ভারত-পাকিস্তানের জিঘাংসার ইতিহাস, বন্দুক-কামানের সংঘর্ষের ইতিহাস থেকে যাবে তার মতো। কিন্তু সমান্তরাল পৃথিবীতে সুধীর গৌতম, বসির চাচারাও থেকে যাবেন তার প্রতিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে। নাহ্, ভাবার কারণ নেই যে, মাঠে সুধীর বা বসির, কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেন। কিন্তু এঁরা ওই পর্যন্তই, ওই খেলা পর্যন্তই। খেলা শেষ হলে এঁরা বেমালুম ভুলে যান সব, উগ্র দেশাত্মবোধের ‘শব’ মাটিতে ফেলে হাতে তুলে নেন সৌহার্দ্যের সাদা পতাকা।
বিশাল বপু, পাঠানি জোব্বা আর খানদানি শ্মশ্রু-গুম্ফে বসির চাচাকে বেশ ভয়ালই লাগে। চাচা হাঁকডাক জুড়ে দেন যত্রতত্র, রীতিমতো বাজখাঁই গলায়, কখন কী ‘হরকত’ করে বসবেন– কেউ জানে না। সমর্থনের ‘কাওয়ালি’ ধরলে তো কথাই নেই, হুঁশ-টুশের সম্পূর্ণ বিসর্জন তখন! চাচা পাকিস্তান-জাত হলেও, পাকিস্তানে থাকেন না। চাচা থাকেন আমেরিকায়। কিন্তু দেশের খেলা থাকলে হিল্লি-দিল্লি করেন নির্বিচারে। চাচার পোশাক বড় মনোরম। একপাশে পাকিস্তানের চাঁদ-তারা, আর একপাশে ভারতের সূর্য মহেন্দ্র সিং ধোনি। ওহ্, বলা হয়নি। চাচার এক বন্ধু আছে। পৃথিবী উল্টে গেলেও চাচা যাঁর পাশে থাকেন, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে ফ্লাইট টিকিট কেটে দেন, থাকা-খাওয়ার দায়দায়িত্ব নিয়ে নেন নির্বিবাদে। নিঃসংকোচে।
চাচার বন্ধুর নাম সুধীর গৌতম!
ভারতীয় ক্রিকেট অনুসরণ করেন, অথচ সুধীরকে চেনেন না, এমন লোক পাওয়া আমবাগানে তেলের খনি আবিষ্কারের মতোই অসম্ভব! শখের ইন্দ্রলুপ্ত, রেফের মতো টিকিধারী সুধীরকে কে না চেনে, ভারতের খেলা থাকলে যাঁকে দেখা যায় দেশ-বিদেশের মাঠে, যাঁর সারা গায়ে আয়েশ করে গড়িমসি করে তেরঙ্গা? সুধীর সিন্ধু নদের এ পারের। চাচা সিন্ধুর ও পারের। অথচ কবে যে কখন, ভ্রাতৃত্বের সৌরভ সিন্ধু পারাপার করে দু’জনের হাতে বন্ধনের ‘হাতকড়া’ পরিয়ে দিয়েছে, ওঁরাও জানেন না। সীমান্ত কাঁটাতার আটকানোর সুযোগই পায়নি!
বছর পাঁচ আগে আমিরশাহিতে এশিয়া কাপ কভার করতে গিয়ে সব স্বচক্ষে দেখা, কানে শোনা। তার পরেও এঁদের দেখেছি-পেয়েছি, এখানে-ওখানে, নানা ভারত-পাকিস্তানে। সুধীরের সেবার কিছু একটা হয়েছিল, ঠিক মনে নেই। হয় আমিরশাহি যাওয়ার টাকা ছিল না, কিংবা জোগাড় করতে পারেননি। দাড়ি-গোঁফের অরণ্য ভেদ করে তা চাচার কানে যাওয়া মাত্র বন্ধুর জন্য দমাদম ফ্লাইট বুকিং, পাঁচতারা হোটেল বুকিং। সঙ্গে লটবহর নিয়ে নিজে উপস্থিত। ক্যামেরার সামনে ‘প্রতিযোগী’ সুধীরকে খোঁচা দিতে-দিতে, পতপত করে পাকিস্তান পতাকা ওড়াতে-ওড়াতে চাচা যা একখানা কথা বলেছিলেন, আমৃত্যু মনে থাকবে। ‘আমি খেলা দেখতে আসব, দেশকে সমর্থন করতে আসব, আর আমার ভাই আসবে না! ও মাঠে বসে নিজের দেশকে সমর্থন করবে না!
আমি ‘আমনে’ বিশ্বাসী, বুঝলেন?
‘আমন’! ‘শান্তি!
কত ছোট দুটো শব্দ, তবু কত জোর! এক লহমায় যা বিবাদের বিষাদ মুছে ফেলতে পারে, পারে বেয়নেটের সামনে বিদ্রোহী সাদা পায়রা ওড়াতে। ভারত-পাকিস্তানের জিঘাংসার ইতিহাস, বন্দুক-কামানের সংঘর্ষের ইতিহাস থেকে যাবে তার মতো। কিন্তু সমান্তরাল পৃথিবীতে সুধীর গৌতম, বসির চাচারাও থেকে যাবেন তার প্রতিবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে। নাহ্, ভাবার কারণ নেই যে, মাঠে সুধীর বা বসির, কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলেন। খেলা চললে সুধীরের ‘পাঞ্চজন্য’ সবুজ জার্সিধারীদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া করে ছাড়ে। বসির চাচা আবার যখন দু’হাত ছড়িয়ে, দেহ কাঁপিয়ে ‘জিয়ে জিয়ে পাকিস্তান’ গহন-নাদ তোলেন, দাবদাহেও শিরশিরে শীত বিলক্ষণ টের পাওয়া যায়। কিন্তু এঁরা ওই পর্যন্তই, ওই খেলা পর্যন্তই। খেলা শেষ হলে এঁরা বেমালুম ভুলে যান সব, উগ্র দেশাত্মবোধের ‘শব’ মাটিতে ফেলে হাতে তুলে নেন সৌহার্দ্যের সাদা পতাকা। একসঙ্গে তারপর মুরগি-মাটন চলে, চলে বয়সে বড় বসিরের সুধীরকে সস্নেহ ধমকানো। সংসারের বড়দা ছোট ভাইকে প্রশ্রয়ের আদুরে বকাবকি করে যেমন!
এবং অধিকাংশই তাই, ভারত-পাক সমর্থনের অধিকাংশই সুধীর-বসির। ক্রিকেট কভার করতে গিয়ে এক পাকিস্তানি সমর্থকের দেখা পেয়েছি, যিনি ভারতীয় শুনে চোখের জল ফেলেছিলেন দিদার কথা ভেবে। দেশভাগের পর তিনি সপরিবার ওয়াঘার ওপারে চলে গিয়েছিলেন, শুধু তাঁর দিদার যাওয়া হয়নি। দেখাও আর কখনও হয়নি। ভারত শুনলে তাই তাঁর দিদাকে মনে পড়ে। বিদেশে তো আরও। বিলেতে পাকিস্তানি ট্যাক্সিচালকের সওয়ারি হলে দেড় মিনিটের মধ্যে লাহোরের কাবাব আলোচনায় আসবে, দু’মিনিটে কোহলি! লিখতে আজ বাধা নেই, গত জুনে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল করতে গিয়ে পাসপোর্ট চুরি হয়ে গিয়েছিল। বড় বিপদে পড়েছিলাম বিভুঁইয়ে। এমার্জেন্সি সার্টিফিকেট নিতে ভারতীয় দূতাবাস যাওয়ার সময় ট্যাক্সিচালক ছিলেন পাকিস্তানি। যিনি দূতাবাস যাওয়ার কারণ শুনছিলেন আর রাগে ফোঁসফোঁস করছিলেন। গাড়ি ঘুরিয়ে অকুস্থলে যেতে চাইছিলেন বারবার। সঙ্গে তর্জন ও যথাযথ গর্জন, ‘আপনি চলুন আমার সঙ্গে। তিরিশ বছর ধরে আছি এ দেশে। সব ঘাঁতঘোঁত চিনি আমি, কারা এ সমস্ত কুকর্ম করে সব জানি। আপনার পাসপোর্ট চুরি করবে, সাহস কত!’ ভদ্রলোকের স্বর্ণমন্দির দেখার শখ বারবার ‘বাতিল’ হয়েছে, তবু। ভারতে আসার আবেদন বারবার ভিসা অফিস খারিজ করেছে, তবু।
ভালবাসা নয় এটা? এই ঘৃণার পৃথিবীতে আছে ক’টা এমন ভালবাসা? শুধু দুঃখের যে, কোনও দেশের ভিসা অফিস বুঝবে না এই ভালবাসা। আসলে এ দেশ শত-শত সুধীর-বসিরের দেশ, ভালবাসার আপন দেশ। যে দেশে ইসলামাবাদ আদতে পাশের ছাদ। যে দেশের বাসিন্দারা বারবার সমর্থনের নামে ‘দ্বিখণ্ডিত’ হয়ে মাঠে-ঘাটে যায় বটে, সাময়িক হল্লাও করে, কিন্তু কোথাও গিয়ে শেষে ফিরে আসে একই নীড়ে, ফিরে আসে একই ‘জরায়ু’-র টানে। যেখান থেকে উৎপত্তি দুই ভাইয়ের, দুই দেশের।
অখণ্ড ভারতবর্ষ!