রোজ একটা দুঃখ কাঁপে জ্ঞানদার মনে। নতুনের বয়স ষোলো হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই তার বিয়ের কথা হচ্ছে। নতুন তখন তো আর তার ঘরে একলা থাকবে না। নতুন তখন বেহালা বাজাবে তার বউয়ের ঘুম ভাঙাতে। এই ভাবনাটা এলেই তার মনের মধ্যে তৈরি হওয়া নতুনের ছবিটা ছিঁড়ে যায়।
৯.
ঠিক এক বছর দু’-মাসের বড় দেওরটিকে নিয়ে জ্ঞানদার মধ্যে ক্রমশ জাগছে সেই মুগ্ধতা, যার মধ্যে তিরতির করে বয়ে চলেছে অনেকখানি ‘অবাক’! কী করে ‘নতুন’ এমন সুন্দর কবিতা লেখে! নাটক লেখে! গান লেখে! পিয়ানো বাজিয়ে গানে সুর দেয়! কী করে নতুন একই সঙ্গে এত তাড়াতাড়ি দুটো ভাষা শিখে ফেলেছে– সংস্কৃত আর ফরাসি! কী করে এমনভাবে কালিদাসের কাব্য পড়াতে পারে ‘নতুন’! অমন খোলাখুলি প্রেমের কথা তার মুখে শুনলে লজ্জা পেতে বেশ লাগে জ্ঞানদার! আরও একটা ‘অবাক’ অতর্কিতে জমা হয়েছে জ্ঞানদার জ্যোতিমুগ্ধতায়: ‘নতুন’ এত সুন্দর কেন! যেন দেবদূত! মনে হয় জ্ঞানদার। পৃথিবীর আরও কোনও মেয়ের এমন সুন্দর দেওর কিছুতেই নেই– থাকতে পারে না! জ্ঞানদা নিশ্চিত।
ভোরবেলা প্রথম আলো ফুটতেই ‘নতুন’ তার ঘরে বসে বেহালা বাজায়। জ্ঞানদার ঘুম ভাঙে সেই সুর শুনে। কিন্তু সে বিছানা ছাড়ে না। সে বিছানায় শুয়ে, বেহালা শুনতে শুনতে, একটা ছবি তৈরি করে মনে মনে। সেই ছবিটা এই রকম: নতুন জানলার ধারে বসে বেহালা বাজাচ্ছে। পুবের জানলায় বসেছে নতুন। সূর্যর প্রথম রাঙা আলো এসে পড়েছে নতুনের পদ্মপাপড়ির মতো চোখে। নতুনের চোখ, নতুনের কপাল, নতুনের নাক, নতুনের ঠোঁট, নতুনের গায়ের রং আর নতুনের লম্বা-লম্বা গোলাপি আঙুল– একে একে সবটা ভাবে জ্ঞানদা। সে চোখ বুজে থাকে। চোখ খুললে পাছে ছবিটা ছিঁড়ে যায়! ভয় করে তার নতুনকে ক্ষণিকের জন্যও হারাতে। চোখ বুজে জ্ঞানদা নতুনকে আঁকড়ে থাকে।
আরও পড়ুন: অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা
রোজ একটা দুঃখ কাঁপে জ্ঞানদার মনে। নতুনের বয়স ষোলো হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই তার বিয়ের কথা হচ্ছে। নতুন তখন তো আর তার ঘরে একলা থাকবে না। নতুন তখন বেহালা বাজাবে তার বউয়ের ঘুম ভাঙাতে। এই ভাবনাটা এলেই তার মনের মধ্যে তৈরি হওয়া নতুনের ছবিটা ছিঁড়ে যায়।
জ্ঞানদা চোখ খোলে। বিছানায় উঠে বসে। তার আঁচলখসা বুকের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। নতুনের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে তার মনে। ছাদের কোণে বসে নতুন কালিদাস পড়ে শোনাচ্ছে জ্ঞানদাকে। জ্ঞানদার খুব লজ্জা করছে। আবার লজ্জা পেতে জ্ঞানদার খুব ভাল লাগছে। জ্ঞানদা পালাতে চায়। জ্ঞানদা মনে মনে নতুনের গলা জড়িয়ে ধরে।
নতুন পড়ছে– তরুণী ভারি সুন্দর। তার নাম শকুন্তলা। শকুন্তলা বলল, তার সহচরীকে, সই, আমার বুকের ঢাকনাটা বড্ড আঁট হয়ে গেছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে, একটু আলগা করে দাও। তখন সখী বলছে, শকুন্তলা, তোমার বক্ষবন্ধনীর তো কোনও দোষ নেই। যত দোষ তোমার যৌবনের। তোমার বুক দু’টির দিকে তাকিয়ে দেখ। তুমি তাদের ভার বহন করে কি সামান্য নত হয়ে পড়নি, যেমন ফুলের-ফলের ভারে নত হয় গাছের ডাল!
জ্ঞানদা তাকায় ভোরবেলার আলোয় তার বুক দু’টির দিকে। নতুনের কণ্ঠে কালিদাসের কথাগুলি যেন ভোরের আলো। কী নরম আদরে ছুঁয়ে থাকে তার বুক। মনে পড়ে নতুনের কণ্ঠস্বর।
শকুন্তলার জ্বর হয়েছে। গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। এ জ্বর আসলে ভালবাসার জ্বর। কামনায় জ্বলছে তরুণী শকুন্তলা। সেই কামজ্বর ঠান্ডা করার জন্য শকুন্তলা স্তনের উপর রাখল দু’টি ভেজা পদ্মপাতা। শীতল হল তার কামনার জ্বর।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
কথাগুলো কী অমল সাবলীলতায় বলল নতুন! সব মনে আছে জ্ঞানদার। নতুন কিন্তু ভারি অসভ্য! বেছে বেছে শুধু ওই জায়গাটাই পড়তে হল। কালিদাস কি সবটাই শরীর!
নতুনের বেহালা বেশ কিছুক্ষণ থেমেছে। এখন সে পিয়ানো বাজাচ্ছে। বিদেশি সুর। এই সুর জ্ঞানদা চেনে। নতুনই তাকে চিনিয়েছে। ‘কী মিষ্টি! শোনো বউঠান, শোনো। একবার শুনলে মোৎসার্ট-কে ভুলবে না!’
–মোৎসার্ট!
–হ্যাঁ, বউঠান। মোৎসার্ট। উলফ্গাং… আমাডেয়ুস্… মোৎসার্ট। এইটিনথ্ সেঞ্চুরির অস্ট্রিয়ান কম্পোজার। প্রডিজি, বুঝলে, ব্যাখ্যার অতীত মিউজিকাল প্রডিজি।
–কী বানান গো নতুন? বিদঘুটে নামের বানানটা না জিজ্ঞেস করে পারে না জ্ঞানদা।
হেসে ফেলে নতুন। সেই জ্যোৎস্নার মতো হাসিটা হুবহু মনে আছে জ্ঞানদার।
একটু পরে, সামান্য ভেবে, ইংরেজি বানানটা একটা কাগজে লিখে দেয় জ্যোতিরিন্দ্র। Wolfgang Amadeus Mozart. কাগজের টুকরোটা জ্ঞানদা তার পেশোয়াজের বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর ঘামে ভেজা সেই কাগজ, ঈষৎ গলে যাওয়া সেই নাম সমেত, সে রেখে দিয়েছে আলমারির গোপন ডেরায়। সেখানে নতুনের মুক্তোর মতো হাতের লেখায় আরও একটা চিলতে কাগজ আছে। সেই কাগজ যতবার পড়ে জ্ঞানদা, ততবার খুব আহ্লাদ হয় তার। নতুনের দুষ্টুমির অব্যর্থ উদাহরণ সেই কাগজ! নতুন তার ছেলেবেলার প্রথম গুরুমশাইটিকে এইভাবে স্মরণ করেছে সেই চিলতে লেখায়। এতবার পড়েছে সেই মজার লেখা, জ্ঞানদার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে: ‘গুরুমশাইটি একেবারে, সেকেলে পণ্ডিতের জ্বলন্ত আদর্শ। রং কালো। গোঁপজোড়া কাঁচাপাকায় মিশ্রিত মুড়া খ্যাংরা। চুল লম্বা। পড়াবার সময়গুরুমশাই অর্ধউলঙ্গ। পা ছড়িয়ে বসে তৈলমর্দন করতেন। সেই তৈলের কী বিটকেল গন্ধ। তার একগাছি ছোট বেত ছিল। নিজের দেহের সঙ্গে সেটিকেও তিনি সযত্নে তেল মাখাতেন।’
আরও পড়ুন: বাঙালি নারীশরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান
এই কাগজের তলায় আরও একটি কাগজ আছে। এই চিলতেটি আরও গোপনে রক্ষিত। একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে জ্ঞানদা বলে ফেলল, ‘পুরুষের কিন্তু এত সুন্দর হওয়া মোটেও উচিত নয়।’
–তুমি কার কথা বলছো বউঠান?
–তোমার কথা, আবার কার ঠাকুরপো! ভগবান তো তোমার রূপের কিছুটা আমাকেও দিতে পারতেন।
–ভগবানের দয়া আছে। তিনি তোমাকে আরও সুন্দর করলে আমার যে আরও বড় সর্বনাশ হত, তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
এ কথার এই উত্তর দেবে নতুন, ভাবতে পারিনি! কথাটা জ্যোৎস্নারাত্রে ছাদে বেড়াতে বেড়াতে বলেছিল নতুন। সারারাত ঘুমোতে পারিনি। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, নতুনের বড্ড কাছাকাছি চলে যাচ্ছি। নিজেকে এবার সামলাতে পারিনে। কী জানি, আমার এই অসহায় অবস্থা নতুন বুঝতে পেরেছে কি না! সে দিন দুয়েক পরে আমাকে একটা ছোট্ট চিঠি লিখল। বিপজ্জনক চিঠি। কিন্তু আলমারিতে না রেখে দিয়েও পারেনি। নতুন লিখেছে:
মেজবউঠাকরুণ,
তুমি সেদিন বললে, ভগবান যদি আমার রূপের কিছুটা তোমাকে দিতেন, তোমার প্রতি সুবিচার হত। কারণ, পুরুষ মানুষের এত রূপ ভাল নয়। এই প্রসঙ্গে একটি সত্য ঘটনার কথা তোমাকে লিখে জানাচ্ছি। আমার রূপমুগ্ধ এক পুরুষপ্রেমিকের উদয় হয়েছে আমার জীবনে। সে আমার রূপে মুগ্ধ হয়ে কী কাণ্ড করেছে, সেকথা আমাকে জানিয়েছে। সে হিন্দু স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র! আর আমি পড়ি প্রেসিডেন্সিতে, জানোই তো! যাই হোক, আমি যখন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরি, আমাকে একটিবার দেখার জন্য রাস্তায় রোজ দাঁড়িয়ে থাকে। সে আমাকে লিখেছে, আপনাকে দেখার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি। আমি তেরো বছরের বালক। তেরো বছরের বালিকা হলে কী করতাম, জানি না। কিংবা জানি। আপনাকে জানাব না। তবে এইটুকু বলি, বালক হয়ে রক্ষে পেয়েছি। ইতি, অমৃতলাল বসু
বউঠান, অমৃতলালের রসবোধে সন্দেহের অবকাশ নেই। বড় হয়ে সে রসের ভাণ্ডার বা রসরাজ হবে, তাতেই বা সন্দেহ কী! তবে বউঠান, আমার কিন্তু মনে হয়, ততদিনই আমাকে তোমার রূপবান মনে হবে, যতদিন না রবি বড় হয়ে উঠছে। দেখতে-দেখতে সে ক’টা বছর কেটে যাবে। এরপর কিন্তু রবিই উঠে আসবে সেন্টার স্টেজে। ওকে আটকানোর উপায় নেই। রূপে-গুণে ওর ধারে কাছে কেউ যেতে পারব না। বাবামশায় তাঁর এই চতুর্দশ সন্তানটিকে ঠিকই চিনেছেন। সূর্যের সূর্য সে। তা-ই তো রবীন্দ্র!
তোমার নতুন
‘তোমার নতুন’– শব্দ দু’টির দিকে বারবার তাকিয়ে দেখেও আশ মেটেনি জ্ঞানদার। কতবার সে আদর করেছে শব্দ দু’টিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আর মনে মনে বলেছে, নতুন, আমার পাশে থাকো। জোড়াসাঁকোর বাড়ির মঞ্চের মাঝখানটা তোমার-আমার। ওখানে কাউকে আসতে দেব না। আমার পাশে থেকো চিরকাল। আগলে রেখো ঠাকুরবাড়িতে তোমার-আমার জায়গা!
অভিনেতা হিসেবে অভিনয়ের যে জায়গাগুলো তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যা আমি আগেও বলেছি, সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা, ভালো থাকার আকাঙ্ক্ষা, জয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সাধারণ মানুষ যা প্রকাশ করতে পারে না চট করে। মনোজ মিত্র তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তাকে বড় করে দেখিয়েছেন।