টেবিলটা এবার বলল, “ভার্জিনিয়া দেখতে শেখো, বুঝতে শেখো। এতক্ষণ যা দেখলে, তা শুধু একটি সামান্য পতঙ্গের মৃত্যু নয়। এবার এই সত্যটুকু অনুভবের চেষ্টা করো যে, বাইরের ওই উদার প্রান্তর, প্রসারিত আকাশ, দূরে ওই বিপুল নদী, তারও পরে মহাসমুদ্র, সব কিছুর মধ্যে ছড়িয়ে আছে এক প্রবল অপরাজেয় শক্তি। তার বিরুদ্ধে ওই ছোট্ট একটি পতঙ্গের শেষ যুদ্ধটা তুমি দেখলে।
১৪.
১৯৪১ সাল। ভার্জিনিয়া উলফ্ আত্মহত্যা করবেন এই বছরেই। কেননা আবার ফিরে আসছে ভয়। এই ভয়ের হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই তাঁর। কীসের ভয়? তিনি বুঝতে পারছেন, তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। হারাচ্ছেন মানসিক ভারসাম্য। এই অসুখ সারবে না। যতদিন যাবে, ততই বাড়বে মন হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। যার মন ক্রমশ হারিয়ে যায়, সেই শুধু জানে মন হারানোর অসহনীয় আতঙ্ক।
ভার্জিনিয়া তাঁর স্বামী লেনার্ডকে নিয়ে চলে এসেছেন লন্ডন থেকে অনেক দূরে। কারণ, লন্ডনে অবিরাম বোমা ফেলছেন হিটলার। এমনকী, ভার্জিনিয়া উলফের বাড়িতেও বোমা উড়িয়ে দিয়েছে একটা অংশ। লন্ডন থেকে দূরে, সাসেক্স-এর গ্রাম্য পরিবেশে “মংক’স হাউস” নামের এক নিভৃত কটেজে কিছুটা শান্তি পেয়েছেন ভার্জিনিয়া। বাড়ির কাছেই একটি নদী। ওই নদীর রহস্যময় টান অনুভব করেন ভার্জিনিয়া। অনেক দূরে সমুদ্র। বাতাসে ভেসে আসে সমুদ্রের গন্ধ। শোনা যায় স্টিমারের ভেঁপু। চোখ বুঝলে ভার্জিনিয়া দেখতে পান রাতের সমুদ্রে অন্ধকার ঢেউ, দূরে লাইটহাউসের আলো কখনও ঢেউয়ের গায়ে ফেনিয়ে ওঠে।
এই মুহূর্তে, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে বিকেলের দিকে। রোদালো দিন। ভার্জিনিয়া তাঁর লেখার টেবিলে। ঘরের এক কোণে, জানলার দিকে মুখ করে, ভার্জিনিয়া রেখেছেন তাঁর লেখার টেবিল। মন হারাতে-হারাতে আর কতদিন লিখতে পারবেন তিনি? এই ভয়াবহ প্রশ্নের কোনও উত্তর জানা নেই ভার্জিনিয়ার। এখন তিনি লেখার টেবিলে। কিন্তু একটি বর্ণও লিখছেন না। তিনি ক্রমাগত তাকিয়ে আছেন একটি মথের মতো পতঙ্গের পানে। মথ বা প্রজাপতিটা ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে। ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণে, সেখান থেকে আরও একটা কোণে। ভার্জিনিয়ার মনে হয়, প্রজাপতিটার ডানায় কী অসীম ক্ষমতা! প্রজাপতিটা– কিংবা বলা উচিত ওই উড়ন্ত পতঙ্গটা– ওটা যেন একটা পুরুষ, যার ক্ষুদ্র শরীরের মধ্যে কেউ পুরে দিয়েছে মহাবিশ্বের শক্তি: ‘দ্য এনরমাস এনার্জি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড হ্যাড বিন থ্রাস্ট ইনটু হিজ ফ্রেল অ্যান্ড ডিমিনিউটিভ বডি’। লেখার টেবিল যেন হঠাৎ ছুঁড়ে দেয় এই আকস্মিক শব্দরাশি ভার্জিনিয়ার বুকের মধ্যে। পরের বাক্যটি আচমকা আরও জোরে ধাক্কা দেয় ভার্জিনিয়াকে। কে বলল, আমার মন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার অতলে? এই বাক্যটি কি হতে পারে অন্ধকারে ক্রমশ ডুবে যাওয়া মনের শেষ আলো? উড়ন্ত প্রজাপতিটাকে ভার্জিনিয়ার মনে হয়, যেন এক জীবন্ত আলোর সুতো উড়তে উড়তে আরও প্রবলভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে: ‘আই কুড্ ফ্যানসি দ্যাট আ থ্রেড্ অফ ভাইটাল লাইট বিকেম ভিসিবল্।’
পরক্ষণেই ভার্জিনিয়ার মধ্যে ফিরে আসে ক্রমশ পাগল হয়ে যাওয়ার ভয়। তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন বলেই একটা পতঙ্গকে ঘরময় পাগলের মতো উড়তে দেখে এইভাবে ভাবতে পারছেন। আর তাঁর লেখার টেবিলটা এইভাবে উসকে দিচ্ছে তাঁর পাগলামি, নিশ্চিত তিনি!
আরও একটি ব্যাপারে ভার্জিনিয়াকে নিশ্চিত করেছে তাঁর লেখার টেবিল: ওই পতঙ্গটা তাঁরই মতো মৃত্যু এবং লুপ্তির বিরুদ্ধে লড়ছে। এবং অসম যুদ্ধে ওই ছোট্ট পতঙ্গ ঢেলে দিয়েছে তার শেষ প্রচেষ্টার সমস্ত জড়ো করা শক্তি। ভার্জিনিয়া পরিষ্কার শুনতে পেলেন, টেবিলটা তাঁকে বলল, ‘তুমি কি বুঝতে পারছ না, ওই পতঙ্গ হারিয়ে ফেলেছে তার ডানা থেকে পাখির পালকের মতো কোমল প্রান্তরে উড়ে বেড়ানোর ক্ষমতা। বাইরের পৃথিবীতে ওই খোলা প্রান্তর, ওই বাড়িতে-বাড়িতে জীবন ও সংসারের গন্ধ, সব চলে গেছে পতঙ্গটার নাগালের বাইরে। তাই ও তোমার ঘরের মধ্যে উড়ছে। এই তার শেষ উড়ান। একটু পরে ও তোমার চোখের সামনে মরবে। কেমন করে মরতে হয়, দেখে রাখো ভার্জিনিয়া। চিনে রাখো মৃত্যুর রূপ।’
পাগল হয়ে যাওয়ার নিশ্চিত চিহ্ন। ইদানীং লেখার টেবিলটাই তাঁর ভাবনা ও লেখাকে যেন গিলে ফেলছে, মনে হয় ভার্জিনিয়ার। পালানোর একমাত্র উপায়, আত্মহত্যা। ভার্জিনিয়া আরও নিবিষ্টভাবে দেখতে থাকেন পতঙ্গটাকে। না, ওটা ঠিক প্রজাপতি নয়। তেমন রঙের খেলা নেই পতঙ্গটার ডানায়। সুন্দর নয় মোটে। ওটা একটা বুড়ো ‘মথ’। মরতে এসেছে আমার ঘরের মধ্যে। কিন্তু মরতে চায় না। সমস্ত প্রাণ দিয়ে লড়ছে আসন্ন মরণের বিরুদ্ধে।
‘তুমি ভুল দেখছ, ভুল ভাবছ ভার্জিনিয়া, অন্যভাবে দেখতে শেখো’, বলে টেবিলটা। টেবিলটা তাকে গিলে ফেলছে। টেবিলের ভাবনা ভার্জিনিয়ার মনটাকে অন্য ভাবনায় নিয়ে যায়। মৃত্যুর বিরুদ্ধে পতঙ্গটার লড়াইয়ের মধ্যে ক্রমশ ভার্জিনিয়ার চোখের সামনে ফুটে ওঠে এক নিরন্তর প্রবহমানতায় নিশ্চিত আলোর সুতো! যদিও পতঙ্গটা জানে, তার ডানায় খেলা করছে জীবনের শেষ রোদ্দুর, যদিও সে জানে মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার পরাজয় নিশ্চিত, তবু কেন তার উড়ান বাতাসের বুকে রেখে যাচ্ছে আলোর সুতো? কে বুনছে ওই আলোর সুতো? এবং কেন? উত্তর জানেন না ভার্জিনিয়া। তিনি শুধু জানেন, তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মন চলে গেছে তাঁর নাগালের বাইরে। তিনি আবার তাকান পতঙ্গটার দিকে।
ভার্জিনিয়া শুনতে পান টেবিলের কণ্ঠস্বর: ভার্জিনিয়া, পতঙ্গটার মৃত্যু নিয়ে তোমাকে লিখতেই হবে। সেটাই হবে তোমার শেষ লেখা। কী লিখবে শুনে নাও ভার্জিনিয়া:
‘Looking up my eye was caught by him. He was trying to resume his dancing, but seemed either so stiff or so awkward that he could only flutter to the bottom of the window-pane: and when he tried to fly across it he failed.’
ভার্জিনিয়া দেখলেন তাঁর চোখের সামনে যা ঘটল: পতঙ্গটা আবার শুরু করতে চাইল তাঁর আলোর নাচ। কিন্তু এবার আর পারল না। তার ছোট্ট শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তার ডানায় উড়ানের আলো নিভে গেছে। তার ইচ্ছে আর সাড়া তুলল না ডানায়। সে ডানার ঝাপটা দিয়েও পিছলে সার্সির তলায় চলে গেল। তবু শেষবার চেষ্টা করল সার্সির গা বেয়ে ওপারে যেতে। পারল না।
টেবিলটা এবার বলল, “ভার্জিনিয়া দেখতে শেখো, বুঝতে শেখো। এতক্ষণ যা দেখলে, তা শুধু একটি সামান্য পতঙ্গের মৃত্যু নয়। এবার এই সত্যটুকু অনুভবের চেষ্টা করো যে, বাইরের ওই উদার প্রান্তর, প্রসারিত আকাশ, দূরে ওই বিপুল নদী, তারও পরে মহাসমুদ্র, সব কিছুর মধ্যে ছড়িয়ে আছে এক প্রবল অপরাজেয় শক্তি। তার বিরুদ্ধে ওই ছোট্ট একটি পতঙ্গের শেষ যুদ্ধটা তুমি দেখলে। ওই মহাশক্তির একটুকরো ঝলক ক্ষণিকের জন্য প্রকাশিত হয়েছিল ওই ক্ষুদ্র পতঙ্গের জীবনে। এখন তার নিঃসাড় দেহটা পড়ে আছে তোমার সামনে। আমাদের সাধ্য নেই ওই অসাড় শরীরটার মধ্যে আলোর নাচকে আবার ফিরিয়ে আনার। কিন্তু ওই পতঙ্গের শেষ চেষ্টার বিশেষ উল্লেখ যেন থাকে তোমার লেখার মধ্যে। ওটাই হবে তোমার লেখা ‘দ্য ডেথ অফ দ্য মথ্’-এর শেষ বার্তা।”
লিখলেন ভার্জিনিয়া তাঁর লেখার টেবিলটার আদেশ মতো: ‘It was superb, this last protest, this gigantic effort on the part of an insignificant little moth against a power of such magnitude.’ ছোট্ট পলকা একটা পতঙ্গ। আর বিপক্ষে অপরাজেয় মৃত্যু। তবু তো সে মরতে-মরতে এক ঝটকায় একবার উঠে দাঁড়িয়ে ছিল!
ভার্জিনিয়া উলফ্, ‘দ্য ডেথ অফ দ্য মথ্’ লেখার ক’দিন পরে, ওই টেবিলে আবার এসে বসলেন ১৯৪১-এর ২৮ মার্চ। তিনি নিশ্চিত, ‘দ্য ডেথ অফ দ্য মথ্’ প্রকাশিত হবে তাঁর মৃত্যুর পরে। আরও একটি বিষয়ে তিনি নিশ্চিত: কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ওভারকোট পরে সোজা হেঁটে চলে যাবেন বাড়ির পিছনে অউস্ (Ouse) নদীর গভীর স্রোতে। ওভারকোটের দুই পকেটে ভরে নিয়েছেন ভারী-ভারী পাথর। সুতরাং, সেই ভার অতি কষ্টে বহন করে কোনও রকমে নদীর জলে পৌঁছতে পারলে ডুবে যেতে, ভেসে যেতে অসুবিধে হবে না তাঁর।
ভার্জিনিয়া তাঁর লেখার টেবিলে এসে বসলেন স্বামী লেনার্ড উলফ্-এর উদ্দেশে তাঁর আত্মহত্যা-লিপিটি লিখতে। এই তাঁর সেই অন্তিম অমোঘ লিখন:
Dearest,
I feel certain I am going mad again.
I feel we can’t go through another of
those terrible times. And I shan’t recover this time.
I begin to hear voices, and I can’t concentrate.
So I am doing what seems the best thing to do.
You have given me the greatest possible happiness…
What I want to say is I owe all the happiness of my life to you… If anybody could have saved me it would have been you. Everything has gone from me but the certainty of your goodness. I can’t go on spoiling your life any longer.
Yours Virginia