Robbar

একটা গান থেমে যায়, চিৎকার ভেসে ওঠে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 20, 2024 9:23 pm
  • Updated:October 21, 2024 7:56 pm  

ট্রেসি ব্যাপটিস্ট হিসেবে এপিস্কোপাল স্কুলে লেখাপড়া করে বড় হয়েছেন। গসপেল গাওয়া তাঁর সহজাতভাবেই আসত, বহু কৃষ্ণাঙ্গী শিল্পীদের মতোই। ‘বিহাইন্ড দ্যা ওয়ালস’-এর কাঠামো গসপেল-ধর্মী। গানটি একদম খালি গলায় গেয়েছেন ট্রেসি। প্রতিটি লাইনের মাঝে যে স্তব্ধতা, গানের বিষয়বস্তু, ভয়াবহতাকে আরও তীব্র করে তোলে। গানটা শুনতে শুনতে আমরাও যেন সেই চিৎকার শুনতে পাই, গানটির মাঝে মাঝে মৃত্যু ও জীবনের লড়াইটা আমরা টের পাই।

প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়

৮.

‘বিহাইন্ড দ্য ওয়ালস’, ট্রেসি চ্যাপম্যান, ১৯৮৮, আমেরিকা

আজও সেই একই ঘটনা। পাশের বাড়ি থেকে দেওয়ার ফুঁড়ে একটা চিৎকার ভেসে আসছে। এক মহিলার আর্ত চিৎকার। এই চিৎকার আমি আগেও শুনেছি। দেওয়াল-ভেদী, অন্তর্ভেদী চিৎকার। আবারও আমার একটা ঘুমহীন রাত কাটবে। আমি এই আর্ত চিৎকারের শব্দ ভুলতে পারব না সারারাত। পুলিশকে ডেকেও কোনও লাভ হয় না। তারা যতক্ষণে এসে পৌঁছবে, ততক্ষণে সব শেষ হয়ে যাবে। একটি মেয়ের চিৎকার পাড়াময় উড়ে বেড়াচ্ছে। সবাই জানে ঘরের ভেতর কী ঘটছে, সবাই জানে মেয়েটির আর্তনাদের কারণ কী। ঘরের ভেতরের হিংসা ঘরের বাইরে হাহাকার করছে। তবুও গার্হস্থ্য হিংসায় কেউ কর্ণপাত করে না, এড়িয়ে যায়, বলে ব্যক্তিগত। যে চিৎকার ঘরের বাইরে শোনা যায়, তাকে কি আর ব্যক্তিগত বলা যায়?

পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, ধর্ষণ কিংবা নারীহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যে হয়নি, বা হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু এই সামাজিক অন্যায় যুগ যুগ ধরে চলছে তো চলছেই। নাট্যকর সাফদর হাশমি লিখেছিলেন, ‘অওরতে উঠতি নেহি তো জুলম বড়্‌তা। জুলম করনেওয়ালে সিনা জোর বনতা জায়েগা।’

Theatre, Resistance And SFI: Safdar's Delhi University
সফদর হাশমি

তেভাগা কৃষক আন্দোলনের সময় গ্রামে প্রহরারত মহিলাদের মধ্যে অহল্যাকে জমিদারের পোষা গুন্ডারা নির্মমভাবে হত্যা করে। অহল্যা তখন সন্তানসম্ভাবা ছিলেন। সেই অহল্যাকে নিয়েও গান লেখা হয়েছিল, ‘আর কতকাল বলো কতকাল সইব এই মৃত্যুর অপমান’। কিন্তু অহল্যা, রূপ কানোয়ার, অনিতা দেওয়ান, উন্নাও, কামদুনি, নির্ভয়া, অভয়াদের পাশাপাশি এক ধরনের নারী নির্যাতন চলে এসেছে, যা বেশিরভাগ সময়ই বাইরে আসে না। সবাই জানে, কিন্তু চুপ করে থাকে, ধামাচাপা দিয়ে রাখে। পুলিশও নিষ্ক্রিয় থাকে।

Official Tracy Chapman playlist - Fast Car, Give Me One Reason, Talkin Bout A Revolution - playlist by Tracy Chapman | Spotify

ছোটবেলা থেকে বড়দের একটা আলোচনা ভেসে আসত কানে– অমুকের বর কিছু করে না, রাতে নেশা করে বউকে পেটায়। অনেক মহিলা পরিচারিকারা কাজে এসে তাদের শরীরের কালশিটের দাগ লুকনোর চেষ্টা করতেন। জিজ্ঞেস করলে, আসল ঘটনাটা লুকিয়ে যেতেন। সময়টা বদলায়নি। শুধু লুকোনোর ধরন বদলে গেছে। হাসিমুখে কালশিটে লোকানো মেয়েরা অভ্যাস করে ফেলেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করাটা এখনও অভ্যাসে পরিণত হয়নি। যেদিন প্রতিবাদ অভ্যাস হবে, সেদিনই বদল আসবে।

আজকে যে গান নিয়ে লিখব, সেই গান পারিবারিক নিগ্রহের শিকার হওয়া মেয়েদের নিয়ে। যাঁরা বছরের পর বছর মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করে চলেন। লোকলজ্জার ভয়ে, পরিবারে সম্মানহানির ভয়ে, সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে প্রতিবাদ তো করেনই না, উল্টে এটা ‘আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার’ বলে পরিবারকে রক্ষা করেন। আজ আমরা শুনব ট্রেসি চ্যাপম্যানের ‘বিহাইন্ড দ্য ওয়ালস’ গানটা।

Tracy Chapman's black and white world (Rolling Stone, June 30 ...
ট্রেসি চ্যাপম্যান

ট্রেসি চ্যাপম্যান মার্কিন মুলুকের একজন কৃষ্ণাঙ্গী সুরকার ও গায়িকা। বড় হয়েছেন ব্যাপ্টিস্ট হিসেবে। একটি এপিস্কোপাল স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। খুব অল্পবয়স থেকেই অ্যাক্টিভিস্ট তিনি, বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েছেন সংগীতের মাধ্যমে। ১৯৮৮ সালে ট্রেসি রিলিজ করেন এই গান, ‘বিহাইন্ড দ্য ওয়ালস’। গানটি একটি প্রতিবেশীর দৃষ্টি দিয়ে লেখা। দেওয়ালের ওপার থেকে ভেসে আসা নিপীড়নের শব্দ শুনে, প্রতিবেশী আন্দাজ করছেন কী চলছে!

Last night I heard the screamingLoud voices behind the wallAnother sleepless night for meIt won’t do no good to callThe police always come lateIf they come at all
And when they arriveThey say they can’t interfereWith domestic affairsBetween a man and his wifeAnd as they walk out the doorThe tears well up in her eyes
Last night I heard the screamingThen a silence that chilled my soulI prayed that I was dreamingWhen I saw the ambulance in the roadAnd the policeman said“I’m here to keep the peaceWill the crowd disperseI think we all could use some sleep.
শেষমেশ পুলিশ আসে। কিন্তু পারিবারিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না জানায়। জানায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা ঘটে, তাতে বাইরের লোকের না জানাই ভালো। পুলিশ চলে যায়। মেয়েটির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
গত রাতেও আমি আবারও সেই চিৎকার শুনি। আমার অভ্যস্ত কান কিন্তু সেই সেই চিৎকারে হতভম্ব হয় না। কিন্তু শরীরের ভেতর দিয়ে শীতল স্রোত তখন বয়ে যায়, যখন হঠাৎ সেই চিৎকারটা থেমে যায়। প্রার্থনা করি আমার ভয় যেন সত্যি না হয়। কিন্তু আমার ভয়কে, আতঙ্ককে সত্যে পরিণত করে অ্যাম্বুল্যান্স আসে পাড়ায়।
একটি মেয়ের বেঁচে থাকার প্রমাণ হল সেই মেয়েটির চিৎকার। যতক্ষণ সে চিৎকার করবে যন্ত্রণায়, ছটফট করবে, আমরা বুঝব তখনও সে লড়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকার ইচ্ছেয়। সে বেঁচে আছে। সে বেঁচে আছে। এখনও সম্ভাবনা আছে, এখনও প্রাণ আছে।

আগেই বলেছি, ট্রেসি ব্যাপটিস্ট হিসেবে এপিস্কোপাল স্কুলে লেখাপড়া করে বড় হয়েছেন। গসপেল গাওয়া তাঁর সহজাতভাবেই আসত, বহু কৃষ্ণাঙ্গী শিল্পীদের মতোই। ‘বিহাইন্ড দ্যা ওয়ালস’-এর কাঠামো গসপেল-ধর্মী। গানটি একদম খালি গলায় গেয়েছেন ট্রেসি। প্রতিটি লাইনের মাঝে যে স্তব্ধতা, গানের বিষয়বস্তু, ভয়াবহতাকে আরও তীব্র করে তোলে। গানটা শুনতে শুনতে আমরাও যেন সেই চিৎকার শুনতে পাই, গানটির মাঝে মাঝে মৃত্যু ও জীবনের লড়াইটা আমরা টের পাই।

Luke Combs's Cover of Tracy Chapman's "Fast Car" Sparks Conversation

গান যখন শেষ হয় মনে হয় যেন সবাই থমকে গিয়েছে। অসহায়ভাবে আরেকটি নারী নির্যাতনের মৌন অসহায় সাক্ষী হয়ে দেখছে। দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্সে বন্দি নির্যাতিত সেই নারীর লাশ।

 

…পড়ুন গানস অ্যান্ড রোজেস-এর অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ৭। সচ্ছলতার বিনিময়ে দমবন্ধ করা এক স্বপ্নহীন, স্বাধীনতাহীন জীবন

পর্ব ৬। তিনটি মানুষ ও একটি কারাগার

পর্ব ৫। কাব্যিক অভিপ্রায় ছাপিয়ে যে গান রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষায় মিশে যায়
পর্ব ৪। যে সৈনিক কবর খোঁড়ে বেঁচে থাকার তাগিদে
পর্ব ৩। যে প্রশ্ন শহরের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ায়, উত্তর পাওয়া যায় না
পর্ব ২। আহা ফুল, কবরের ফুল, মাটিকে অমন ভালোবেসে পাশাপাশি ঘুমিয়ে থেকো না
পর্ব ১। বব ডিলানের এই গান ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়– যুদ্ধ আসন্ন