মাধাই মিটিং-মিছিল বাড়িয়েছে। শীতলার মৃত্যুর প্রতিবাদে অনেক রঙের পতাকার দলেরা এসেছে। তবে ভূমিপুত্র মাধাই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। রেশমী একদিন সব মেয়েকে নিয়ে ওদের মিটিংয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েওছিল। খেতমজুর পরিবাররা সবাই এসেছিল। মাধাই শেষ কথা নয়, ওর মাথার ওপর কেউ তো আছে, সবাই জানে। কিন্তু এখন এলাকায় মাধাই প্রতিবাদী মুখ।
১০.
শীতলা সোরেনের ভয়ংকর মৃত্যুটা একধাক্কায় কুসুমডিহারের অনেক কিছু বদলে দিয়ে গেল।
আপাত শান্ত জায়গাটা হিংস্র হয়ে ফুঁসতে লাগল। অবিশ্বাসের মেঘ ছেয়ে ফেলল আকাশটা। স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল। সাবধানী চাউনিতে চরবৃত্তি চলে এল। পুলিশ পিকেট বসল। টহলদারি চলল।
আর সুমিতের সঙ্গে রেশমীর সম্পর্কের সেতুটি কেমন যেন ভেঙে দুমড়ে গেল। শীতলার মৃত্যু শুনেও ছুটে যেতে চায়নি সুমিত, এই কাপুরুষতা নিতে পারেনি রেশমী। দু’চারদিনেই অনুমান করেছে বাহারাও। ভূগোলদিদিকে নিয়ে ডাকঘরের দিকে যেতে চেয়েছে। দিদি এড়িয়ে গিয়েছে। বুধনি বলেছে, ‘মাস্টারমশাইও তো সমাজের কত কাজ করেন। রাতবিরেতে পড়িয়ে বেড়ান। ডাক্তার এনে ক্যাম্প করেন। নরম মনের মানুষ। ওরকম ডেডবডি দেখতে যেতে পারেননি। তাই বলে…।’
রেশমী বলেছে, ‘জীবনের আসল লড়াইতেই যদি না থাকে, তাহলে ওসব শখের সমাজসেবার কী দাম? আর পড়ানো? ও তো সময় কাটে না বলে। ওর কথা আমার সামনে বলবি না।’
বাকিরা বুঝেছে রেশমী এখন সুমিতের ওপর ভয়ানক রেগে।
পড়ুন পর্ব ৯: কুসুমডিহাতে পুলিশ, নেতা, বুদ্ধিজীবী, মহিলা কমিশন, মিডিয়ার ভিড়
এদিকে মাধাই মিটিং-মিছিল বাড়িয়েছে। শীতলার মৃত্যুর প্রতিবাদে অনেক রঙের পতাকার দলেরা এসেছে। তবে ভূমিপুত্র মাধাই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। রেশমী একদিন সব মেয়েকে নিয়ে ওদের মিটিংয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েওছিল। খেতমজুর পরিবাররা সবাই এসেছিল। মাধাই শেষ কথা নয়, ওর মাথার ওপর কেউ তো আছে, সবাই জানে। কিন্তু এখন এলাকায় মাধাই প্রতিবাদী মুখ।
একদিন থানার ডাক এসেছিল। রাহুলসাহেব টানা তিন ঘণ্টা জেরা করেছেন। মাধাইদের সংগঠন, যোগাযোগ, টাকাকড়ি– এসব নিয়ে। মাধাই পাশ কাটিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু বুঝে গিয়েছে, সতর্ক থাকার পালা শুরু। জঙ্গল কানেকশনে নজর পড়ছে।
বাঁশরীলাল আর বিদ্যুৎকে পুলিশ এলাকায় না রাখায়, নতুন জটিলতা হয়নি। কুসুমডিহা আসতে আসতে ঠান্ডা। তবে সবাই সব খবর রেখেছে। এখানে বিদ্যুৎদের বাড়িতে বাকি দু’-চারজন আত্মীয়স্বজন আছে। আর আছে পুলিশ পিকেট। একদিন খবর এল, যথাযথ প্রমাণের অভাবে পুলিশ বাঁশরী আর বিদ্যুতের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে পারেনি। আইনি পর্ব থেকে তাদের মুক্তি। এবার আবার তারা কুসুমডিহা ফিরতে চাইছে। পুলিশও এবার রাজি। কুসুমডিহা শান্ত, পুলিশ পিকেটও থাকছে, ফেরানো যেতেই পারে।
এমন সময়ই এক রাতে দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে গোপনে মোবাইল ফোনে কথা হচ্ছে প্রেসিডেন্সি জেলে। কমরেড রুদ্র আর কমরেড বিশাল। দুই পুরনো খেলোয়াড় আবার সমস্ত নেটওয়ার্ক নিয়ে তৈরি। একটু আগেই পুলিশের এক সোর্সের সঙ্গে কথা বলছিলেন বিশাল। জানতে পেরেছেন, চারদিন পর সোমবার সশস্ত্র পাহারায় বাঁশরীলাল আর বিদ্যুৎকে কুসুমডিহা ফেরাবে পুলিশ। বিশাল বললেন রুদ্রকে, ‘এটা হতে দেওয়া যায় না। তাহলে এলাকাটা ওরা শেষ করে দেবে।’
পড়ুন পর্ব ৮: জঙ্গলমহলের তল্লাট থেকে উত্তাপ ছড়াল কলকাতার মিডিয়াগুলির স্টুডিওতেও
রুদ্র বললেন, ‘কিন্তু আমাদের সংগঠনের উপস্থিতি টের পেলে তো আরও সর্বনাশ।’
–সর্বনাশের কোনটা বাকি থাকছে?
–সেটা ঠিক। তবে আমার মনে হয় ওখানে কমরেড ব্রহ্মাকে বিষয়টা জানিয়ে দেওয়াই ভালো। সুনেত্রারাও তো আছে। যা ভালো বোঝে করবে। আর ওই ছেলেটি, কী নাম, ফ্রন্টাল উইংয়ের… মাধাই, মাধাইকেও জানিয়ে রাখা ভালো। ওরা দেখুক।
–সোমবারের ব্যাপারটা এখনই কমরেড ব্রহ্মা, সুনেত্রা আর ওই মাধাইকে জানিয়ে দেব?
–দেখুন, ব্রহ্মা আমাদের এই ফোন ব্যবহার করেন না। আমি অন্য লোক মারফত ওঁকে জানাচ্ছি। সুনেত্রাকেও। আপনি শুধু মাধাইকে জানান। মনে রাখবেন মাধাইরাও কিন্তু ব্রহ্মাকে চেনে না। ব্রহ্মা সবাইকে চেনেন। অন্য টিম ঢুকিয়ে কাজ করান। যে কোনও ফোনে ধরা দেন না। অথচ সবার খবর উনি রাখেন।
একটু পর ফোন পেল মাধাই। সোমবার গ্রামে আসছে দুই শয়তান। রাগে মাথায় আগুন জ্বলতে শুরু করল।
মাধাই জানল না, তার ফোনে আড়ি পাতা ছিল, পাঁচ মিনিটের মধ্যে খবরটা পৌঁছে গেল রাহুল মিত্রর কাছে।
(চলবে)