জ্ঞানদা সবে পঞ্চদশী। আর তার নতুন ঠাকুরপো ষোলোয় পড়েছে। কী যে ঝলমলে সুন্দর এই ষোলো বছরের কিশোর– জ্ঞানদা যত দেখে, তত অবাক হয়। শুধু যে মোমের মতো শরীরের আলো, তা তো নয়। শরীরের আলোয় মিশেছে বোধবুদ্ধির জ্যোতি, জ্যোতি নাম তাই সত্যিই সার্থক। জ্ঞানদা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার ‘নতুন’ ঠাকুরপোর দিকে। তারপর দুপুরবেলা একা ঘরে শুয়ে সে তার মধ্যে নতুন ঠাকুরপোকে নিয়ে তার ওই ‘অবাক’ ব্যাপারটা খুঁড়তে থাকে।
১৪.
জ্ঞানদা স্বামী সত্যেন্দ্রর মধ্যে যে-মানুষটাকে খোঁজে, সেই মানুষটিকে কি পায়? সত্যেন্দ্র যখন খুব কাছের, তখনও অনেকটাই থেকে যায় দূরে– এমন অদ্ভুত ভাবটি জ্ঞানদাকে কষ্ট দেয়। সেই কাছের মানুষটিকে জ্ঞানদা পায় তার ‘নতুন’ ঠাকুরপো জ্যোতিরিন্দ্রর মধ্যে। জ্ঞানদা ও জ্যোতিকে সমবয়সি বললে ভুল হয় না। আগেই বলেছি, দেবেন্দ্রনাথ-সারদার ষষ্ঠ সন্তান, পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রর জন্ম ১৮৪৯-এর মে মাসে। আর জ্ঞানদা জন্মেছে ১৮৫০-এর জুলাই মাসে। সুতরাং, ঠাকুরবাড়িতে জ্ঞানদার সবচেয়ে কাছের মানুষ, কী বয়সে কী মনে, তার ‘নতুন’ ঠাকুরপো-ই। জ্যোতির সান্নিধ্যে এবং সঙ্গে জ্ঞানদার মনের আরাম সবচেয়ে বেশি। জ্যোতির মুখে ‘মেজবউঠাকরুণ’ ডাকে সেই টান ক্রমশ অনুভব করেছে জ্ঞানদা, যে-টানে কেমন যেন ভালোবাসার সঙ্গে মিশে আছে ভয়, ক্রমশ মনে হচ্ছে জ্ঞানদার।
মেজবউঠাকরুণ পর্ব ১৩: বিলেতে মেয়েদের গায়ে কী মাখিয়ে দিতে, জ্ঞানদার প্রশ্ন সত্যেন্দ্রকে
জ্ঞানদা সবে পঞ্চদশী। আর তার নতুন ঠাকুরপো ষোলোয় পড়েছে। কী যে ঝলমলে সুন্দর এই ষোলো বছরের কিশোর– জ্ঞানদা যত দেখে, তত অবাক হয়। শুধু যে মোমের মতো শরীরের আলো, তা তো নয়। শরীরের আলোয় মিশেছে বোধবুদ্ধির জ্যোতি, জ্যোতি নাম তাই সত্যিই সার্থক। জ্ঞানদা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার ‘নতুন’ ঠাকুরপোর দিকে। তারপর দুপুরবেলা একা ঘরে শুয়ে সে তার মধ্যে নতুন ঠাকুরপোকে নিয়ে তার ওই ‘অবাক’ ব্যাপারটা খুঁড়তে থাকে। খুঁড়তে-খুঁড়তে একেবারে ক্রমশ আবছা হয়ে আসা তলায় চলে যায়। আর বুঝতে পারে, তার মনের সেই আবছা অতলে থই-থই করছে প্রেম! নিঃসঙ্গ দুপুরে একা ঘরে জ্ঞানদা ডুব দেয় সেই থই-থই-এ! সারা শরীর তার শিউরে ওঠে অচেনা আনন্দে। তারপর সমুদ্রের ঢেউয়ে যেমন মিশে থাকে ফেনা, জ্ঞানদার শরীরের শিউরে-ওঠা আনন্দে তেমনই মিশে যায় ত্রাস!
মেজবউঠাকরুণ পর্ব ১২: ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে
–মেজবউঠান, দুপুরবেলার সুখস্বপ্ন ভাঙালাম নাকি, পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়ায় দেবদূতের মতো কান্তিময় ‘নতুন’ ঠাকুরপো।
জ্ঞানদা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। আঁচল সামলাতে-সামলাতে সে তাকিয়ে জ্যোতির দিকে। বিন্দুক্ষণ বাক্যহারা। তারপর বলে, ‘ঈশ্বর ছাড়লেন শেষ পর্যন্ত?’
জ্যোতিরিন্দ্রর গৃহকশিক্ষক তখন ওরিয়েন্টাল সেমিনারির প্রধান শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র নন্দী। ঈশ্বরচন্দ্র জ্যোতিকে পড়াতে বসলে উঠতে চান না। তার এই শিক্ষকটিকে নিয়ে নিত্য বাঁকা কথা শুনতে হয় জ্যোতিকে মেজবউঠাকরুণের কাছে। দুপুরবেলাতেই নিঃসঙ্গ ঠাকুরবাড়িতে ‘নতুন’-কে একা পাওয়া যায়, কাছের মানুষটিকে একেবারে নিজের করে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই ক্ষণিকের আনন্দের ওপর থাবা বসিয়েছেন ঈশ্বর। তিনি আটকে রাখেন নতুন-কে। এবং দেবদূতের মতো ছাত্রটিকে আটকে রাখার জন্য ঈশ্বর প্রতি দুপুরে নতুন নতুন বিষয়ের খাঁচা তৈরি করেন।
–আজকের বিষয়টা কী নতুন ঠাকুরপো? হেসে জিজ্ঞেস করে জ্ঞানদা।
–হিউম, বলে জ্যোতি।
–হালুম! আজকের বিষয় তাহলে বাঘ!
–বাঘই বটে। নতুন ভাবনার বাঘ, মেজবউঠান, ডেভিড হিউম সত্যিই ছিলেন দ্য মোস্ট নটোরিয়াস এনিমি অফ রিলিজিয়ান অ্যান্ড গড। ঈশ্বরচন্দ্র নন্দী আজ দুপুরে আমার জীবনে নিয়ে এলেন নিরবচ্ছিন্ন নাস্তিক ইংরেজ দার্শনিক ডেভিড হিউমকে– তিনি ঈশ্বরহীনতার হালুমই বটে। এবং তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র!
মেজবউঠাকরুণ পর্ব ১১: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
–একেই কি বলে আয়রনি! ভাগ্যের পরিহাস! চোখে বোধবুদ্ধির আলো ফুটিয়ে বলে জ্ঞানদা।
–তোমাকে তারিফ না করে উপায় নেই বউঠান। তুমি কিন্তু একেবারে বাংলার নবজাগরণের নায়িকা, সন্দেহ নেই।
–নতুন, আমি নবজাগরণের নায়িকা কি না, জানিনে। তবে যতটুকু জমি পেয়েছি পায়ের তলায়, ততটুকু থেকে যেন ছিটকে না যাই, সেই দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে, কথাটা বলেন জ্যোতির হাতটি নিজের মধ্যে আঁকড়ে ধরে জ্ঞানদা। তারপর বলে, আমাকে ধরে রেখো ঠাকুরপো, ছেড়ে যেও না।
–আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ তোমার বর, তুমি পাচ্ছ ছিটকে যাওয়ার ভয়!
–তিনি তো কাল রাতেই বোম্বাইয়ের ট্রেন ধরেছেন। নতুন চাকরি, বোম্বাইয়ের নতুন রেলপথ, আমার কথা তাঁর মনে থাকার কথা নয়।
–তা নয় বউঠান, তুমি ভুলে যাচ্ছ মাথার ওপর বাবামশাইয়ের শাসন। তোমাকে তো মেজদাদা বিলেত নিয়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছিল। বাবামশায় এক লাইনের চিঠি লিখলেন মেজদাদাকে, জানো না?
–না তো নতুন! কী লিখেছিলেন বাবামশায়?
–সত্যেন, তুমি যেন অন্তঃপুরের মানমর্যাদার ওপরে হস্তক্ষেপ না করো, ব্যস, শুধু এইটুকু!
–আমার কি মনে হচ্ছে জানো নতুন? তোমার মাস্টারমশাই ঈশ্বরচন্দ্র নন্দীরও বেশি দিন ঠাঁই হবে না এ-বাড়িতে।
–হঠাৎ এই আশঙ্কা?
–ওই যে, তোমার জীবনে ওই নাস্তিক হালুমকে নিয়ে এলেন তিনি, বাবামশায়ের কানে কথাটা উঠলে কিন্তু…
–আরও এক আয়রনি বউঠান, বলে জ্যোতিরিন্দ্র।
–আয়রনি? বিস্মিত জ্ঞানদা!
–আয়রনি নয়? ক’দিন আগে বাবামশায় আমাকে ‘ব্রহ্মদীক্ষায়’ দীক্ষিত করেছেন। তারপরেই নাস্তিকরাজ ডেভিড হিউমের আবির্ভাব ঘটালেন আমার জীবনে স্বয়ং ঈশ্বর! এরচেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে বলো?
–না, আমিই তাঁর ব্রহ্মদীক্ষার প্রথম শিকার, কপট গাম্ভীর্যে বলে জ্যোতি।
–একদিকে হালুম। অন্যদিকে ব্রহ্মদীক্ষা। কী করবে তাহলে?
–স্রেফ পালাব।
–কোথায়?
–মেজদাদার কাছে, আমেদাবাদে।
–আমি যাব।
–বাবামশায়ের হালুম হিউমের হালুমের থেকেও ভয়ংকর, বলে জ্যোতি।
হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হাসিতে তার নতুনকে জড়িয়ে ধরে জ্ঞানদা। নতুনও তার মেজবউঠানকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। তারপর বলে, আমার ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’ শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেজবউঠান। গণেন্দ্র, গুণেন্দ্র, আমি এবং আরও দু’জন– কমিটি অফ ফাইভ। এই নাট্যশালার মূলে।
–বাবামশায়ের অনুমতি? পেয়েছ?
–আবার ওয়ান লাইনার–
–এবার কী?
–একেবারে মোক্ষম মেজবউঠান।
–শব্দসংখ্যা? চোখে-ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে জ্ঞানদাসুন্দরী।
–শব্দসংখ্যা অব্যর্থ পঞ্চপাণ্ডব। নাট্যপথে চরিত্রস্খলন যেন না ঘটে।
(চলবে)
তথ্যসূত্র: রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন। সমীর সেনগুপ্ত
স্মৃতিকথা: জ্ঞানদানন্দিনী ঠাকুর