’
জানালাম, ‘না, আমি আর্টিস্ট নই।’
‘কিন্তু তুমি তো শিল্পীর মতো করেই ছবিটার কথা বললে।’
আমি বললাম, ‘আসলে ছবিটা খুব প্রিয়। তাই এতসব প্রশ্ন ছিল আমার।’
রণেনকাকা তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘এই ছবিটা তোমার বাবার কোনও দিনই ছিল না। এই ছবিটা এখন আমিই তোমায় দিলাম।’
আমার-রণেনকাকার যোগাযোগের এই শুরু। যদিও রণেনকাকার তুইতোকারি বন্ধু, আমার বাবা, চলে গেলেন ২০০০ সালে। সেসময় ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল বার দুয়েক, ফোনে। পরে একদিন বলেছিলাম, ‘আপনার বাড়ি যেতে চাই, কাজ দেখতে।’ উনি রাজি। দিনক্ষণ ঠিক করে গেলাম। বেশ অনেকটা সময় কাটালাম। দেখলাম, স্টুডিওয় বসে কীরকমভাবে স্কেচ করছেন রণেন আয়ন দত্ত। ওঁর প্রবল জীবনীশক্তি, উচ্ছলতা কথা বললেই টের পেতাম। একদিন বললাম, ‘আপনার ছবি তুলতে চাই।’
রণেনকাকা রাজি। ওঁর যে ছবি উঠবে, সেজন্য নিজেকে প্রস্তুত করে রাখবেন, ছবির জন্য তৈরি হবেন আর কী।
গেলাম ওঁর বাড়ি। এইবার ছবি তুলতে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসে তুলছ?’ বললাম, ‘ফিল্মে।’ আমি যেভাবে ছবি তুলি, খানিক কথা বলে, ডিরেকশন দিয়ে– এখানে বসুন, ওখানে বসুন, এখানে আলোটা ঠিক আসছে না, ইত্যাদি প্রভৃতি। রণেনকাকা খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব কথা শুনেছিলেন। একবিন্দু বিরক্ত হননি। পরে ছবিটা প্রিন্ট করে দিয়েছিলাম যখন, ভীষণ খুশি হয়েছিলেন! ওই ফোটোগ্রাফ নিয়েও অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, সেসবই ছবির টেকনিক্যাল ব্যাপার। সবথেকে বড় কথা, ছবি তুলতে গিয়ে বুঝেছি, ওঁর কোনও ‘শিল্পীর ইনসিকিউরিটি’ ছিল না– কথায় মিশে ছিল স্নেহের পরশ।
একটা কথা না বললেই নয়। ওঁর বাড়ির কথা। ডোভার রোড, গড়িয়াহাটের কাছে। নিজেরই করা। একটা ছোট্ট জমি, যে জমি হয়তো পৃথিবীর কেউ কিনত না টাকাপয়সা দিয়ে। কিন্তু রণেনকাকা কিনেছিলেন। এবং সেখানে যে বাড়িটা তৈরি করেছিলেন, তা ছিল দেখার মতো! ভেতরের স্পেসটা পুরোটাই ভার্টিক্যাল। পুরোটাই সিঁড়ি আর ঘর।
৩ মার্চ, রবিবার, সন্ধেবেলা সিঁড়ি দিয়ে এমন এক ঘরে তিনি চলে গেলেন, যে ঘরে কোনও জীবিত মানুষ প্রবেশ করতে পারে না।