বৌদ্ধধর্ম বলেছে, পৃথিবীর সকল প্রাণীকে আত্মবৎ ভাবো। নেহাত ভাবা নয়, জাতক কাহিনিতে দেখানো হয়েছে, বোধিসত্ত্ব তাঁর মানব জন্মের মাঝে মাঝে প্রায়শই অন্য প্রাণী হিসেবে জন্মেছেন। যেমন, হরিণ বা রাজহাঁস, সিংহ বা সাপ। সেইসব তথাকথিত ‘মানবেতর’ জন্মেও তিনি সুকৃতিবলে পুণ্যলাভ করেছেন। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাস করে, এই জন্মে যে মৃগ বা মর্কট সে-ও আগামীতে বুদ্ধত্ব অর্জনে সক্ষম।
১৪.
বারাণসী রাজ্য জুড়ে দেবতার পুজোয় পশুবলির রেওয়াজ। নিরীহ প্রাণীর আর্তনাদে কেঁপে ওঠে পুজো মণ্ডপ, রক্তের ফিনকিতে কাদা হয়ে যায় মন্দিরের শুকনো মাটি। বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে যুবরাজ ব্রহ্মদত্তকুমারের। তাঁর ১৬ বছরের কোমল প্রাণ সইতে পারে না এসব। তিনি এই বয়সেই শাস্ত্রজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত। তক্ষশীলা থেকে বিদ্যাভ্যাস শেষ করে বেদ এবং অষ্টাদশ কলায় ব্যুৎপন্ন। কুমার বুঝতে পারেন না, এমন নির্মম আয়োজনে দেবতার সন্তুষ্টি হয় কী করে!
বরং নগরের প্রান্তে যে বৃক্ষদেবতার পুজো হয়, সেখানে তাঁর প্রাণের আরাম। প্রায়ই তিনি সেখানে যান, ভক্তিভরে ফুল, চন্দন, ধূপধুনো দিয়ে বনস্পতির পুজো করেন। গাছের গোড়ায় জল ঢালেন। আর প্রার্থনা করেন, যদি কখনও রাজা হই পুজোর নামে এই সহস্র সহস্র প্রাণীহত্যা আমি রদ করব।
যথাকালে বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তের মৃত্যুর পর ব্রহ্মদত্তকুমার সেখানের রাজা হলেন। তাঁর সুশাসনের কথা প্রজাদের মুখে মুখে। পণ্ডিতরা বলেন, দশবিধ রাজধর্মের এমন নিখুঁত প্রয়োগ ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
–দশরকম মানে কী কী?
আরও নব জাতক: সীতা যখন রামের বোন, দিতে হয়নি অগ্নিপরীক্ষাও
পণ্ডিতরা সাধারণ মানুষদের বুঝিয়ে দেন, শাস্ত্রে বলে রাজাকে দশটি ধর্ম পালন করতে হবে: দান, সচ্চরিত্র, ত্যাগ, ক্রোধ সংবরণ, অহিংসা, সহিষ্ণুতা, ঋজুতা, মৃদুভাব, তপোবল এবং বিরোধহীনতা। আমাদের নতুন রাজার মধ্যে এই দশটি গুণই সমুজ্জ্বল।
তবু ব্রহ্মদত্তকুমারের মনে স্বস্তি নেই। তাঁর সংকল্প রক্ষার কী হবে? দেশে প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ করতে চান তিনি। কীভাবে নিরুপদ্রবে তা বলবৎ করা সম্ভব?
এখানে একটি তত্ত্বকথা খেয়াল করিয়ে দেওয়া দরকার। খ্রিস্টধর্ম শ্লাঘার সঙ্গে বলে যে, তাদের ধর্ম সকল মানুষকে ভ্রাতৃভাবে দেখার শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু তাদের বেশ কিছু শতক আগে প্রবর্তিত বৌদ্ধধর্ম আরও অনেকটা এগিয়ে; তারা বলেছে পৃথিবীর সকল প্রাণীকে আত্মবৎ ভাবো। নেহাত ভাবা নয়, জাতক কাহিনিতে দেখানো হয়েছে, বোধিসত্ত্ব তাঁর মানব জন্মের মাঝে মাঝে প্রায়শই অন্য প্রাণী হিসেবে জন্মেছেন। যেমন, হরিণ বা রাজহাঁস, সিংহ বা সাপ। সেইসব তথাকথিত ‘মানবেতর’ জন্মেও তিনি সুকৃতিবলে পুণ্যলাভ করেছেন। অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাস করে, এই জন্মে যে মৃগ বা মর্কট সে-ও আগামীতে বুদ্ধত্ব অর্জনে সক্ষম।
আরও নব জাতক: পলাশ গাছ ছায়া দিত কালো সিংহকে, তবু তারা শত্রু হয়ে গেল
এই বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্রহ্মদত্তকুমারের পশুবলি বন্ধের আকুতিকে বুঝতে হবে। বুঝতে হবে সেই রদ বলবৎ করার পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর ভাবনা-চিন্তাকে।
কেমন হবে পদ্ধতি? কেমনভাবে সারা রাজ্যে দেব-দেবীর নামে পশুবলি দেওয়ার এতকাল ধরে চলে আসা অভ্যাস নির্বিঘ্নে বন্ধ করা যাবে?
মন্ত্রী-সান্ত্রীরা বলেন, ‘আপনি রাজা, আপনি যদি ঘোষণা করেন পূজায় পশুবলি নিষিদ্ধ করা হল, ভবিষ্যতে কেউ এমন কাজে উদ্যোগী হলে তাকে পেতে হবে মৃত্যুদণ্ড, তাহলেই তো কার্যসিদ্ধি হয়।’
কিন্তু নবীন রাজা বলেন, পশুহত্যা নিবারণ করতে গিয়ে আমি আমার প্রাণপ্রিয় প্রজার হত্যাকে আইনসিদ্ধ করব, এ কেমন করে হয়? এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে প্রজারা নিজেরাই এই অভ্যাস থেকে বিরত হয়।
বৃদ্ধ প্রধানমন্ত্রী বললেন, ’কিন্তু মহারাজ, অহিংসার উপদেশ বিতরণ করে কি রাজ্যের সকল প্রজার অভিরুচি বদলানো সম্ভব?’
ব্রহ্মদত্তকুমার মৃদু হেসে ঘাড় নাড়লেন, ‘না তা সম্ভব নয়।’ তারপর বললেন, ‘আচ্ছা, যদি সারা রাজ্যে ঘোষণা করা হয়, রাজধানীতে বৃক্ষদেবতার পূজা প্রচলন করা হচ্ছে, আর তার জন্য নিবেদন করা হবে যাঁরা পশুবলিতে যুক্ত থাকেন তাঁদের হৃদপিণ্ড? তাহলে কাজ হবে?’
প্রধানমন্ত্রী মৃদু হেসে সম্মতি জানালেন।
বারো যোজনব্যাপী বারাণসী নগরের সর্বত্র ভেরি বাজিয়ে এই আদেশ প্রচার করা হল, খবর ছড়িয়ে দেওয়া হল পার্শ্ববর্তী সকল জনবসতিতে।
কোনও রক্তপাত না করে, কাউকে কোনও দণ্ড না দিয়ে অহিংস পথে বারাণসী রাজ্যে প্রাণীহত্যা বন্ধ করা হল।
ঋণ: দুর্মেধা জাতক
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved