এক পোশাকের বিজ্ঞাপনের মডেল গাভাসকার। বিজ্ঞাপন তৈরির দায়ভার আমার হাতে। সেজন্যই এক রাত্রিবেলায় গাভাসকার কে ফোন– ব্রিফিংয়ের সময় চাই। উত্তরে পেলাম ব্রেকফাস্টের আমন্ত্রণ। খাস গাভাসকারের বাড়িতে। ওখানেই শুটিংয়ের ব্রিফিং। একটি আদ্যোপান্ত দম্ভহীন ভদ্রলোক। অত বড় সেলিব্রেটি, বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় নেই! আমি কলকাতার এবং বঙ্গসন্তান শুনে ইডেনের গল্প আর থামে না তাঁর।
৯.
এ এক মজার ব্র্যান্ডবাজি। একদিকে ক্রিকেটের আইকনিক ব্র্যান্ড গাভাসকর আর অন্যদিকে এক বিখ্যাত পোশাকের ব্র্যান্ড।
সে অনেক দিন আগের কথা। গাভাসকর তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। এক ব্র্যান্ডেড পোশাকের বিজ্ঞাপনের মডেল হলেন তিনি। বিজ্ঞাপন তৈরির ভার পড়ল আমার ওপর। গাভাসকারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে ছুটলাম মুম্বই। ওঁর সময়ের অনেক দাম। তাই ওভার নাইট আমার কোম্পানির মুম্বই অফিস সব ব্যবস্থা পাকা করল। বিশাল শুটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট। একে মুম্বই, তার ওপর গাভাসকার। কয়েক লাখ টাকার ব্যবস্থাপনা।
সব ব্যবস্থা ঠিক করে ফোটোগ্রাফারকে শুটিংয়ের বিষয় বুঝিয়ে দিয়ে এবার মডেলকে ব্রিফ করার পালা। পরের দিন শুটিং। সময় কম। রাত্রিবেলায় গাভাসকর কে ফোন– ব্রিফিংয়ের সময় চাই। উত্তরে পেলাম ব্রেকফাস্টের আমন্ত্রণ। খাস গাভাসকরের বাড়িতে। ওখানেই শুটিংয়ের ব্রিফিং। একটি আদ্যোপান্ত দম্ভহীন ভদ্রলোক। অত বড় সেলিব্রেটি, বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় নেই! আমি কলকাতার এবং বঙ্গসন্তান শুনে ইডেনের গল্প আর থামে না তাঁর। এদিকে আমি একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছি। ডে-লাইট শুটিং। সূর্যের তেজ কমলেই কাজ শুরু। যেতে হবে অনেক দূর। সমুদ্রের ধারে পোর্ট ছাড়িয়ে, ন্যাভাল বেস পেরিয়ে শুটিং স্পট। ওখানে পৌঁছেও অনেক কাজ বাকি। তিন রকমের ড্রেস সিলেকশন, ফিটিং, ইস্তিরি করা, মেক আপ ইত্যাদি প্রভৃতি। আমার ছটফটানি বাড়ছেই।
গাভাসকর বুঝতে পেরে আমাকে নিজের সেই বিখ্যাত ‘সানি’ লেখা ফিয়াট গাড়িতে চড়িয়ে নিজেই ড্রাইভ করে শুটিং স্পট-এ চললেন। উদ্দেশ্য– অনেকক্ষণ একান্তে গল্প করা। অথচ ওঁকে শুটিং স্পটে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিলাসবহুল গাড়ি অপেক্ষা করছিল। গাভাসকর ওদিকে তাকালেনই না।
অনেক গল্প, ইডেনের, ক্রিকেটের, কলকাতার। কলকাতার খেলা পাগল মানুষের ওপর ওঁর এত ভালোবাসা শুনে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। একটা স্মরণীয় ড্রাইভ শেষে শুটিংস্পটে পৌঁছেই শুটিংয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। গাভাসকর ঢুকে গেলেন মেকআপ ভ্যানে। আমি ফোটোগ্রাফার শান্তনু সৌরে-কে নিয়ে লোকেশন, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ঠিক করছি। প্রচুর লোকলশকর, ডে-লাইট শুটিং যেহেতু রিফ্লেকটার নিয়ে ছুটোছুটিও। সূর্যের আলোর জোরটা কমছে। এবার শুটিং শুরু করতে হবে।
আরও পড়ুন: যে কোম্পানির নামে আস্ত একটা নগরী!
এমন সময় নাকের কাছে ‘একে ফোরটি সেভেন’ বন্দুকের নল। ওহ মাই গড!
চারজন আর্মি গার্ড বন্দুক উঁচিয়ে প্রথমেই শান্তনুর বহুমূল্য ক্যামেরাটা কেড়ে নিল। পরেই কঠিন স্বরে পারমিশনের চিঠি দেখতে চাইল কারণ জায়গাটা ‘strictly prohibited’ অঞ্চল। পাশেই ন্যাভাল বেস।পারমিশনের চিঠি না থাকলেই গ্রেফতার।
আমাদের মাথায় বজ্রাঘাত! দূরে দেখলাম, পুরো শুটিং টিম প্রস্তরীভূত। কিংকর্তব্য বিমূঢ়!
এত অ্যারেঞ্জমেন্ট, এত লক্ষ টাকা খরচ, এত উত্তেজনা। শেষে কিনা জেলযাত্রা? আর্মি গার্ডরা বুঝে গেল আমাদের পারমিশন নেই। খুব রাগতভাবে সব কিছু প্যাক করে আমাদের পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। এমন সময় ঘটল সেই অভাবনীয় ঘটনা। হঠাৎ দেখলাম, দূর থেকে শুটিং-রেডি গাভাসকর ছুটতে ছুটতে আসছেন। আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতেই ম্যাজিক। চারটে কঠিন মুখের আর্মির গার্ড একগাল হেসে একেবারে মাখনের মতো গলে গিয়ে প্রশ্ন করল, ‘গাভাসকার সাব, আপ ইধার!’
আরও পড়ুন: মহাকাশচারীদের জন্য বানানো টুথপেস্টে এখন শিশু ও পোষ্যদের দাঁত মাজানো হয়
গাভাসকর সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন যে, ‘ওঁর শুটিং চলছে। পারমিশন নেওয়া হয়নি বলে দুঃখিত।’ চুলোয় গেল পারমিশন, চুলোয় গেল গ্রেফতার, ওরা চারজন কী করবে, ভেবে পাচ্ছিল না। গাভাসকর সাব হাত মিলিয়েছেন। এ তো ভগবানের ছোঁয়া। সব টেনশন শেষ। সেই চারজন গলা চড়িয়ে হুকুম দিল, ‘স্যর আপলোক শুটিং চালাইয়ে।’ আরও জানাল যে, ওরাই এখন আমাদের পাহারা দেবে। শুটিং জমিয়ে শুরু হল এবং মহানন্দে শেষ হল।
অবাক হয়ে দেখলাম একজন প্রখ্যাত খেলোয়াড়কে সাধারণ মানুষ কত ভালোবাসতে পারে।
আরও অবাক হয়ে দেখলাম, একজন ওই উচ্চতার সেলিব্রেটি কতটা মডেস্ট এবং হেল্পফুল হতে পারেন।
শুটিং শেষে গাভাসকর নিজের ভিআইপি কার্ডটা দিয়ে বললেন, যখনই আমি ইডেনে খেলতে যাব, এই কার্ডটা দেখিয়ে তুমি আমার ‘গেস্ট’ হয়ে খেলা দেখতে আসবে। এই বলে ‘সানি’তে উঠে চলে গেলেন সানি।