কেমন সেই মায়াবী টেবিল, যে-টেবিলে মগ্ন বু.ব.কে দেখেছি আমি? যে-টেবিল তাঁকে দিয়েছে, তাঁর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও, সংকীর্ণ আলোর চক্রে মগ্ন হওয়ার নেশা! যে মায়াবী টেবিল বারবার দিয়েছে বু.ব.-কে এই পরম বোধ। এই টেবিলের আলোর বীজ জন্ম দেয় সুন্দরীর! এই মায়াবী টেবিলের আলোতেই বু.ব. দেখেছেন, হয়তো মৃত্যুর দিনেও, বাথরুমে স্থির হয়ে যাওয়ার আগে, জোছনায় ঝিলমিল স্বপ্নের শেমিজ! শুরু হল নতুন কলাম।
১.
এ-কাঠ যতখানি টেবিলের, ততটাই মনের। মনের মধ্যে যেমন কাঠ আছে, কাঠেও তেমনই মন আছে। টেবিলের মন বুঝতে নিজের মনকে খোদাই করতে হয়। মন-খোদাই সহজ কাজ নয়। বড় কষ্টের। ভীষণ ব্যথার। খোদাই করা কাঠের টেবিলে মন ফোটে ফুলের মতো। আলোর ফুল। জাগায় মায়া। রবীন্দ্রনাথ সারাদিন পদ্মায় আনমনা ভাসতে ভাসতে সন্ধ্যায় তাঁর বজরার মধ্যেই কাঠের টেবিলে সেজের আলোয় লিখতে বসে ভাবলেন, টেবিলের বুকের ওপর কাগজে যে-লেখা তাঁর কলম থেকে ঝরে পড়ছে, সে-লেখা তাঁর, না-টেবিলের? অন্য কোনও টেবিলে, অন্য কোথাও, ভিন্ন পরিবহে, অচেনা পরিবেশে ঠিক এই লেখা কি তিনি লিখতে পারতেন? রাইনের মারিয়া রিলকে বন্ধুনি লু-কে লিখলেন, আমাকে একটি দুর্গ দিতে পারো? যেখানে থাকবে অনেক দিনের পুরনো নির্জন নিঃসঙ্গ একটা টেবিল? যার বুক খোদাই করে আমি লিখব আমার ডুইনো-দুর্গের দুঃখের এলিজি-গুচ্ছ, যার মধ্যে মিশে থাকবে সেই অরণ্য ও কাঠের মন, কাঠের মন গলবে, বিন্দু-বিন্দু রক্তক্ষরণ হবে, কাঠখোদাইয়ের রক্তপাত! রিলকের এলিজিগুচ্ছের সারাৎসার। দু’টি চেয়ার কোনাকুনি করে বসানো হ্যামস্টেডে কিটসের বাড়িতে। সামনে তাঁর লেখার টেবিল। ভেসে এল সকালবেলা নাইটেঙ্গেলের গান! টেবিলের ওপর লেখার কাগজ পাতলেন কিটস। কালিতে ডোবালেন কলম। পাখির কথা লিখতে গিয়ে, তার গানের কথা লিখতে গিয়ে, লিখলেন হেমলক বিষের কথা, যে-বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন সক্রেটিস। খোদাই করা টেবিলের মন কিটসকে ধার দিল তার বিহিত ব্যথার লিকুইডিটি। তার বিষাক্ত তারল্য। কাঠের টেবিলের হলাহল-তারল্য অবশ করল কিটসের চেতনা। কিটস সেই টেবিল-তারল্যে ডুবতে-ডুবতে লিখলেন তাঁর নাইটেঙ্গেল ওড্!
সালভাদোর দালি টেবিলের ওপর কাগজ রেখে আঁকলেন একটি ঘড়ি। তিনি চেয়েছিলেন ঘড়িটা তাঁর বুকে ধারণ করুক চলন্ত সময়ের স্থিরতা। কিন্তু টেবিল চাইল অন্যরকম। ঘড়িটা গলতে লাগল। আর বিন্দু বিন্দু ঘড়ি গড়িয়ে নামতে লাগল টেবিল থেকে। বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ টেবিলের ওপর কাগজটার গায়ে পেনের আঁচড়ে অনেকক্ষণ ধরে পাগলের মতো আঁকতে চাইছেন। কিন্তু টেবিলের ইচ্ছে ফুটে উঠল বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের টেবিলজুড়ে আঁকা একটি চোখের মধ্যে! ‘মনের মধ্যে জেগে আছে ওই নয়নের তারা।’ কার মন? টেবিলের? না, রবীন্দ্রনাথের? নতুন বউঠান, জানো কি তুমি, কার মন? ভোরবেলা টেবিলে বসে রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনায় লিখছেন বাংলা কবিতা। ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে তাকালেন তাঁর হাতে লেখা অমন অচেনা অক্ষর-সারির দিকে। রবীন্দ্রনাথ লেখা থামালেন না। সময় দাঁড়াল স্তব্ধ হয়ে। সালভাদোর দালি যা চেয়েছিলেন তাঁর বিন্দু-বিন্দু ঝরে পড়া তরল ঘড়িতে। বুদ্ধদেব বসু এসে বসলেন তাঁর মায়াবী টেবিলে ‘মহাভারতের কথা’-র শেষ ক’টা লাইন লিখতে। তাঁর মনে এল উপনিষদের একটি শব্দ। ‘সোহম্’। কী সংক্ষিপ্ত সংরাগে কোন পুরাকালের টেবিল বলেছিল, আমিই সে, আমিই ব্রহ্ম!
বুদ্ধদেব বসু। ‘সোহম্’, সংক্ষেপে বু.ব.। কতবার দেখেছি তাঁকে তাঁর লেখার টেবিলে। ক্লান্ত তিনি। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছাড়িয়ে সন্ধে পর্যন্ত লেখার তাড়নায়, যাতনায়, দহনে। প্রতিটি শব্দ তাঁকে পুড়িয়েছে। প্রতিটি বাক্য তাঁকে খ্রিস্ট-যন্ত্রণায় ক্রুশবিদ্ধ করেছে। প্রতিটি ভাবনার বর্ণিল বুননে লেগেছে তাঁর রক্তবিন্দু! ক্লিষ্ট তিনি। তিনি তৃষ্ণার্ত। তিনি মায়াবী টেবিল থেকে উঠে এলেন কোনও প্রগাঢ় প্রসন্নতা নিয়ে নয়। তিনি আমার সামনে উপবিষ্ট। তৃষ্ণায় ঢাললেন এক চুমুক হুইস্কি। উঠে এসেছেন ‘মহাভারতের কথা’ লিখতে-লিখতে। তিনিই যেন এক বেদনাবহ্নিত ব্যসদেব। মহর্ষি নন। মানুষের চলতি দুঃখের এক বিরল বাহক। তাঁর মায়াবী টেবিলের বিলোড়ন ও বিলসনে তৈরি হচ্ছে সমসময়ের মহাভারত, আমাদের নিত্য প্রত্যয় ও সংশয়ের সঙ্গে জড়িয়ে, আমাদের পারিবারিক, সাংসারিক আটপৌরেমির অঙ্গাঙ্গি হয়ে! এই বু.ব.-কে আমি দু’-চোখ ভরে দেখেছি। তাঁকে গ্রাস করছে তাঁর মায়াবী টেবিল। তাঁকে ছারখার, ছিন্নভিন্ন করছে তাঁর মায়াবী টেবিল। তাঁকে ছুরি দিয়ে ফালাফালা করছে তাঁর মায়াবী টেবিল। সালমান রুশদির ছুরি খাওয়ার মতো মাত্র সাতাশ সেকেন্ডের তাণ্ডব নয় মায়াবী টেবিলের চাঁদে-পাওয়া পাগলা ছুরির! ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকার ‘ব্লাড ওয়েডিং’-এর চন্দ্রালোকিত ছুরির মতো বু.ব.-র মায়াবী টেবিলের ছুরিতে নেই ‘ডেথ অ্যামঙ্গ ড্রাই লিভস’– শুকনো পাতার অন্দরমহলে মৃত্যু! বু.ব.-র মায়াবী টেবিলে-র স্বপ্নের আঘাতে মৃত্যু ‘ডাজ্ নট রিলিজ আ স্ট্রিম অফ ব্লাড’– বলেছিলেন কি বু.ব. আমাকে কোনও সন্ধ্যায় তাঁর মায়াবী টেবিল-এর পাশে বসে, চিরাবসানের কিছু পূর্বে?
কেমন সেই মায়াবী টেবিল, যে-টেবিলে মগ্ন বু.ব.কে দেখেছি আমি? যে-টেবিল তাঁকে দিয়েছে, তাঁর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও, সংকীর্ণ আলোর চক্রে মগ্ন হওয়ার নেশা! যে মায়াবী টেবিল বারবার দিয়েছে বু.ব.-কে এই পরম বোধ। এই টেবিলের আলোর বীজ জন্ম দেয় সুন্দরীর! এই মায়াবী টেবিলের আলোতেই বু.ব. দেখেছেন, হয়তো মৃত্যুর দিনেও, বাথরুমে স্থির হয়ে যাওয়ার আগে, জোছনায় ঝিলমিল স্বপ্নের শেমিজ! এই মায়াবী টেবিলেই জ্বলে সেই আলো, যে-আলো আমি দেখেছি বু.ব.-র সারাদিন লেখা ক্লান্ত চোখে। কতবার সারাজীবন ধরে বারবার ফিরে গেছেন এই মায়াবী টেবিলের কাছে বু.ব.! বলেছেন প্রবল আর্তিময় উচ্চারণে, তাহলে উজ্জ্বলতর করো দীপ, যে-দীপের ছায়া ঘাস, গাছ, রোদ্দুরের অন্তহীন আশ্চর্য কাপড়ে পৃথিবীর রূপ দেয়!
কিন্তু শুধু কি তাই? নেই কোনও রক্তাক্ত অঙ্গীকার? ওই টেবিলের কাছে? যে-অঙ্গীকার ছাড়া নামমাত্র লেখকও হওয়া যায় না, কোনও দিন, কখনও! সুতরাং, করো অঙ্গীকার! কিন্তু কীসের অঙ্গীকার? কার কাছে? মায়াবী টেবিলের কাছে, হে লেখক, করো আলোর অঙ্গীকার। লেখক হওয়ার প্রথম শর্তই যে তাই!
কিন্তু কেমন সে আলো, যে-আলোর অঙ্গীকার ছাড়া লেখক হওয়া আদৌ সম্ভব নয়? সেই আলোর কাছে লেখকের অঙ্গীকার, বললেন বু.ব., যে দেয় জীবনে মুছে, যৌবনে নিবায়। আর কী করে সেই আলো? বললেন বু.ব. তাঁর মায়াবী টেবিলে দৈব ক্লান্তিতে হিরণ্ময় হয়ে উঠে, হে লেখক, হে ভাষার ও বাক্যের সাধক, হে ভাবনার মগ্ন সাঁতারু, অঙ্গীকার করো সেই আলোর কাছে, যে-আলো প্রকাশিত হয় রঙের তরঙ্গে তপ্ত ঘন খনির কোরকে, ধাতুর প্রাণের পদ্মে, পাথরের রক্তের শিরায়। তোমার নিজস্ব মায়াবী টেবিল বসে লেখো হে লেখক। তোমার অফুরন্ত চোখের হীরকে ফুটে উঠুক সেই আলো, ঝরে পড়ুক সেই আলো তোমার ভাষায়, ভাবনায়, বলা এবং না-বলায়। হে লেখক, তোমার নিজস্ব মায়াবী টেবিলে বসে, তুমিও যেন একদিন লিখতে পারো, এমনই এক অপার সমুদ্র:
দুপুর যেন বিকেল, আর
বিকেল হল অন্ধকার;
সন্ধ্যাকাশে উচ্চহাসে
সূর্য পেল ছাড়া।
দুঃশাসন করিল পণ
দ্রৌপদীর শাড়ি।
তারপর?
(চলবে)