১৯৮৬-র নভেম্বর মাসের দু’-তারিখ। আমার স্মৃতিতে এখনও সে তারিখটা স্পষ্ট। সে রাতে আমাকে চমকে দিয়ে বিধ্বস্ত মিনা হঠাতই এসেছিল আমাদের বাড়িতে– বলেছিল, ‘‘আজ বিকেলেই ফঈজ়কে হেকমতিয়ারের লোকেরা মেরে ফেলেছে, আমাদের আরও ছ’-জন কমরেডের সঙ্গে! ওরা আমাকেও খুঁজছে। আমাকে এক্ষুনি বর্ডার পেরতে হবে। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে হবে। শহিদ হয়েছে ফঈজ়, অনেক কাজ বাকি রেখে। লড়াই জারি রাখতে হবে। রাখতেই হবে। খুব সাবধানে থাকিস। এই বইগুলি রেখে গেলাম। সাবধানে রাখিস।’’ কোথায় যাবে সে, জিগ্যেস করায় বলেছিল– পাকিস্তান। আবার কবে দেখা হবে? ‘লড়াইয়ের ময়দান ছাড়িস না। ঠিক দেখা হবে একদিন। মুক্ত আফগানিস্তানে।’
৪.
মিনা, আমার বন্ধু মিনা। ও পাকিস্তানের কোয়েটায় চলে যাওয়ার আগে অবধি আমরা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি আফগানিস্তানের এই ঊষর মাটিতে– একসঙ্গে কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে উঠেছি। ইশকুলে পড়ার সময় মনে হত, মিনা এক্কেবারে আমার মতো! কলেজে মিনাকে দেখে বুঝছিলাম– মিনা আমাদের সবার মতো হয়েও সবার থেকে আলাদা। ইশকুলের সেই ছোট্ট প্রজাপতির মতো আমার বন্ধুটা আমার চোখের সামনেই খাপখোলা একটা তলওয়ারের মতো ঋজু আর শানানো হয়ে উঠছিল, মাঝে মধ্যে এত অচেনা লাগত ওকে! কলেজে পড়ার সময়ে ওই আমাকে রাজনীতিতে টেনে আনল, বলল– ‘চোখ খুলে ঘুমো। চোখ বুজে জেগে থাকিস না। ওকে জাগা বলে না।’ কবিতা লিখত মিনা। অন্যরকম সে-সব কবিতা। আমাদের মতো হয়েও মিনা কতটা যে অন্যরকম ছিল…!
আমার এ রুক্ষ দেশে বড় টালমাটাল সে সময়টা। মনে আছে, ১৯৭৮-এ সাওর বিপ্লব -এর সময়টা– যে বছর দাউদ খানের দক্ষিণপন্থী সরকারকে উচ্ছেদ করে আফগানিস্তানের পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল– অনেকের মতো আমিও ভেবেছিলাম, আমাদের মতো নারীদের মুক্তি এল বুঝি! মিনা ভাবেনি। ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিনে বসে সে আমাদের বোঝাত, সরকার বদল হলেই জনগণের বা নারীদের মুক্তি আসে না। বলত, পিডিপিএ বকলমে সোভিয়েত ইউনিয়নের পুতুল সরকার। এর এক বছর আগেই (আমরা দু’জনেই কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তখন) মিনা তৈরি করেছিল আফগানিস্তানের নারীদের বিপ্লবী সমিতি… RAWA নামে দুনিয়া যাকে চেনে। আমরা তখন জানতামও না যে, সে অনেক দিন ধরেই জড়িয়ে আছে ‘আফগানিস্তানের বিপ্লবী জনগণের গোষ্ঠী’-র সঙ্গে, আমাদের দেশের মাওবাদী বিপ্লবী নেতা ডক্টর ফঈজ় আহমদ যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এই গ্রুপটাই পরে ‘আফগানিস্তান লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ নামে অন্য মুজাহিদিনদের সঙ্গে মিলে পিডিপিএ সরকারের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ইতিহাস জানে সেসব কথা। মিনার মতো রাজনীতি বুঝতাম না আমি, কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম, সাওর বিপ্লব না এনেছে আমার দেশের গরীবগুর্বোদের মুক্তি, না এসেছে নারীদের স্বাধীনতা। আমার বন্ধুই আমাকে, আমাদের টেনে নিয়ে এসেছিল নারীদের বিপ্লবী সমিতিতে; আমরা বলতাম এই সমিতি হচ্ছে ‘অবদমিত আফগান নারীদের কণ্ঠস্বর।’ আমাদের পত্রিকা বেরল, ‘পয়ম-এ-জান’ নামে– নারীদের বার্তা। মিনা-র কণ্ঠস্বর তখন দেশের সীমানা পেরিয়েও শোনা যাচ্ছে। ১৯৮১-তে ফ্রান্সে গেল মিনা, ফরাসি সোশ্যালিস্ট পার্টির কংগ্রেসে আফগান প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে। মনে পড়ে, আগুনে বক্তৃতা শেষে মিনা যখন দু’-আঙুলে বিজয়চিহ্ন দেখাচ্ছিল, সোভিয়েত প্রতিনিধিদল রাগে গরগর করতে করতে সভা থেকে ওয়াক আউট করেছিল। খুব গর্ব হয়েছিল আমার বন্ধুর জন্য সেইদিন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ডক্টর ফঈজ় পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন তখন, আর মিনা…, আমার বন্ধু মিনা সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে পাশের দেশ পাকিস্তানের কোয়েটায়। লড়াইয়ের পথ ছেড়ে পালায়নি কিন্তু! কোয়েটাতেই আফগান রেফ্যিউজিদের শিবিরে নতুন করে গড়ে তুলেছে নারী সমিতির সদর দফতর। গড়ে তুলেছে ওয়তন স্কুল। আর অব্যাহত রেখেছে গোপনে মাঝেমধ্যে আফগানিস্তানে ফিরে এসে বিপ্লবের ধিকিধিকি আগুনটুকুকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মিনা নিজের গোটা জীবনটাকেই বিপজ্জনক করে তুলতে পেরেছিল বড্ড তাড়াতাড়ি। জীবনসঙ্গী হিসেবে খুঁজে নিয়েছিল তার নেতা ফঈজ় আহমদকেই। খুব তাড়াতাড়ি তারা হয়ে উঠেছিল ‘আফগানিস্তানের সবচেয়ে বিপজ্জনক দম্পতি’। শুধু সোভিয়েতের পুতুল সরকার নয়, কমিউনিজমের জাত-শত্রু উগ্র মৌলবাদী গুলব্উদ্দিন হেকমতিয়ারের হিজব-ই-ইসলামির কাছেও মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল তারা! লিবারেশন যোদ্ধারা তখন বিভিন্ন ফ্রন্টে মরণপণ প্রতিরোধ চালাচ্ছে। আর সোভিয়েত যুদ্ধবিমান বারবার গুঁড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের ঘাঁটি। কত যে প্রিয় কমরেডকে আমরা হারিয়েছি এই বছরগুলো জুড়ে! ছিন্নভিন্ন অবস্থা তখন আমাদের! বিপ্লবী নারী সমিতিও কাজ করতে পারছে না খোলাখুলি। ডক্টর ফঈজ় পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন তখন, আর মিনা…, আমার বন্ধু মিনা সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে পাশের দেশ পাকিস্তানের কোয়েটায়। লড়াইয়ের পথ ছেড়ে পালায়নি কিন্তু! কোয়েটাতেই আফগান রেফ্যিউজিদের শিবিরে নতুন করে গড়ে তুলেছে নারী সমিতির সদর দফতর। গড়ে তুলেছে ওয়তন স্কুল। আর অব্যাহত রেখেছে গোপনে মাঝেমধ্যে আফগানিস্তানে ফিরে এসে বিপ্লবের ধিকিধিকি আগুনটুকুকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।
১৯৮৬-র নভেম্বর মাসের দু’-তারিখ। আমার স্মৃতিতে এখনও সে তারিখটা স্পষ্ট। সে রাতে আমাকে চমকে দিয়ে বিধ্বস্ত মিনা হঠাৎই এসেছিল আমাদের বাড়িতে– বলেছিল, “আজ বিকেলেই ফঈজ়কে হেকমতিয়ারের লোকেরা মেরে ফেলেছে, আমাদের আরও ছ’-জন কমরেডের সঙ্গে! ওরা আমাকেও খুঁজছে। আমাকে এক্ষুনি বর্ডার পেরতে হবে। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে হবে। শহিদ হয়েছে ফঈজ়, অনেক কাজ বাকি রেখে। লড়াই জারি রাখতে হবে। রাখতেই হবে। খুব সাবধানে থাকিস। এই বইগুলি রেখে গেলাম। সাবধানে রাখিস।’’ কোথায় যাবে সে, জিগ্যেস করায় বলেছিল– পাকিস্তান। আবার কবে দেখা হবে? ‘লড়াইয়ের ময়দান ছাড়িস না। ঠিক দেখা হবে একদিন। মুক্ত আফগানিস্তানে।’
কোয়েটায় চলে গিয়েছিল মিনা। খবর পেতাম, রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে একচুলও সরেনি সে, সক্রিয়তা অটুট রেখেছে। কবিতাও বিদায় নেয়নি তার জীবন থেকে। কোয়েটায় যেখানে থাকত আমার বন্ধু, সে বাড়িটা আমি দেখিনি আজও। কিন্তু বেশ বুঝি, তার জানালার বাইরে নিয়ত ছিল গুপ্তঘাতকদের অশুভ ছায়া! আফগান সরকারের গুপ্ত-পুলিশ ‘খাদ’ আর ‘কাবুলের কসাই’ হেকমতিয়ারের লোকজন– দু’-দলই মরিয়া হয়ে খুঁজছিল তাকে। মিনা-র কি আরেকটু সতর্ক থাকার দরকার ছিল?
১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারির চার তারিখ ওরা মিনাকে মারল। কমরেড ফঈজ়কে হত্যার ঠিক তিন মাসের মধ্যে। কারা? খাদ, না হিজব-ই-ইসলামি? যে কেউই হতে পারে। মিনা বলেছিল: ‘আফগান মেয়েরা ঘুমন্ত সিংহী। একবার জাগিয়ে তুললে তারা কামাল করতে পারে।’ মিনা জেগে যাওয়া সিংহী ছিল। খাদ হোক বা হেকমতিয়ার, কারই বা সাধ্য ছিল তার চাপা গর্জনে নিষ্কম্প থাকার? ডক্টর ফঈজ় আর মিনার তিনটি শিশুসন্তান ছিল। কোথায় গেল তারা? আর… নতুন কবিতা নিয়ে আঁকিবুঁকি-কাটা মিনা-র শেষ খাতাটা?
আমি ফিরব না
আমি সেই নারী,
আমি প্রলয়-ঘূর্ণি হয়ে জেগে উঠছি
আমার আগুনে পোড়া বাচ্চাদের ছাই থেকে
আমার ভাইদের রক্তের সোঁতা থেকে জেগে উঠছি
আমার স্বভূমির ক্রোধ আমাকে জাগিয়ে তুলছে
পোড়া গ্রামগুলির ঘৃণা আমাকে জাগিয়ে তুলছে
আমি জেগে ওঠা
আর রাস্তা খুঁজে পাওয়া সেই মেয়েটি
যে কোনোদিন ফিরবে না।
অজ্ঞানতার বন্ধ দরোজা খুলে
সে রাস্তায় রওয়ানা দিয়েছি,
সোনার কাঁকন ঘরে ফেলে গেলাম।
স্বদেশ আমার!
আমি সে নই যে আমি ছিলাম
আমি পুরোপুরি জেগে ওঠা আর
রাস্তা খুঁজে পাওয়া সেই মেয়েটি
যে আর কোনোদিন ফিরবে না।
[কবিতার অংশটি মিনা-র। গদ্যাংশটি কাল্পনিক, কিন্তু বাস্তবতারহিত নয়।]
…আরও পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved