জ্ঞানদা পালঙ্ক থেকে নামতে যাবে, তার বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে নিষেধ। সৌদামিনীর কাছে যাওয়া তো বারণ। ছুঁলেই জামা-কাপড় ছাড়তে হবে, গঙ্গাজলে চান করতে হবে। অশৌচ ধোলাইয়ের আরও অনেক ফিরিস্তি, নিয়মকানুন। মরলেও অশৌচ। আবার জন্মালেও অশৌচ। একটা হল গিয়ে অশুভ অশৌচ। অন্যটা শুভ অশৌচ। কিন্তু ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা দুটোতেই সমান-সমান।
১০.
ক’দিন ধরে জ্ঞানদা অসুস্থ। একা ঘরে শুয়ে তার মনে পড়ছে যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে তার বাপের বাড়ির কথা। ছোট্ট মাটির বাড়ি। গরিব বাবা-মা। তার গ্রামের সব লোকই ঠাকুরবাড়ির প্রজা। জ্ঞানদার বাবা অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দয়াতেই বেঁচে আছে। মা নিস্তারিণী তো দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনলে প্রণাম করে। এহেন রাজবাড়িতে জ্ঞানদার বিয়ে হবে, এমন রূপকথা কী অভয়াচরণ আর নিস্তারিণীর স্বপ্নেও দেখা দিয়েছে কখনও! তবু তা-ই তো হল। যশোরের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে জ্ঞানদানন্দিনীকেই দেবেন্দ্রনাথ আর সারদা তাঁদের বাড়ির মেজবউ করে ঘরে তুললেন।
এসব কথা ভাবতেই একা ঘরে অসুস্থ জ্ঞানদার চোখে জল এল। কতদিন হয়ে গেল, সে মাকে দেখেনি। অসুখ করলে তো জ্ঞানদা মা-র কোলে মাথা রেখেই শুয়ে থাকত। আর মা, কী আদরে-যত্নে জ্ঞানদার গায়ে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিত। তাতেই তো অর্ধেক অসুখ সেরে যেত। আর বাকি অর্ধেক অসুখ সেরে যেত গাঁয়ের হোমিও ডাক্তার বুড়ো অমিত বিশ্বেসের মিষ্টি-মিষ্টি ওষুধে। নরেন্দ্রপুরে তাদের গাঁয়ের বাড়িতে অসুখ করলে এমন একা ঘরে পড়ে থাকতে হত না জ্ঞানদাকে। জ্ঞানদা সেই সাত বছর বয়স থেকে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে থাকতে বুঝেছে, যতক্ষণ ভালো আছ, এ বাড়িতে ততক্ষণ তোমার জন্য সবাই আছে, সবকিছু আছে। আর যে-ই তুমি অসুস্থ, সে-ই তুমি একা। হ্যাঁ, ডাক্তার-বদ্যি-ওষুধ– সব আছে বটে। সে তো লোক দেখানো। কিন্তু আদর-যত্ন নেই। মা-র জন্য জ্ঞানদার মন হু-হু করে ওঠে। ডাক্তার যে আসেনি, জ্ঞানদাকে দেখেনি, ওষুধের ব্যবস্থা হয়নি, তা তো নয়। কিন্তু মা-র আদর-যত্ন, ওষুধ খাওয়ানো, পথ্য তৈরি করা, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমপাড়ানি গান, কোথায় সেসব? একা ঘরে জ্ঞানদার চোখ দিয়ে জল গড়ায়।
হঠাৎ জ্ঞানদার মনে পড়ে সৌদামিনীকে। সৌদামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, জ্ঞানদার বড় ননদ, তার স্বামীর বড় বোন, তার থেকে তিন বছরের বড়। জ্ঞানদা অসুস্থ, সৌদামিনী এ-খবর জানলে নিশ্চয়ই তার পাশে এসে শুয়ে পড়ত, তাকে ওষুধ খাওয়াত, খিদে পেলে খাবারের ব্যবস্থা করত। কিন্তু বড় ননদ এখন আঁতুড় ঘরে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আঁতুড় ঘর খালি যায় না। এখন সে ঘর সৌদামিনীর। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব জামাই-ই হল গিয়ে ঘর-জামাই। বড় লোকেদের ব্যাপারই আলাদা!
পড়ুন পর্ব ৯: রোজ সকালে বেহালা বাজিয়ে জ্ঞানদার ঘুম ভাঙান জ্যোতিঠাকুর
জ্ঞানদা বিছানায় উঠে বসে। না, এভাবে বিছানায় পড়ে থাকলে অসুখ আরও পেয়ে বসবে। বরং বড় ননদের কাছে গিয়ে একবার বসি। একটু কথা বলি। সে কেমন আছে, সেটা জানাও তো তার কর্তব্য তার মেজদাদার বউ হিসেবে। কবে আসবে সে বিলেত থেকে? মেম বিয়ে করে আসবে না তো? তাহলে কী করবে জ্ঞানদা? পুরুষরা তো এদেশে যখন-তখন যত খুশি বিয়ে করতে পারে! পুরুষের এই বেমক্কা স্বাধীনতা একেবারে ভাল লাগে না জ্ঞানদার। তার ভয় করে।
জ্ঞানদা পালঙ্ক থেকে নামতে যাবে, তার বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে ওঠে নিষেধ। সৌদামিনীর কাছে যাওয়া তো বারণ। ছুঁলেই জামা-কাপড় ছাড়তে হবে, গঙ্গাজলে চান করতে হবে। অশৌচ ধোলাইয়ের আরও অনেক ফিরিস্তি, নিয়মকানুন। মরলেও অশৌচ। আবার জন্মালেও অশৌচ। একটা হল গিয়ে অশুভ অশৌচ। অন্যটা শুভ অশৌচ। কিন্তু ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারটা দুটোতেই সমান-সমান। এই বিশাল ঠাকুরবাড়ির এককোণে তাই ঘুপসি আঁতুড়ঘর। স্যাঁতসেতে, অন্ধকার। এবং সদ্য মা-হওয়া মেয়েটিকে সেখানে সব্বার ছোঁয়াছুঁয়ির বাইরে এক ঘরে হয়ে থাকার শাস্তি পোহাতে হয়। সদ্য বাপ-হওয়া পুরুষটি কিন্তু ড্যাংড্যাং করে মহা আমোদে ঘুরে বেড়াতে পারে চাদ্দিকে। তার কোনও বালাই নেই। ভাবলে গা জ্বলে যায় জ্ঞানদার! সে বিছানা ছেড়ে দুর্বল টলমলে পায়ে সৌদামিনীকে দেখতে আঁতুড় ঘরের দিকে যাত্রা শুরু করে। দক্ষিণের বারান্দা পেরিয়ে তাকে যেতে হবে অনেকটা পথ। মাঝখানে দাসীদের রাজত্ব। তাদের দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব নয়। ‘মেজোবউঠান, কোথায় চললে গো? ওদিকে তো আঁতুড়। অশৌচ সামলে দূর থেকে দেখবে, চলো, যাই তোমার সঙ্গে, যা ছটফটে তুমি, এখুনি একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে!’ ছুটে আসে হরিদাসী।
পড়ুন পর্ব ৮: অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা
পিছন ফিরে তাকায় জ্ঞানদা, মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে। দেখে হরিদাসীর হাতে বেতের ছোট্ট ঝুড়ি ভর্তি ঘিয়েভাজা চিঁড়ে।
–কার জন্য? জিজ্ঞেস করে জ্ঞানদা।
–কার জন্য আবার? সৌদিদির জন্য। এই হরিদাসী ছাড়া সৌদিদির তাড়াতাড়ি নাড়ি শুকোনোর কথা কে মনে রেখেছে বলো? ঘিয়েভাজা চিঁড়ে ছাড়া নাড়ি শুকোবেই না।
–আর আমার যে খিদেয় নাড়ি জ্বলছে, বলে জ্ঞানদা।
–তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সকাল থেকে মুখে কিছু দাওনি তো? তা তোমার যে অসুখ, কোবরেজ কিছু ‘পত্য’ দিলে না?
–আমায় কিছু চিঁড়েভাজাই দাও, খেয়ে বাঁচি, বলে জ্ঞানদা।
–তাহলে আঁচল পাতো।
আঁচল পাতে জ্ঞানদা। হরিদাসী বেতের ঝুড়ি থেকে দোনামনা অবস্থায়, দু’-মুঠো চিড়েভাঁজা তুলে দেয় জ্ঞানদার আঁচলে। তারপর স্থূল রসিকতা করে বলে, মেজদাদাবাবু বিলেত থেকে ফিরুন, তারপর তোমারও চিঁড়েভাজা খাওয়ার অবস্থা হবে। বলে খিলখিল করে হাসে। জ্ঞানদার গা রি-রি করে। কিন্তু সে আঁচল থেকে ঘিয়ে ভাজা চিঁড়ে মুখে দিয়ে অশৌচ বাঁচিয়ে সৌদামিনীর অনেকটা দূরে বসে বলে, খুব খিদে পেয়েছিল রে!
–মেজবউঠান! আমি জানতাম, তুমি ঠিকই আসবে। তুমি তো অসুস্থ। তা-ও তো এসেছ! এ-বাড়িতে ছেলেপিলে হওয়া একটা শাস্তি।
–অসুখ করাও কম শাস্তি!
–অসুখ করাও কম শাস্তি নয় সৌ, হেসে বলে জ্ঞানদা।
–মেজদাদা কবে ফিরছে, জানো কিছু?
–শুনেছি, আরও দিন দশেক। এখন তিনি মহাসমুদ্রে ভাসছেন।
–কে বলল?
–নতুন, বলে জ্ঞানদা।
‘নতুন’ শব্দটা কেমন যেন শোনায় তার মুখে। অবাক হয়ে তাকায় সৌদামিনী। তারপর সেই বিস্ময়-ভাবটি লুকিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে সৌদামিনী বলে, ‘রবিটা দেখতে-দেখতে বড় হয়ে উঠছে। কাল হঠাৎ আঁতুড়ঘরে এসে আমার কোলে বসে পড়ল। অমনি হরিদাসী হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠল। যেন সমস্ত সৃষ্টি রসাতলে গেল।’
পড়ুন পর্ব ৭: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
সৌদামিনী কথাটা শেষ করে প্রাণ খুলে হাসল। বাবামশায়ের মেয়েদের মধ্যে একমাত্র সৌদামিনীই বেথুন স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করেছে। তাছাড়া বাড়িতে ক্রিশ্চান মিশনারি মেয়েদের কাছেও ইংরেজি শেখা মেয়ে সে। অন্তঃপুরে এসে সৌদামিনীকে দুই পুরুষ শিক্ষকও পড়িয়েছেন কিছুদিন। একজন কেশবচন্দ্র সেন। অন্যজন, অযোধ্যানাথ পাকড়াশী। সুতরাং বড় ননদটির প্রতি জ্ঞানদার বিশেষ দৃষ্টি।
–রবি কোলে বসে পড়তেই আমার কী মনে হল যেন?
–কী মনে হল?
–আমি ওর দিদি নই!
–তাহলে কে তুমি?
–মা! আমি ওকে কোলে নিতেই আমার মধ্যে মাতৃভাব উথলে উঠল। সেই সঙ্গে একটা ভয়ও ঢুকল।
–ভয়!
–হ্যাঁ গো মেজবউঠান! জানোই তো আমাদের মা-র শরীর ইদানীং খুব ভাল যাচ্ছে না। হাতের সেই ক্ষতটা তো সারছে না। ডাক্তারের সন্দেহ ক্যানসার।
মা না থাকলে রবির ভার আমাকেই নিতে হবে। বাবামশায় একটি চিঠি লিখেছেন আমাকে। তিনি ভবিষ্যৎ দেখতে পান। কাল পেয়েছি এই চিঠি।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত চিঠিটা জ্ঞানদার হাতে দেয় সৌদামিনী। জ্ঞানদা পড়ে:
‘‘তোমাকে আমি ‘গৃহরক্ষিতা’ সৌদামিনী আখ্যা দিলাম। ‘রক্ষিতা’ শব্দটি বিকৃত অর্থে প্রচলিত। মূল অর্থ, ‘রক্ষাকর্ত্রী’। তোমার আত্মাতে দেবভাবের স্ফূর্তি দেখিয়াই আমাদের গৃহদেবতা পরম দেবতার নিকটে প্রতিদিন বাড়ির সকলকে উপস্থিত করিবার ভার তোমাকেই দিয়াছি।’’
চিঠিটা পড়ার পর জ্ঞানদার মনের খটকা আরও যেন বেড়ে যায়? তার মুখে ‘নতুন’ শব্দটির উচ্চারণে তার বড়ননদ কি তেমন কোনও গহন আভাস পেয়েছে? সে পরিবারের রক্ষাকর্ত্রী সৌদামিনীর পানে কিছুটা আড়ষ্টভাবে তাকায়।
তথ্যসূত্র: পুরাতনী। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী
রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন। সমীর সেনগুপ্ত