লক্ষ্মী বলল, ‘দিদি, হাতে বন্দুক নিলেও তো জীবনটা সুখ-শান্তির হয় না? জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে, লুকিয়ে কাটাতে হয়।’ রেশমী বলল, ‘কষ্টের জীবন শুনেছি। তবে সম্মানের। ওই নামে মহাজন, পুলিশ, প্রশাসন ভয় পায়। আর গরিবরা সম্মান দেয়, আশ্রয় দেয়, ভালবাসে। নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করা যায়। কষ্টটা গায়ে লাগে না। আর থাকে শোষকের ওপর বদলার আনন্দ। এটা তো শুনি নেশার মতো।’
পর্ব ৩
কুসুমডিহারের আকাশ-বাতাস কাব্য লেখে। শালপিয়ালের কাব্য। ধামসা-মাদলের কাব্য। হাঁড়িয়ার কাব্য। জঙ্গলে পাতা কুড়োনোর কাব্য। বুনো হাতির পালের কাব্য। জঙ্গলের ওপর জঙ্গলবাসীর অধিকার ফুরিয়ে যাওয়ার কাব্য। সহজ-সরল জীবনগুলো থেকে প্রেম সরে গিয়ে শোষণ, শাসন, দমন-পীড়ন আর বিদ্রোহের কাব্য।
বাঁদিকে শালবনটা রেখে ভাঙাপথের রাঙাধুলোয় হাঁটছিল রেশমি। সঙ্গে বুধনি আর তার দু’-তিনজন বান্ধবী। কলেজ থেকেই ভূগোলদিদির সঙ্গে তারা। তবে আলোচ্য ভূগোল নয়, আলোচ্য বিদ্রোহে নারীশক্তি। বৃহত্তর আঙ্গিকের আলোচনা গল্পের আকারে একেবারে ফুলন দেবীতে এসে দাঁড়িয়েছে।
রেশমি বলল, ‘এই যে চম্বল, বেহড়; এই যে পুতলিবাই, ফুলন দেবী, সীমা পরিহার– এরা কারা? এরা কেন ডাকাত হল? এদের প্রত্যেকের পিছনে দেখো ভয়ানক অত্যাচারের ইতিহাস। মেয়েরা এভাবেই অত্যাচারিত হয়েছে। তাদেরই প্রতিনিধি হয়ে কখনও কখনও ফুলনদের জন্ম হয়েছে বদলা নিতে। মেয়েটাকে গণধর্ষণের পর নগ্ন করে গ্রামে ঘুরিয়েছিল। ওর হিম্মত আছে, হাতে বন্দুক নিয়ে পাল্টা বদলা নিয়ে গণহত্যা করে এসেছে। আবার নিজেও শেষ হয়েছে বদলাতেই। এই খেলার বোধহয় শেষ হয় না।’
বুধনিরা শুনছে, বুঝতে চাইছে, বোধহয় বেহড়ের সঙ্গে জঙ্গলমহলকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।
বাহা বলল, ‘দিদি, জঙ্গলের যে মেয়েরা বন্দুকের দলে চলে গিয়েছিল, তারা?’ পিঠোপিঠি প্রশ্ন করল বুধনি, ‘সেই সুনেত্রা এখন কোথায় আছে? বাকিরা?’
আগে এসব প্রসঙ্গ এই অঞ্চলে প্রকাশ্যে আলোচনায় অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। এখন ক্রমশ পরিস্থিতি সহজ হয়েছে।
হাঁটা থামিয়ে শিক্ষিকা, ছাত্রীরা মিলে একদফা ফুচকা হয়ে গেল। হঠাৎ নীরবতা। শুধু হুসহাস শব্দ। তারপর আবার চলা শুরু, এবং কথা।
রেশমী বলল, ‘সুনেত্রার খবর তো সেই শেষ শুনেছিলাম। এলাকার সবাই যা জানে, আমিও ওইটুকুই জানি। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পরিচয় গোপন করে শহরতলির একটা পাড়ায় লুকিয়ে ছিল। পুলিশ জানতে পারে। রাহুল নামে এক গোয়েন্দা অফিসার প্রায় ধরে ফেলেছিল। বিষ্ণু কোনও রকমে সুনেত্রাদের নিয়ে পালায়। রাহুল ভালরকম জখম জখম হয়েছিল। সুনেত্রা তারপর অন্ধ্র বর্ডারের দিকে মহিলাদের ক্যাম্পে চলে যায়। তখন কাগজে এইসব খবর নিয়মিত বেরত। সুনেত্রা তো এই এলাকারই মেয়ে। ওদের ওপর একসময় যা অত্যাচার করেছে মহাজন, ওর দিদিকেও তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সুনেত্রা সুদে-আসলে পরে বদলা নিয়েছে। বিষ্ণুর দল সাহায্য করত। পরে ওদের পরিবারও যে কোথায় গেল, কোনও খবর নেই আর।’
লক্ষ্মী বলল, ‘দিদি, হাতে বন্দুক নিলেও তো জীবনটা সুখ-শান্তির হয় না? জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে, লুকিয়ে কাটাতে হয়।’
রেশমী বলল, ‘কষ্টের জীবন শুনেছি। তবে সম্মানের। ওই নামে মহাজন, পুলিশ, প্রশাসন ভয় পায়। আর গরিবরা সম্মান দেয়, আশ্রয় দেয়, ভালবাসে। নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করা যায়। কষ্টটা গায়ে লাগে না। আর থাকে শোষকের ওপর বদলার আনন্দ। এটা তো শুনি নেশার মতো।’
বাহা বলল, ‘কিন্তু কাগজে বেরিয়েছিল ওই জীবনেও মেয়েদের উপর অত্যাচার হয়।’
বুধনি বলে উঠল, ‘ছাড় ছাড়, ওরকম অনেক জায়গায় হয়। আসলে পুলিশ আর মিডিয়া এগুলো বেশি রটায় খারাপ ধারণা করাতে। সুনেত্রার ক্ষেত্রে দেখলি তো বিষ্ণু কীভাবে ওকে আগলে রাখল। সব কথায় কান দিবি না।’
রেশমি বলল, ‘সে সব বুঝলাম। কিন্তু চারপাশে কোথাও যেন একটা অন্য গন্ধ পাচ্ছি। মনটা ঠিক লাগছে না। নিশ্চিন্ত ভাবটা আর নেই। কিছু লোক সেটা না বুঝে আবার স্বেচ্ছাচারিতা বাড়াচ্ছে। এর কাউন্টার রিঅ্যাকশন হবেই, আর সেটা শুরু হলে আবার মৃত্যুর মিছিল।’
‘দিদি, তুমি সুনেত্রাকে সমর্থন করো?’ বুধনির প্রশ্ন।
একঝলক তাকিয়ে রেশমি বলেছে, ‘আমি ফুলন দেবী থেকে সুনেত্রা, বন্দুক হাতে নেওয়া প্রত্যেকটা মেয়েকে সমর্থন করি।’
এইসব আলোচনা করতে করতে ওরা আবার বাজারের কাছে চলে এল। দু’চারটে খুচরো কেনাকাটার কাজ আছে।
বাজারের চাতালে মাইক, পতাকা, ব্যানার টাঙানোর কাজ চলছে। মাধাই দাঁড়িয়ে। দেখে মনে হচ্ছে, একটু পরেই ওরা কোনও সভা করবে। মাধাই ছেলেটা উগ্র ধরনের। অতিবাম তো বটেই। সকলেরই ধারণা মাওবাদীদের সঙ্গে এখনও ভাল যোগাযোগ। পুলিশ আসে, ধরে, ছেড়ে দেয়। বন্দি রাখার যুৎসই কারণ পায় না। যখন ধরে নিয়ে যায়, তখন চায়ের আড্ডায় হারান ভটচায বলেন, ‘বলেছিলাম না, মাধাইটা মাওবাদীদের লিঙ্কম্যান। মাওবাদী কমে গিয়েছে, তবু, আছে তো।’ আবার যখন মাধাইকে ছাড় পেয়ে ফিরে আসে, তখন শিবনাথ সোরেন বলেন, ‘মিলল তো? বলেছিলাম তখনই, ওটা একটা পুলিশের চর। ওকে ছেড়ে রাখে। ধরাটা শুধু নাটক।’ তা সে যাই হোক, প্রচলিত দলগুলির বাইরে থাকলেও মাধাই কিছু ছেলেপুলে জুটিয়ে হইহল্লা বাধিয়ে রাখে। এবারের সভা, শালপাতার দাম, ন্যায্য মজুরি চেয়ে, জঙ্গলে গাছকাটা বন্ধের দাবিতে। তবে, এলাকাবাসী এতদিনে জেনে গিয়েছে, প্রকাশ্য দাবির বাইরে আলাদা কোনও উদ্দেশ্য বা ছক তো থাকে, এবারও আছে নিশ্চয়ই।
মাধাই ডাকল, ‘ও দিদিমণি, একটু শুনবেন?’
( এরপর আগামী সপ্তাহে)