জ্ঞানদা ক্রমশ বুঝে গেছে, সে ভারতীয় প্রথম আইসিএস-এর বউ। সে শ্বশুর-শাশুড়ির দু’জনের মাথাই কাটল। তাঁদের ভাবমূর্তির মাথা গড়াগড়ি দিল জ্ঞানদার একটি বাক্যে গোপনতথ্য ফাঁস করে দেওয়ার অপ্রত্যাশিত অভিঘাতে: মা একখানি ধোয়া-শাড়ি পরতেন, তারপর একটু আতর মাখতেন, এই ছিল তাঁর রাতের সাজ।
৭.
জ্ঞানদানন্দিনী দৃঢ় মনের মানুষ। তার সিদ্ধান্তে নড়চড় হল না। বাবামশায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রহ্মসাধনা, সংসার থেকে পালিয়ে হিমালয়ে সাধন, অথচ দূর থেকে সংসারের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রেখে শাসন চালানো, ইত্যাদি সত্ত্বেও তার শাশুড়ি সারদাদেবীর যে বছর বছর সন্তান হয় (পনেরোটিতে এসে থামেন দেবেন্দ্র-সারদা)– একথা বলতে, এবং এই ভাষায় জানাতে, এতটুকু দ্বিধা করেনি দেবেন্দ্র-সারদার মেজবউমা জ্ঞানদা: আমার শাশুড়ির প্রায় বছর-বছর ছেলে হয়! তাঁর একটু স্থূল শরীর, তাই বেশি নড়াচড়া করতে পারেন না!
এইটুকু বলেই ছেড়ে দেয়নি জ্ঞানদা। এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি ঠাকুরবাড়ির এই বউমাটি দেবেন্দ্রনাথ এবং সারদার ভাবমূর্তিতে ছুঁচ ফোটাতে। পার্টিশেষে বেলুনের মতো ওঁদের ইমেজ: ‘আমার মনে পড়ে বাবামশায় তখন বাড়ি থাকতেন, আমার শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন।’ কত রাত করে সারদার ডাক পড়ত দেবেন্দ্রনাথের ঘরে? জ্ঞানদার ঠোঁটকাটা উত্তর: ‘ছেলেরা সব শুতে গেলে।’ ডাকলেই কি যেতে হত সারদাকে? চোদ্দোটি সন্তান যখন হয়ে গিয়েছে, তখনও?
পড়ুন আগের পর্বটি: পেশোয়াজ অন্দরমহল আর বারমহলের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল
অবশ্যই! স্বামীর ডাক, স্ত্রীকে তো যেতেই হবে। এবং সেই স্বামীর নাম যখন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং তিনি মাঝে-মাঝে হিমালয়ে ব্রহ্মসাধনা থেকে নেমে এসে ডাক দিয়েছেন স্ত্রীকে, তিনি কোন ক্লান্তিতে বা সাহসে বলবেন ‘না’? ছেলেমেয়েরা যে রাত্রিসুখ ও সহবাস উষ্ণতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে প্রতিদিন উপভোগ করছে, সেই উপভোগ থেকে বছরে মাত্রই কয়েকটা দিন বাড়ির কর্তা বঞ্চিত হতে পারেন? এটা কি সুবিচার? তবে দেবেন্দ্রর ডাক এলেই কি সবকিছু ভুলে তড়িঘড়ি ছুটতে হত সারদাকে? না না, তা কেন? সারদার ব্যক্তিগত আড়ালে বেয়াদপি করেই ঢুকে পড়েছে জ্ঞানদা। এবং বলা যায়, হাটে হাঁড়ি ভেঙেছে। বলিহারি সাহস এই মেয়ের!
জ্ঞানদা ক্রমশ বুঝে গেছে, সে প্রথম ভারতীয় আইসিএস-এর বউ। তার স্বামীর যা উপার্জন, খ্যাতি, এবং প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা এবং সাহেবদের সঙ্গে সমান সমান এক গেলাসের যে নৈকট্য– সে হাতে মাথা কাটতেই পারে। এবং করলও তাই। সে শ্বশুর-শাশুড়ির দু’জনের মাথাই কাটল। তাঁদের ভাবমূর্তির মাথা গড়াগড়ি দিল জ্ঞানদার একটি বাক্যে গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার অপ্রত্যাশিত অভিঘাতে:
মা একখানি ধোয়া-শাড়ি পরতেন, তারপর একটু আতর মাখতেন, এই ছিল তাঁর রাতের সাজ।
আরও একটি মারাত্মক ‘সিক্রেট’ জানে জ্ঞানদা। এবং উগরে দিতে তার এতটুকু সংকোচ বা দ্বিধা বা ভয় নেই। ‘দেবেন্দ্রনাথ ভগবানের সন্ধানে পাহাড়ে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান। মা শুয়ে শুয়ে কেবল ভাবেন, তাই সংসারের কাজে বড় একটা মন দিতে পারেন না।’
বিশেষ করে পুজোর সময়, ঠাকুরবাড়ির ‘হিন্দু’ অংশে, দুর্গাপুজো হয়, উৎসবের আনন্দ হয়। মূর্তিপুজোর এই বেদনা ও যন্ত্রণা দেবেন্দ্র সহ্য করতে পারেন না। তিনি পালিয়ে যান হিমালয়ে। সেখানে ব্রহ্মচর্চায় ও নিরাকার ঈশ্বর সাধনায় মগ্ন থাকেন। পুজোর ক’দিন শাশুড়িমা কী বেদনাময় একাকিত্বে কাটান, তা অনুভব করতে পারে জ্ঞানদা।
এতৎসত্ত্বেও সারদার ‘বছর বছর ছেলে হয়’– তাতে বেশ বিস্মিত জ্ঞানতা। এবং এই বিস্ময় সে ইশারায়-ইঙ্গিতে প্রকাশ করেছে!
এবার একটু অন্য কথায় আসি। বাঙালি মাত্রেই দুই সারদাকে চিনি। একজন শ্রীরামকৃষ্ণের স্ত্রী সারদাদেবী। অন্যজন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী সারদা দেবী, যাঁকে আমরা চিনি তাঁর চোদ্দো নম্বর সন্তান রবীন্দ্রনাথের পরিচয়-গৌরবে। তাঁর স্বামীর পরিচয়ে নয়। অথচ, তাঁর এই চর্তুদশতম সন্তানের প্রতিভা-প্রতাপেই যে তিনি টিকে যাবেন, সেই ভবিষ্যৎ কোনওভাবেই আন্দাজ করতে পারেননি সারদা। এবং বারো বছরের রবিকে তার দু’-বছরের বড় শ্যামলবর্ণা নতুন বউঠান কাদম্বরীর কেয়ারে রেখে তিনি বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।
শ্রীরামকৃষ্ণের স্ত্রী সারদা এবং ধনী জমিদার, দাপুটে দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী সারদা– তাঁদের শুধু নামেই মিল নয়, তাঁরা দু’জনেই আপাতভাবে অশিক্ষিত, সেকেলে মহিলা। এই দুই অশিক্ষার তফাতটা বুঝতে হবে। রবীন্দ্রনাথের মা সারদার অশিক্ষার সঙ্গে মিশেছে ঠাকুরবাড়ির বুর্জোয়া অহং, সারবত্তাহীন আভিজাত্যের কপট ভদ্রতা, যার নীচে অহংকার ও অপমানের শানানো ছুরি। একটা উদাহরণ দিই, রবীন্দ্রনাথের মা সারদা কতদূর নিষ্ঠুর হতে পারতেন। লিখছেন, সারা বিশ্বকে জানিয়ে, স্বয়ং জ্ঞানদা, সারদার মেজবউমা, তাঁর সেজছেলে আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বউ। জ্ঞানদার বিয়ের পরে বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। তার বাবা-মা, যশোরের অভয়াচরণ ও নিস্তারিণী মুখোপাধ্যায়, কতদিন মেয়েকে দেখেননি। তাঁরা যশোর থেকে কলকাতায় এসেছেন। তাঁরা তো ধনী নন। অভয়াচরণ দেবেন্দ্রনাথেরই কর্মচারী ও প্রজা। যাই হোক, কলকাতায় একটা ভাড়া বাড়িতে উঠে নিজেদের কাছে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে জন্য পালকি পাঠালেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। তখন কিন্তু জ্ঞানদার স্বামী আইসিএস হয়ে ফিরেছেন কলকাতায়। এবার সরাসরি শুনুন জ্ঞানদার মুখ থেকে:
‘মা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবার জন্য পালকি পাঠালেন। কিন্তু শাশুড়ি ঠাকরুন বললেন, ভাড়াবাড়িতে বউ পাঠাবেন না। আমি তাঁর উপর তো কখনও কিছু বলিনি, এই কথা শুনে লুকিয়ে ছাতের এক কোণে বসে কাঁদতে লাগলুম। দাসীদের ভয় করতুম, কেননা তারা মায়ের কাছে লাগিয়ে বকুনি খাওয়াত।’
ইনিই হলেন রবীন্দ্রনাথের মা সারদা! তুলনা চলে এই মায়ের সঙ্গে আমাদের সকলের সারদা মা-র? কখনও কারও প্রতি এমন অনাদরের, এমন অনুভবহীন হৃদয়বর্জিত ব্যবহার তিনি করেছেন? কোনও কালে? কোনও সময়ে! একটি বারও?
(চলবে)
তথ্যসূত্র: পুরাতনী। জ্ঞানদানন্দিনীদেবী
রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন। সমীর সেনগুপ্ত