হুসেন-রাধাপ্রসাদ বন্ধু, তাছাড়া এই যে কলকাতা নিয়ে ছবি আঁকছিলেন হুসেন, তার তথ্য, নকশা, বই বৃত্তান্ত– এই সবই জোগাড় করে দিতেন আর.পি.। দাদা কথা বলল হুসেনের সঙ্গে, আমি ছবি তুললাম। কাজ শেষ করে দাদা বেরিয়েও গেল অ্যাস্টর থেকে। কিন্তু রয়ে গেলাম আমি। সারাদিন ধরে হুসেনের নানারকম ছবি তুলতে থাকলাম। বড় একটা ছবির সামনে হুসেন বসে আছেন, কাজ করছেন, এমন একটা ছবি তুলতে গিয়ে মনে হল ফ্রেমটা ঠিক জমছে না। হুসেনকে বললাম, ‘আপনি ছবিটার সামনে একটু শুয়ে পড়বেন?’ এককথায় হুসেন রাজি। শুয়ে পড়লেন তক্ষুনি!
৭.
১৯৯০। কলকাতা জুড়ে তখন হইচই রব। কী না, কলকাতার ৩০০তম জন্মদিন। চাদ্দিকে নানা অনুষ্ঠান, লেখালিখি। ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট, জব চার্নক এই কলকাতা আবিষ্কার করেছিলেন, ফলে ওই তারিখটাই কলকাতার জন্মদিন– এরকম তত্ত্বে তখনও কেউ নারাজ বা দ্বিমত হননি। পরে, এই তথ্য খারিজ করা হয়। যদিও সেই ৩০০ বছরের ভুল জন্মদিনের কলকাতাকে উপলক্ষ করেই আমার একখানা ছবি তোলা হয়েছিল। তাও মকবুল ফিদা হুসেনের।
অ্যাস্টর হোটেলের একটা বড় সুইট পেয়েছিলেন হুসেন। সারাদিন কলকাতা বিষয়ক ছবি আঁকছেন। আমার দাদা সৃঞ্জয় চৌধুরী তখন একটি জনপ্রিয় সংবাদসংস্থার হয়ে এই স্টোরিটা করতে যাবে। দাদা বলল, “তুমি চলো, ক’টা ছবি তুলে দেবে।’’ হুসেনের ছবি, না করার কোনও কারণই নেই। দাদার সঙ্গে চললুম অ্যাস্টর হোটেল।
তবে, সেটাই হুসেনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় নয়। এর আগে রাধাপ্রসাদ গুপ্তর বাড়িতে যৎসামান্য সাক্ষাৎ হয়েছিল। হুসেন-রাধাপ্রসাদ বন্ধু, তাছাড়া এই যে কলকাতা নিয়ে ছবি আঁকছিলেন হুসেন, তার তথ্য, নকশা, বই বৃত্তান্ত– এই সবই জোগাড় করে দিতেন আর.পি.। দাদা কথা বলল হুসেনের সঙ্গে, আমি ছবি তুললাম। কাজ শেষ করে দাদা বেরিয়েও গেল অ্যাস্টর থেকে। কিন্তু রয়ে গেলাম আমি। সারাদিন ধরে হুসেনের নানারকম ছবি তুলতে থাকলাম। বড় একটা ছবির সামনে হুসেন বসে আছেন, কাজ করছেন, এমন একটা ছবি তুলতে গিয়ে মনে হল ফ্রেমটা ঠিক জমছে না। হুসেনকে বললাম, ‘আপনি ছবিটার সামনে একটু শুয়ে পড়বেন?’ এককথায় হুসেন রাজি। শুয়ে পড়লেন তক্ষুনি!
মনে আছে, উত্তম-সুচিত্রার একটা ছবিও আঁকছিলেন হুসেন। মন থেকে অবশ্য নয়। একটা ফোটোগ্রাফ থেকে। কোনও একটা ছবিতে একসময় হুসেনের দরকার পড়ল বাংলা অক্ষরের। হুসেন তো বাংলা লিখতে জানেন না। আমাকে বললেন, ‘এই অক্ষরটা তুমি বাংলায় লিখে দেবে?’ আমার ক্যালিগ্রাফিটা একটু আজব গোছের। কিন্তু তাই-ই করে দিলাম। সেটা যখন হুসেন কপি করলেন, বিশ্বাস করুন, এ যেন একেবারে ফোটোকপি! এক মুহূর্তের মধ্যে নকল করে ফেললেন ওই হাতের লেখা!
সারাদিন ছবি-টবি তুলে ফিরে এলাম বাড়ি। আমার বাবা, বসন্ত চৌধুরীকেও বললাম এই কাণ্ডকারখানা। দু’-একদিন পর পোস্টকার্ডের থেকে খানিক বড় একটা রিপ্রেজেন্টেটি প্রিন্ট করিয়েছিলাম হুসেনের একটা ছবির। বাবাকে দেখালামও ছবিখানা। বাবা বলল, ‘আমাকে তুমি ছবিটা দেবে?’ মনে মনে ক্ষুণ্ণই হলাম, একটা ছবি সবে ছাপালাম, সেটাও নিয়ে নিচ্ছে! তাও বাবা চেয়েছে, দিলাম। কিন্তু শুধু ছবি নিয়েও বাবা ক্ষান্ত হয়নি, বলল, ‘আমাকে খামটাও দাও।’ ফাঁকা খাম নিয়ে কী-ই বা করতাম। দিলাম বাবাকে।
সেদিনই রাতে, ১১টা কি সাড়ে সাড়ে ১১টা– আমি জেগেই রয়েছি। বাবা ডাক পাড়ল। দেখি– বাবার হাতে সেই খামটা। আমাকে ফেরত দিয়ে দিল। খুলে দেখলাম, তার ভেতরে আমার তোলা হুসেনের ছবিটাও দিব্যি অক্ষত। শুধু ছবির পিছনে যুক্ত হয়েছে মকবুল ফিদা হুসেনের অপূর্ব স্বাক্ষর।
(চলবে)
…ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
পর্ব ১। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল