বুদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, মহারাজ, ধরুন আপনার কোনও কর্মচারী এই জাগতিক লাভালাভের জগৎ থেকে অব্যাহতি পেতে গ্রহণ করল প্রব্রজ্যা। হিংসা-লোভ পরিহার করে সে শান্ত সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতে শুরু করল। এখন যদি তার সঙ্গে আপনার আবার দেখা হয়, আপনি কি তাকে জোর করে দাসত্বের জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাইবেন?
২৩.
মগধরাজ অজাতশত্রুর কথা আমরা অনেকেই জেনেছি রবীন্দ্রনাথের ‘পূজারিণী’ কবিতা থেকে: অজাতশত্রু করেছে রটনা/ স্তূপে যে করিবে অর্ঘ্যরচনা/ শূলের উপরে মরিবে সে জনা/ অথবা নির্বাসনে’– গৌতম বুদ্ধের অন্যতম প্রধান শিষ্য নৃপতি বিম্বিসারের তিনি পুত্র। পিতাকে হত্যা করে তিনি সিংহাসন লাভ করেন, এবং তারপর ‘পিতার আসনে আসি/ পিতার ধর্ম শোণিতের স্রোতে’ মুছে ফেলেন তাঁর গোটা সাম্রাজ্য থেকে, বৌদ্ধস্তূপে অর্চনা বন্ধ করেন, বহু বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র পুড়িয়ে ফেলেন।
তাঁর এই প্রবল বৌদ্ধবিদ্বেষের নেপথ্যে বুদ্ধদেবের জন্মজন্মান্তরের শত্রু দেবদত্তের প্রভাবকে দায়ী করা হয়। অজাতশত্রু যেদিন শুনলেন, পাপের বোঝা আর বহন করতে না পেরে পৃথিবী বিদীর্ণ হয়ে দেবদত্ত পাতালে গ্রাস করেছে, প্রবল আতঙ্ক গ্রাস করল তাঁকে। তাঁর আশঙ্কা হল, নিয়তি বুঝি তাঁকেও সেই পথেই টানছে। ক্ষুধা, ঘুম, শান্তি সব ছুটল তাঁর।
তখন রাজগৃহে কার্তিক-উৎসব শুরু হয়েছে। অজাতশত্রু রাজসভায় অমাত্যদের কাছে তাঁর ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন, এমন কোন ব্রাহ্মণ বা শ্রমণ আছেন, যাঁর কাছে গেলে আমি শান্তি পেতে পারি? কেউ বললেন পূরণ কস্সপ-এর নাম, কেউ মক্খলি গোসাল, কেউ পকুধ কচ্চায়ন। রাজার অভিরুচি তাঁরা জানেন। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁরা বিভিন্ন ‘তৈর্থিক’ বা বৌদ্ধবিদ্বেষী শ্রমণদের কথাই বললেন। তাঁদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, তীব্র অনুতাপে নিয়ত ঝলসাতে ঝলসাতে মহারাজ চাইছেন তাঁর চরম প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে, চাইছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ কারও-র মুখে উঠে আসুক সেই নাম।
মহা-আমাত্য জীবক, আপনি কিছু বলবেন না?
রাজার আহ্বানে জীবক উঠে দাঁড়ালেন, মহারাজ, সব দ্বিধা সরিয়ে আপনি গৌতম বুদ্ধের শরণ নিন। সংশয় দূর করতে তাঁর কাছে উপস্থিত হন।
অজাতশত্রু আগে কখনও এমন শত শত সাধু একসঙ্গে দেখেননি। তাঁদের বিনীত, শান্ত, পবিত্র ভাব দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। তাঁরা ঘিরে রেখেছেন স্বয়ং বুদ্ধকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অজাতশত্রু রাজসভায় অমাত্যদের কাছে তাঁর ইচ্ছে ব্যক্ত করলেন, এমন কোন ব্রাহ্মণ বা শ্রমণ আছেন, যাঁর কাছে গেলে আমি শান্তি পেতে পারি? কেউ বললেন পূরণ কস্সপ-এর নাম, কেউ মক্খলি গোসাল, কেউ পকুধ কচ্চায়ন। রাজার অভিরুচি তাঁরা জানেন। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁরা বিভিন্ন ‘তৈর্থিক’ বা বৌদ্ধবিদ্বেষী শ্রমণদের কথাই বললেন। তাঁদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, তীব্র অনুতাপে নিয়ত ঝলসাতে ঝলসাতে মহারাজ চাইছেন তাঁর চরম প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে, চাইছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ কারও-র মুখে উঠে আসুক সেই নাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তাঁকে প্রণাম জানিয়ে মহারাজ শুধোলেন বৌদ্ধশাস্ত্রে ‘শ্রমণ্যফল-প্রশ্ন’ নামে পরিচিত সেই আদি জিজ্ঞাসা : লোকে যে কাজ করে তার ফল সুস্পষ্ট; যেমন কুম্ভকারের কাজের ফল জল রাখার ঘট, মালির কাজের ফল বাগানের ফল-ফুল; কিন্তু সংসার বিবাগী শ্রমণের ত্যাগের প্রত্যক্ষ ফল কী?
বুদ্ধ মৃদু হেসে বললেন, মহারাজ, ধরুন আপনার কোনও কর্মচারী এই জাগতিক লাভালাভের জগৎ থেকে অব্যাহতি পেতে গ্রহণ করল প্রব্রজ্যা। হিংসা-লোভ পরিহার করে সে শান্ত সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতে শুরু করল। এখন যদি তার সঙ্গে আপনার আবার দেখা হয়, আপনি কি তাকে জোর করে দাসত্বের জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাইবেন?
কখনই না। আমি বরং তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করব, দু-দণ্ড শান্তি পেতে তার কাছে গিয়ে বসব।
এই বটবৃক্ষ হয়ে ওঠাই শ্রমণ্যধর্মের প্রত্যক্ষ ফল।
অজাতশত্রু মুগ্ধ হলেন এমন সহজ ব্যাখ্যায়। আরও নানা আলাপনের পর আপ্লুত রাজা পুনরায় বুদ্ধকে প্রণিপাত করে বিদায় নিলেন।
বুদ্ধ ভক্তদের বললেন, দেখো, দুষ্টসঙ্গে অপরিণামদর্শী হয়ে মানুষ কেমন নিজের ধ্বংস নিজেই নিয়ে আসে। এই রাজা যদি তাঁর পরম ধার্মিক পিতাকে হত্যা বা আরও নানা অধর্মাচরণ না করতেন তাহলে এই সিংহাসনে বসে কত অনাবিল জীবন তিনি যাপন করতে পারতেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বুদ্ধ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন, এমন ভুল অজাতশত্রু আগেও করেছেন।
আগের জন্মে?
হ্যাঁ, তখন তার নাম ছিল সঞ্জীব। আমি সেই জন্মে ছিলাম বারাণসীর এক যশস্বী অধ্যাপক। আমার ৫০০ ছাত্রের মধ্যে সঞ্জীব ছিল অন্যতম। একদিন বনের মধ্যে কয়েকজন সতীর্থ-সহ যেতে যেতে তারা এক মৃত বাঘ দেখতে পেল। সঞ্জীবকে তখন সদ্য সদ্য মৃতকোত্থাপন (মৃতক+উত্থাপন, মৃতকে কিছুক্ষণের জন্য জীবনসঞ্চারকারী) মন্ত্র দিয়েছি। সে গর্বভরে বলল, দেখবে বাঘকে কেমন বাঁচিয়ে তুলব?
সঙ্গীরা তাকে উৎসাহ দিল, কিন্তু চটপট উঁচু বৃক্ষে নিরাপদ আশ্রয়ও নিল। কেউ মনে করিয়ে দিল না, সঞ্জীবের নিজেরও মনে এল না, প্রতিবাহন মন্ত্র তার এখনও অধরা।
ফল যা হওয়ার তা-ই হল। প্রাণ ফিরে পেয়ে বাঘ প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে সঞ্জীবের টুঁটি কামড়ে ধরল। তার কয়েক মুহূর্ত পর মৃত্যুর কোলে ফিরে গেল বাঘ নিজেও।
গাছ থেকে নেমে পাশাপাশি দুই মৃতদেহকে পাশ কাটিয়ে ফিরে এল সঞ্জীবের বন্ধুরা।
…নব জাতক-এর অন্যান্য পর্ব…
নব জাতক পর্ব ২২: এই জন্মে বোধিসত্ত্ব এক লোভের ফাঁদে পা দিলেন
নব জাতক পর্ব ২১: গাছতলায় শুয়ে রাত কাটাতে হল সারীপুত্রের মতো সম্মাননীয় শ্রমণকেও
নব জাতক পর্ব ২০: আফসোস যে শ্রেষ্ঠী-বালিকার পরিচয় অজ্ঞাত থেকে গেল
নব জাতক পর্ব ১৯: ছদ্মবেশে প্রজার সুখ দেখতে বেরিয়ে লজ্জিত হয়ে পড়লেন রাজা
নব জাতক পর্ব ১৮: ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ১৭: এত ছোট চারাই যদি এমন হয়, বড় বৃক্ষ হলে না জানি কেমন বিষাক্ত হবে
নব জাতক পর্ব ১৬: প্রকৃত চরিত্রবানের পিছনে তলোয়ারের আতঙ্ক রাখার দরকার হয় না
নব জাতক পর্ব ১৫: নেপথ্য থেকে যে নেতৃত্ব দেয়, তাকে অস্বীকার করা যায় না
নব জাতক পর্ব ১৪: প্রাণীহত্যার মতো নির্মম আয়োজনে দেবতার সন্তুষ্টি হয় কী করে!
নব জাতক পর্ব ১৩: এক হাজার দস্যুর লাশ আর রত্ন পেটিকা
নব জাতক পর্ব ১২: সীতা যখন রামের বোন, দিতে হয়নি অগ্নিপরীক্ষাও
নব জাতক পর্ব ১১: শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনও সন্ত্রাসবাদীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সে-ই বোধহয় প্রথম
নব জাতক পর্ব ১০: নিকটজনের অন্যায্য আবদারে রাজধর্মে বিচ্যুত হওয়া যায় না
নব জাতক পর্ব ৯: লকলকে লোভের আগুনে সদুপদেশ খাক হয়ে যায়
নব জাতক পর্ব ৮: যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করতে পারে না, শুধু জীবনের জয়গান
নব জাতক পর্ব ৭: অভয় সরোবর সত্ত্বেও কেন ব্যাধ ফাঁদ পেতেছিল সুবর্ণহংসের জন্য?
নব জাতক পর্ব ৬: জন্ম-জন্মান্তরের বিষয়-আকাঙ্ক্ষা যখন হেলাফেলা করা যায়
নব জাতক পর্ব ৫: পলাশ গাছ ছায়া দিত কালো সিংহকে, তবু তারা শত্রু হয়ে গেল
নব জাতক পর্ব ৪: দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও, অন্তর্দৃষ্টি প্রবলভাবে সজাগ
নব জাতক পর্ব ৩: শূকরের তাকানোয় বাঘের বুক দুরুদুরু!
নব জাতক পর্ব ২: আরও আরও জয়ের তৃষ্ণা যেভাবে গ্রাস করে অস্তিত্বকে
নব জাতক পর্ব ১: খিদে মেটার পরও কেন ধানের শীষ নিয়ে যেত পাখিটি?