ডাক্তারি মতামত গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকারের শুধু দয়া-দাক্ষিণ্য করে চললে হয় না। পরিকাঠামো তৈরি করার ক্ষেত্রে পয়সা বিনিয়োগ করার পর তা সুদে-আসলে আদায় করার উপায় না থাকলে কর্তাব্যক্তিদের মুখ ভার হয়ে যেত। তখন আর চিকিৎসকের বক্তব্য গুরুত্ব পায় না। লাভ-ক্ষতির খতিয়ানের ওপর নির্ভর করে কোন রাস্তা তৈরি করা হবে, কোথায় পাইপ দিয়ে জল সরবরাহ করা হবে, কোন এলাকায় কাঁচা নর্দমা পাকা করা হবে। নাগরিক পরিষেবা চালু করার পর সরকার ট্যাক্স বসাতে চায়, আর সেখানেই গোল বাঁধে। ব্রিটিশ সরকারের আশঙ্কা ছিল যে, ভারতীয়রা মোটেই পরিষ্কার জল, চওড়া খোলামেলা রাস্তাঘাট, মাটির নিচে পাকা নর্দমা, এই সব আধুনিক নাগরিক ব্যবস্থার কদর করবে না।
উনিশ শতকে বিশ্বজুড়ে আধুনিক শহর গড়ার এক হিড়িক পড়ে যায়। সামন্ততান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নগর জীবনও নতুন মাত্রা লাভ করে। বিরাট আকারে শিল্পায়ন, ধনতন্ত্র, আর সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিভূমি হয়ে ওঠে বড় শহর। আকারে-প্রকারে বা সামাজিক সাংস্কৃতিক রীতিনীতিতে ইউরোপ-আমেরিকার শহরের তুলনায় ঔপনিবেশিক ভারতের শহরের বেশ ফারাক থাকলেও কিছু কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য এই সময়ে পৃথিবীব্যাপী নাগরিক জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। একদিকে যেমন একইসঙ্গে ম্যানচেস্টার বা বম্বের মতো শহরে শ্রমিকদের বাড়িঘর নিয়ে আলোচনা পাওয়া যায়, অন্যদিকে তেমনই লন্ডনের হাইড পার্কের সঙ্গে তুলনায় চলে আসে কলকাতার ময়দান। নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রে নানা বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলে উনিশ শতক যুগান্তকারী কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল মানব সমাজে। পাইপ দিয়ে বাড়ির অন্দরে জল পৌঁছে যাওয়া, বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমলে রাস্তা-ঘর, মাটির নিচ দিয়ে গোটা শহরের নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে ওঠা, ট্রাম-ট্রেনে হু হু করে যাতায়াত করা– এরকম হরেক কিসিমের নিত্যনতুন তাক লাগানো আবিষ্কার কয়েক দশকের মধ্যে মানুষের প্রতিদিনের জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিল। আদর্শ শহুরে নাগরিকের সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের ব্যবধান যেন কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল এই কয়েক দশকের মধ্যেই।
এই বিবিধ প্রযুক্তির প্রয়োগ সব শহরে একইরকম ছিল না। ‘সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর’ কলকাতায় এই নানা পরিষেবা উনিশ শতকের বিভিন্ন পর্বে চালু হয়েছিল বটে, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে যে কীভাবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা এর উপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। সাম্রাজ্যের অর্থনীতির স্বার্থে কলকাতায় কিছু পরিকাঠামো নির্মাণ অত্যাবশ্যক ছিল– যেমন বন্দর তৈরি করা, রেলপথ চালু করা, রেল স্টেশন থেকে বন্দর অবধি মাল নিয়ে যাওয়ার জন্য চওড়া রাস্তা বানানো, ইত্যাদি। অন্যদিকে, কলেরায় হু হু করে শহরে লোক মারা যেতে শুরু করলে তার প্রতিকার করাও আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় নগর কর্তৃপক্ষের কাছে।
ক্রান্তীয় জলবায়ু নিয়ে উনিশ শতকের গোড়া থেকে ইউরোপীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান মহলে এক ধরনের ভীতি তৈরি হয়– এতে মানুষের আয়ু কমে যায়, মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে, নানা রোগব্যাধি খুব সহজেই কাবু করে ফেলে। ভারতের, বিশেষত বাংলার, লোকজন যে বিশেষ প্রকৃতির দুর্বল ও মরণশীল, তার একটা প্রধান কারণ এই অঞ্চলের জলহাওয়া– এরকম একটা বক্তব্য বেশ জোরালো হয়ে ওঠে এই সময়ে। আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য জাতিগত (racial) বৈশিষ্ট্য, সামাজিক সাংস্কৃতিক আচারকানুন, পূজা-পার্বণও যুক্ত হয়েছিল বাঙালির অকর্মণ্যতার হেতু হিসাবে। একইসঙ্গে কলকাতা শহরে বাঙালি তথা ভারতীয়দের এলাকাগুলো অবিলম্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা দরকার, এই মত মোটামুটি ১৮০৩ সালে গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির ‘মিনিট’ থেকে শুরু করে ১৮২০-’৩০-এর দশকগুলিতে লটারি কমিটির কার্যবিবরণীতে, জেমস রেনাল্ড মার্টিনের নোটস অন মেডিক্যাল টোপোগ্রাফি অফ ক্যালকাটা বা ফিভার হসপিটাল কমিটির রিপোর্টে, বা আরও পরের কলকাতা কর্পোরেশনের হেলথ অফিসারের রিপোর্টে বারবার ঘুরেফিরে আসে।
এই অবস্থার উন্নতি করার জন্য নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হয় উনিশ শতকের গোড়া থেকেই। রাস্তা বানানো, পরিশুদ্ধ জল সরবরাহ করা, গ্যাসের বাতি লাগানো, বা ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি করা– ঔপনিবেশিক সরকার নানাকিছু বন্দোবস্ত করেছিল কলকাতাকে এক মস্ত আধুনিক নগর রূপে গড়ে তুলতে। এইসব প্রকল্পের প্রস্তাব, পরিকল্পনা, ও রূপায়ণ সংক্রান্ত দলিল-দস্তাবেজ পড়লে দুটো জিনিস বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একদিকে যেমন দেখা যায় ডাক্তারি মহলের শহরের হাল-হকিকত নিয়ে নানা আশঙ্কা, আতঙ্ক, আশু কর্তব্যের ফিরিস্তি, অন্যদিকে পাওয়া যায় সরকারি নানা দপ্তরের চিঠি চালাচালি– যার মূল বক্তব্যই হচ্ছে সরকারের টাকা নেই সারা শহর জুড়ে আধুনিক পরিকাঠামো তৈরি করার। নগর পরিকল্পনার বিবিধ নকশা উনিশ শতকের কাগজপত্রে যে পরিমাণ পাওয়া যায়, বাস্তবে তার প্রতিফলন অতি সামান্য। কলকাতার নগরায়ণ সম্পর্কে একটা চালু ধারণার– কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে, যেমন তেমন প্রকারে বেড়েছে, বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
এবার, একটু যদি ভাবি আমরা, যে এতই যদি মাথাব্যথা সরকারের, এবং প্রায় দেড়শো বছর ধরে যে আলোচনা চলেছে, তার পরেও কী করে শহরের তথাকথিত ‘ব্ল্যাক টাউন’ ব্ল্যাকই রয়ে গেল– তার আর ‘সাদা’ হয়ে ওঠা হল না? কেন ১৮২০-’৩০এর রিপোর্টে যে ভাষায় উত্তর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেই ভাষা প্রায় অপরিবর্তিত রয়ে গেল ১৮৭০-’৮০-’৯০ এর সরকারি নথিপত্রেও? তাহলে একশো বছর ধরে কী উন্নতি করল ঔপনিবেশিক সরকার?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
একটু খুঁটিয়ে লেখ্যাগারের নথিপত্র পড়লে দেখা যাবে যে কলকাতার নগরায়ণ নিয়ে ভাবনাচিন্তার অন্ত ছিল না। সমস্যা ছিল অন্যত্র। জ্বরজারি হলে, শুদ্ধ পানীয় জল না পেলে, বা রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না হলে শুধু ভারতীয়দের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে, তাই নয়; ইউরোপীয় বাসিন্দাদেরও জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। সেই সময়ের জনপ্রিয় ‘মায়াসমা’ তত্ত্ব অনুযায়ী পচে যাওয়া শরীর থেকে বাতাসে রোগের জীবাণু ছড়াত। ভারতীয় শরীরের রোগ বাতাসবাহিত হয়ে সাহেবদের কাছে পৌঁছে যাওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা। ফলে নাগরিক পরিষেবার কিছু কিছু উন্নতি অত্যন্ত জরুরি ছিল। আগের লেখায় বলেছি যে, কীভাবে ঔপনিবেশিক সরকার নানাভাবে শহরের ভারতীয় অঞ্চলগুলিকে চিহ্নিত করত রোগ-জীবাণুর কেন্দ্র হিসেবে, সেই অঞ্চলগুলির বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, নর্দমা– সবকিছুই যে শহরে আলো-হাওয়া চলাচলের ক্ষতি করছে এই বক্তব্য বারেবারে ফিরে এসেছে সরকারি রিপোর্টে। ডাক্তারি অভিমতও সেরকম ছিল। ফলে এর প্রতিকারের কথা যখন বলা হল– এবং গোটা উনিশ ও বিশ শতক জুড়ে এই বক্তব্য পাওয়া যায়– তখন স্বাভাবিকভাবেই এই ঘিঞ্জি অঞ্চলগুলির কথা সবার আগে আলোচনায় উঠে আসে।
এবার, একটু যদি ভাবি আমরা, যে এতই যদি মাথাব্যথা সরকারের, এবং প্রায় দেড়শো বছর ধরে যে আলোচনা চলেছে, তার পরেও কী করে শহরের তথাকথিত ‘ব্ল্যাক টাউন’ ব্ল্যাকই রয়ে গেল– তার আর ‘সাদা’ হয়ে ওঠা হল না? কেন ১৮২০-’৩০এর রিপোর্টে যে ভাষায় উত্তর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেই ভাষা প্রায় অপরিবর্তিত রয়ে গেল ১৮৭০-’৮০-’৯০ এর সরকারি নথিপত্রেও? তাহলে একশো বছর ধরে কী উন্নতি করল ঔপনিবেশিক সরকার?
ডাক্তারি মতামত গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকারের শুধু দয়া-দাক্ষিণ্য করে চললে হয় না। পরিকাঠামো তৈরি করার ক্ষেত্রে পয়সা বিনিয়োগ করার পর তা সুদে-আসলে আদায় করার উপায় না থাকলে কর্তাব্যক্তিদের মুখ ভার হয়ে যেত। তখন আর চিকিৎসকের বক্তব্য গুরুত্ব পায় না। লাভ-ক্ষতির খতিয়ানের ওপর নির্ভর করে কোন রাস্তা তৈরি করা হবে, কোথায় পাইপ দিয়ে জল সরবরাহ করা হবে, কোন এলাকায় কাঁচা নর্দমা পাকা করা হবে। নাগরিক পরিষেবা চালু করার পর সরকার ট্যাক্স বসাতে চায়, আর সেখানেই গোল বাঁধে। ব্রিটিশ সরকারের আশঙ্কা ছিল যে, ভারতীয়রা মোটেই পরিষ্কার জল, চওড়া খোলামেলা রাস্তাঘাট, মাটির নিচে পাকা নর্দমা, এই সব আধুনিক নাগরিক ব্যবস্থার কদর করবে না। কিছু কর্তার মত ছিল যে, বাঙালিরা সবসময়েই সন্দিগ্ধ থাকে নতুন কোনও ব্যবস্থার প্রতি, তাঁরা সেগুলি মেনে নেয় না, এবং অযথা ঝামেলা পাকায়। আর বস্তিবাসী গরিব লোকগুলো যে ট্যাক্স দেবে না, সে তো জানা কথাই! ফলে এই অঞ্চলগুলিতে নতুন পরিষেবা চালু করলে সব ভার সরকারকে বহন করতে হবে।
এভাবে জাতিগত বৈশিষ্ট্য, কোনও এলাকার শ্রেণি চরিত্র, আর আর্থিক লাভ-লোকসানের জটিল হিসেবনিকেশের মধ্য দিয়ে কলকাতায় বিভিন্ন আধুনিক পরিষেবা চালু হয়। ঔপনিবেশিক সরকারের নজরে যে এলাকা গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে স্বভাবত আগে বসে জলের পাইপ বা গ্যাসের বাতি। আর যে এলাকায় ঘেঁষাঘেঁষি বস্তিবাড়ি, অন্ধকার পথঘাট সে এলাকায় বহু বছরেও পৌঁছয় না আলো-জল। টাকা দেবে কে? শহরের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে যে তারতম্য ছিল, তা নতুন করে আবার তৈরি হতে থাকে আধুনিক পরিষেবার অসমান ভৌগোলিক বিস্তারে।
কলেরার আতঙ্ক উনিশ শতকের কুড়ি-তিরিশের দশকে ডাক্তারি মহলে যে শোরগোল ফেলেছিল, তা থমকে দাঁড়ায় টাকা-পয়সার হিসেবের সামনে। ১৮৯০-এর শেষে যখন প্লেগের ভয়ে শহর কাঁপছে, প্রশাসন সরাসরি গিয়ে ঘুপচি বাড়ি ভেঙে আলো-হাওয়া চলাচলের বন্দোবস্ত করে দেয়। এই কয়েক দশকে শহরের উন্নতি হয়নি– এ কথা কেউ বলবে না। কলকাতা পূর্ব-গোলার্ধের অন্যতম বড় বন্দর শহর হিসেবে গড়ে ওঠে। কিন্তু, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, সেই উন্নতি ছিল কার জন্য?
সময় বদলেছে, রাজনীতি বদলেছে, উন্নতির বদলে উন্নয়নের ভাষায় কথা বলি আমরা, কিন্তু এখনও প্রশ্ন তোলা যায় যে আমাদের শহরের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা-স্বাচ্ছন্দ্য কার জন্য? অঞ্চলভেদে তারতম্যের নতুন ভাষা আমরাও কি খুঁজে নিইনা?
ঋণস্বীকার: পার্থ দত্ত, প্ল্যানিং দ্য সিটি: আর্বানাইজেশন অ্যান্ড রিফর্ম ইন ক্যালকাটা, ১৮০০-১৯৪০ (২০১২)
(চলবে)