উচ্ছেদের অধিকারকে হাতিয়ার করে, কোম্পানি কলকাতার ভূসম্পদের উপর ধাপে ধাপে কর্তৃত্ব কায়েম করে, স্থানীয় বিত্তশালী পরিবারগুলিকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। সমকালীন মাদ্রাজ শহরেও একইরকম ছবি দেখতে পাওয়া যায়। আইনি নানা ফাঁকফোকর দিয়ে, নতুন আইন বানিয়ে, পুরনো আইনকে ‘ভুল’ ভাবে ব্যাখ্যা করে কোম্পানি কলকাতাকে কেন্দ্র করে এক নতুন ‘জমির বাজার’ তৈরি করতে সক্ষম হয়, যেখানে জলা, বালি, পলি, কাদামাটিকে শুকিয়ে, বুজিয়ে, বাঁধ দিয়ে ‘ভূসম্পদ’ গড়ে ওঠে, যে সম্পদ কেনাবেচা যায়, যার উপর কর চাপানো যায়। কলকাতার গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে কোম্পানির ‘সরকার’ হয়ে ওঠার ইতিহাসও জড়িয়ে আছে।
২.
জল-কাদা, নদীনালায় ভরা বদ্বীপ অঞ্চলে যে একটা মস্ত শহর তৈরি করা সম্ভব, তা বোধহয় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গুটিকয়েক লোকের আগে কেউ তেমন ভেবে দেখেনি! নদী ধরে সাগরে চট করে চলে যাওয়ার পথ, বাণিজ্যের সুবিধে, বা মুর্শিদাবাদের নবাবী রাজধানী থেকে বেশ খানিক নিরাপদ দূরত্ব– এসবই কোম্পানির কলকাতাকে কেন্দ্র করে ‘ফ্যাক্টরি’ বা কেল্লা তৈরি করার কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই আখ্যানে বাদ পড়ে যায় এর পরের ধাপটা। জল-জঙ্গল সরিয়ে বাড়ি-ঘরদোর, রাস্তাঘাট, অফিস কাছারি, ডক-বন্দর গুদামঘর বানানোর জন্য দরকার ছিল শক্ত, পাকাপোক্ত স্থায়ী জমির। কিন্তু ‘জমি’ বলতে যে নির্দিষ্ট ধ্যান-ধারণা ছিল আঠারো শতকে কোম্পানির লোকজনের, তার সঙ্গে এই জল-কাদায় ভরা অঞ্চলের মিল পাওয়া দায়! এখানে নদীর বাঁক-বদলের সঙ্গে সঙ্গে জমির ভাসা-ডোবা জড়িয়ে ছিল।
ফলে শহর তৈরির গোড়ার যুগে নানা আইনি জটিলতার মধ্য দিয়ে কলকাতার ‘জমি’– এবং তার সূত্র ধরে ‘সম্পত্তি’ বা শহরের ভূসম্পদের– ধারণা তৈরি করে কোম্পানি। শহরের পরিকাঠামো তৈরির নানা উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এই জমি, জমির মালিকানা, জমির মূল্য ও ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন। ঔপনিবেশিক লেখ্যাগারে ভুরি ভুরি নথি পড়ে আছে এই বিষয়ে। গুটিকয়েক নিয়ে কথা বললেই খানিক আভাস পাওয়া যায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক চিন্তাভাবনার এক জটিল মেলবন্ধনে কীভাবে কলকাতার পরিকাঠামো গড়ে উঠেছিল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
১৮৪৮ সাল নাগাদ এই পলি-কাদা-জঞ্জাল ভরতি এলাকাকে মাটি দিয়ে বুজিয়ে পাকাপোক্ত জমি তৈরি করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানি। ফলে অত্যন্ত দামি ‘প্রপার্টি’ হিসেবে ‘স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক’ কলকাতার জমির বাজারে আত্মপ্রকাশ করে। কোম্পানি নিজের নামে লিখে নিতে চায় এই জমি। তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল, ডালহাউসি দাবি করেন যে নদীর ধার বরাবর রাস্তা এবং তার সম্মুখের জমি কোম্পানির, জনগণের স্বার্থে সরকার সেই জমি ব্যবহার করবে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই যেসব অভিজাত বাঙালির কিছু কিছু জমির পাট্টা ছিল এই অঞ্চলে, তাঁরা কোম্পানির এই বেয়াদপি সহ্য করেননি। দিলেন মামলা ঠুকে। রাধাকান্ত দেবের সঙ্গে লম্বা মোকদ্দমা চলে কোম্পানির। রাধাকান্ত জমির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৫ লক্ষ টাকা দাবি করেছিলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
শুরু করা যাক দেওয়ানি লাভের দু’বছর পরের ঘটনা দিয়ে। বেঞ্জামিন লাকাম নামের এক ভদ্রলোককে ১৭৬৭ সালে সুন্দরবনের কাছে একটা বন্দর তৈরি করার বরাত দেয় কোম্পানি। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের মতবদল ঘটল; এই অস্থির নদীনালা ভরা অঞ্চলে বন্দর তৈরি করে বিশেষ লাভ হবে না বলেই মনে হল তাঁদের। অতএব, জমি ফেরত দিতে বলা হল। লাকামই বা ছাড়বেন কেন? খানিক পয়সাকড়ি ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ করে ফেলেছেন তিনি। কোম্পানির দেওয়া জমি নিজের সম্পত্তি বলে দাবি করলেন। আদালতে গড়ায় লাকাম এবং কোম্পানির এই চাপানউতোর। কিন্তু ক্রমেই বোঝা যায় যে, কোন জমির কথা হচ্ছে, সেটাই স্পষ্ট হচ্ছিল না কারও কাছে। নানা বাক-বিতণ্ডার পর হতোদ্যম জজসাহেবের উক্তি: ‘এই জলাভূমিতে জমি কীভাবে শনাক্ত করা হয়?’
এই অঞ্চলের মানুষজন জল ও জমির এই সদা চলমান সম্পর্ক সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিলেন; তাঁদের জীবিকা ও জীবনযাত্রা প্রকৃতির এই খেয়ালখুশিকে অগ্রাহ্য করে চলত না। তাকে মান্য করত। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা অন্য খাতে বইত। কোম্পানি আমলে আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগেই আমদানি হয় ‘উন্নতি’ ও ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’র পারস্পরিক সম্পর্কের সমীকরণ, যার সর্বোত্তম উদাহরণ বাংলার ভূমি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূচনা। চাষের জমির মূল্য নির্ধারিত হয় আবাদের ওপর নির্ভর করে; কিন্তু শহুরে জমির দাম কীভাবে ঠিক করা হবে, বিশেষত যদি সেই জমি ‘নতুন জমি’ হয়? আরও বড় কথা, ‘নতুন জমির’ মালিকানা কার? কার দাবি মেনে নেওয়া হবে? এখানেই কোম্পানি তার সার্বভৌম ক্ষমতা জাহির করতে শুরু করে। ব্যাপারটা খোলসা করে বলা যাক।
আজ যা স্ট্র্যান্ড রোড, সেখানে একসময়ে হুগলি নদী বইত। নদীর বাঁক বদলের সঙ্গে সঙ্গে জল ও পাড়ের মধ্যে নতুন জমি তৈরি হতে শুরু করে– খানিক পলি জমে, আর খানিক শহরের বর্জ্য জমে। হুগলির পাড় ধরে উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যখন এই নতুন ভূখণ্ড গড়ে উঠছে তখন থেকেই কোম্পানির নজর ছিল এর ওপর। কিন্তু নদীর কূলকে কুক্ষিগত করার নানা সমস্যা ছিল। প্রধান অন্তরায় ছিল বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। নিত্যদিন গঙ্গাস্নানে যাওয়া বা নিজের পরিবারের জন্য ঘাট নির্মাণ করা কলকাতার বাঙালি অভিজাতদের এক বিশেষ কর্তব্য ছিল। কিন্তু কোম্পানিও নদীর পার্শ্ববর্তী এই অঞ্চলে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল। ১৮২৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইনের (বেঙ্গল রেগুলেশন ১) বলে কোম্পানি এই জমিকে ‘জনগণের প্রয়োজনের’ নামে নিয়ে নেবে ঠিক করে। নদীর ধার ধরে এই রাস্তা কোম্পানির ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল।
১৮৪৮ সাল নাগাদ এই পলি-কাদা-জঞ্জাল ভরতি এলাকাকে মাটি দিয়ে বুজিয়ে পাকাপোক্ত জমি তৈরি করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানি। ফলে অত্যন্ত দামি ‘প্রপার্টি’ হিসেবে ‘স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক’ কলকাতার জমির বাজারে আত্মপ্রকাশ করে। কোম্পানি নিজের নামে লিখে নিতে চায় এই জমি। তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল, ডালহাউসি দাবি করেন যে নদীর ধার বরাবর রাস্তা এবং তার সম্মুখের জমি কোম্পানির, জনগণের স্বার্থে সরকার সেই জমি ব্যবহার করবে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই যেসব অভিজাত বাঙালির কিছু কিছু জমির পাট্টা ছিল এই অঞ্চলে, তাঁরা কোম্পানির এই বেয়াদপি সহ্য করেননি। দিলেন মামলা ঠুকে। রাধাকান্ত দেবের সঙ্গে লম্বা মোকদ্দমা চলে কোম্পানির। রাধাকান্ত জমির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৫ লক্ষ টাকা দাবি করেছিলেন। শুধু রাধাকান্তই নন, তাঁর ছেলে এবং অন্যান্য পাট্টাদারও আলাদা আলাদা ক্ষতিপূরণের দাবি জানায়। বহুদিন মামলা চলার পর রাধাকান্ত দু’লক্ষ টাকায় রাজি হন। বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতের রাজনীতিতে কোম্পানির বেড়ে চলা প্রভাবের সঙ্গে বিশেষ এঁটে ওঠা আর সম্ভব নয়। তিনি বলেন যে, সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি করা তাঁর অভিপ্রায় নয়। কিন্তু একটি ঘাট তৈরি করার জায়গা ও নিজের বাড়ি থেকে সরাসরি সেই ঘাটে যাওয়ার রাস্তার জন্য খানিক জমিও আদায় করে নিয়েছিলেন।
নদীর ধার বরাবর এলাকা বাঙালি তথা ভারতীয় সমাজে চিরকাল অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। প্রাত্যহিক পুজো-পার্বণ, হাট-বাজার, মেলা-উৎসব সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার! ইংরেজ কোম্পানির নজর ব্যবসা, জাহাজ-বন্দর, পণ্য চলাচল, মুনাফার উপর। ফলে দরকার নদীর পাড়ের ভিড় সরানোর। অমৃতলাল বসুর লেখায় চমৎকার ফুটে ওঠে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি:
‘‘য়ুরোপীয়েরা যখন বাঙ্গালায় প্রথম আসেন, তখন এদেশের লোকরাই ছিলেন মানুষ আর ওঁরা ছিলেন গেঁড়িগুগলি; তাই মা গঙ্গার মহিমা না বুঝতে পেরে কলিকাতার প্রান্তপ্রবাহিণীকে হুগলী নাম দিয়েছেন, আবার সেই হুগলীর কতকাংশ জঞ্জাল ফেলে ভরাট করে রাস্তা তৈরী করেছেন স্ট্রাণ্ড ব্যাঙ্ক। আমরা চিরকালই বাস্তুপ্রিয়, সেই জন্য জমি পেলেই বাড়ী তৈরী করি, আপনারা বাস করি আবার পাঁচজনকে ডেকে-ডুকে এনে বসবাস করাই; আর ইংরাজরা চিরদিনই ভবঘুরে, তাই সুবিধে পেলেই বাস্তু ভেঙ্গে রাস্তা তৈয়ার করেন। যার যেমন প্রবৃত্তি।…
হিঁদুর ছেলে গঙ্গা দেখলেই তার মা গঙ্গা বলে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব দিতে ইচ্ছে করে, ঐ মধুর পবিত্র সলিল নিজে পান করে পরিতৃপ্তির আনন্দে অঞ্জলি অঞ্জলি জল তুলে পিতৃপুরুষগণের তৃপ্ত্যার্থ উদ্দেশে তর্পণ কর্ত্তে ইচ্ছে করে… আর সাহেবের ছেলে আবার সেই গঙ্গা দেখেই ভাবে যে, এই স্রোতে ডিঙ্গা ভাসিয়ে মাল আমদানী করারও যেমন সুবিধা, আর এর তীর বেঁধে দিয়ে মাসুল রোজগারেরও তেমনই সুবিধা।’’
জমি কেনাবেচার মাধ্যমে শহরে জমির বাজার তৈরি হয়। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই কোম্পানি নানাভাবে কলকাতার জমির উপর নিজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগের কিস্তিতেই বলা হয়েছে কীভাবে নতুন কেল্লা তৈরি করার সময়ে গোবিন্দপুর অঞ্চলের বাসিন্দাদের হটিয়ে দিয়ে পুরো এলাকা সাফ করে দেয়। কিছু বড়লোক পরিবারকে উত্তরের দিকে জমি দেওয়া হয়, যা পরবর্তীকালের ‘নেটিভ টাউন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। কিন্তু গরিব চাষি-জেলে-তাঁতিদের কপালে যে ঠিকঠাক ক্ষতিপূরণ জুটেছিল, তা নয়। তাঁদের অনেকে পূর্বের জলাভূমির দিকে সরে যান। এই ভাবে, উচ্ছেদের অধিকারকে হাতিয়ার করে, কোম্পানি কলকাতার ভূসম্পদের উপর ধাপে ধাপে কর্তৃত্ব কায়েম করে, স্থানীয় বিত্তশালী পরিবারগুলিকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। সমকালীন মাদ্রাজ শহরেও একইরকম ছবি দেখতে পাওয়া যায়। আইনি নানা ফাঁকফোকর দিয়ে, নতুন আইন বানিয়ে, পুরনো আইনকে ‘ভুল’ ভাবে ব্যাখ্যা করে কোম্পানি কলকাতাকে কেন্দ্র করে এক নতুন ‘জমির বাজার’ তৈরি করতে সক্ষম হয়, যেখানে জলা, বালি, পলি, কাদামাটিকে শুকিয়ে, বুজিয়ে, বাঁধ দিয়ে ‘ভূসম্পদ’ গড়ে ওঠে, যে সম্পদ কেনাবেচা যায়, যার উপর কর চাপানো যায়। কলকাতার গড়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে কোম্পানির ‘সরকার’ হয়ে ওঠার ইতিহাসও জড়িয়ে আছে।
কলকাতার এই জলজ অতীত আমরা মনে রাখি না আর আজ। কিন্তু শহরের আড়ে-বহরে বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্বের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জল, জমি, সম্পত্তি, মুনাফার এক নিবিড় অর্থনীতি। এখনও নানাভাবে বয়ে চলেছে এই ধারা। অতীত ভুলেছি, শহরের ভবিষ্যৎ নিয়েও আমরা ভাবি না খুব একটা।
ঋণস্বীকার: দেবযানী ভট্টাচার্য, এম্পায়ার অ্যান্ড ইকোলজি ইন দ্য বেঙ্গল ডেল্টা: দ্য মেকিং অফ ক্যালকাটা (২০১৮)