‘তোমায় গান শোনাব’-র প্রত্যয় নিয়েই গায়ক-অভিনেতা এসেছিলেন কলকাতায়। তবে মিউজিক কনসার্টের পেশাদারি বর্ম ছেড়ে দিলজিৎ তিলোত্তমার হৃদয় জিতে নিয়েছেন। ভুবন-জোড়া হাসিতে তিনি আপন করে নিয়েছেন ‘সিটি অফ জয়’-এর আনাচ-কানাচ। হলুদ ট্যাক্সির জানালায় হাস্যমুখে তাঁর হাত-নাড়ানোয় জুড়ে গিয়েছে আপনজনের ডাক। গঙ্গার ঘাটে উদাসী মুখে লেগে থেকেছে চেনা বালকের উদাসীনতা। তাঁর হাতের চেনা গোলাপ আর সূর্যমুখীর আঘ্রাণ বলে দেয় দিলজিৎ ‘ভিনদেশী তারা’ নয়, সে আমাদের খুব কাছের।
১২.
হিমের রাত ফিকে হয়ে এলে ‘কুয়াশা’ নামের সাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে নেয় কলকাতা। ভোরের আলো মাখা সেই সূর্যশিশিরে এই শহর তখন বড় মায়াবী। দিলজিৎ দোসাঞ্জ সেই মায়াভরা দিনে শহরের বুকে হেঁটে বেড়ান রূপকথায় রাজপুত্তুরের মতো। কলম্বাসের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অন্বেষণ করেন তিলোত্তমার হৃদয়। যেন তিনি নবকুমার। কলকাতাকে সুরের মায়াজালে প্রেমবন্দি করতে এসে গায়ক-অভিনেতা নিজেই ডুবে যান শহরের প্রেমে। ‘করব, লড়ব, জিতব রে…’ চেনা আবাহনীতে প্রেম ঝরে পড়ে পাঞ্জাবতনয়ের সুকণ্ঠে।
এ এক পরিক্রমা। সুরের সরণি ধরে শহর থেকে শহরে পৌঁছে যাওয়া উদাসী বাউলের মতো। দিলজিৎ সারা দেশে এভাবে পৌঁছে যাচ্ছেন প্রান্ত থেকে প্রান্তরে। ‘তোমায় গান শোনাব’-র প্রত্যয় নিয়েই গায়ক-অভিনেতা এসেছিলেন কলকাতায়। তবে মিউজিক কনসার্টের পেশাদারি বর্ম ছেড়ে দিলজিৎ তিলোত্তমার হৃদয় জিতে নিয়েছেন। ভুবন-জোড়া হাসিতে তিনি আপন করে নিয়েছেন ‘সিটি অফ জয়’-এর আনাচ-কানাচ। হলুদ ট্যাক্সির জানালায় হাস্যমুখে তাঁর হাত-নাড়ানোয় জুড়ে গিয়েছে আপনজনের ডাক। গঙ্গার ঘাটে উদাসী মুখে লেগে থেকেছে চেনা বালকের উদাসীনতা। তাঁর হাতের চেনা গোলাপ আর সূর্যমুখীর আঘ্রাণ বলে দেয় দিলজিৎ ‘ভিনদেশী তারা’ নয়, সে আমাদের খুব কাছের।
এক পাঞ্জাবতনয়ের বাংলার রূপ-রস-গন্ধে মিশে যেতে এটুকুই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তাকে ছাপিয়েও তিনি আরও একটা কাজ করেছেন যা বাংলা ও বাঙালির জন্য গর্বের। আত্মদর্শনের জন্য অতুলনীয়। ইনস্টাগ্রামের ছোট্ট রিলে দিলজিৎ-এ নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রতীয়মাণ হয়ে উঠেছে মৌসুমী ভৌমিকের চেনা সেই গান– ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি/ সাগরের ঢেউয়ে চেপে/ নীল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ।…’ এক ভিনরাজ্যের শিল্পী, নানা ব্যস্ততার ফাঁকে, তাঁর পেশাদার রোজনামচার অবসরে আশ্রয় খুঁজচ্ছেন এক বাংলা গানে, আনত হচ্ছেন সেই গণশিল্পীর সুরসাধনার সামনে। এ দৃশ্য যতটা আদরের ততটাই চমকপ্রদ।
শহরের সংস্কৃতির আঁতুড়ঘরকে আত্মস্থ করতে দিলজিৎ পৌঁছে যাচ্ছেন দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরে। রামকৃষ্ণের শয়নকক্ষের সামনে তার নীরব সমাপন আবেগস্নাত করবে আপামর বাঙালিকেও। বিকেলে ফিকে হয়ে আসা আলোয় ঐতিহ্যের কফি হাউসে ঠিক ততটাই মায়াময় লাগে পাঞ্জাবি-গায়ককে। দেওয়ালের কোন থেকে উঁকি দেয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পোট্রেট। দিলজিৎ-এর বেছে নেওয়া কফি-র টেবিলের গা-ঘেঁষে উৎকীর্ণ হয়ে থাকে জীবনানন্দের ফ্রেমবন্দি ছবি। বড় জীবন্ত সেই মুহূর্ত। খোলা জানলায় চোখ রাখা দিলজিৎ নিশ্চয়ই শুনতে পান কোনও ফিসফিসে সুর– সময়ের ধুলো মাখা সেই কবিতার লাইন হয়তো ভেসে ওঠে গায়কের চোখের সামনে– “হঠাৎ তোমার সাথে কলকাতাতে সে এক সন্ধ্যায় উনিশশো চুয়াল্লিশে দেখা হ’ল– কত লোক যায়…”। হোক না এ ২০২৪, ক্ষতি কি তাতে।
দেখে-শুনে মনে হয়, দিলজিৎ-এর এই কলকাতা সফর শুধুমাত্র সংগীতের সফরনামা নয়। এ আসলে এক অনন্ত যাপন। যে যাপনে নিজেকে গড়ে তোলা যায়, ঋদ্ধ করা যায়। দিলজিৎ সেভাবেই বঙ্গ-সংস্কৃতির হৃদয়স্পর্শ করেছেন। বাঙালি তা দেখে আপ্লুত হয়েছে। আসলে পাঞ্জাবি গায়ক-অভিনেতার মন-মানসিকতায় নিজের হারানো সত্তাকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে আপামর বাঙালি।
অথচ সংস্কৃতির সমস্ত উপাদান হাতের কাছেই তো রয়েছে। বাঙালি সব পেয়েও তাকে মূল্য দিতে পারেনি কেন? সেই আন্তরিকতার ছিটেফোঁটা কেন প্রতিফলিত হয়নি ‘বং জেনারেশনে’র প্রাত্যহিকতায়। দৃষ্টিকটুভাবেই বাংলা গানের উৎকর্ষতাকে উপেক্ষা করে তারা আনন্দসুধা খুঁজে বেড়িয়েছেন ভিনদেশীয় গানে। বাঙালি ‘আত্মঘাতী জাতি’ বলেই কি এমনটাই দস্তুর? প্রশ্ন অনেক উত্তর অজানা। আসলে ছিন্নমূল ভাবনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে অস্তিত্বের সংকট। সেই অশনিসংকেতকে ললাটলিখন করেই বঙ্গদেশ রঙ্গরসে মজে থেকেছে। সেটাই বাঙালি সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের ওপেন সিক্রেট। সেই অবনমন ক্রমবর্ধমান।
তাই দিলজিৎ-এর মতো কোনও পরিযায়ী এসে আবেগের সুতো ধরে টান দিলে আমাদের অন্তরাত্মা জাগে, নচেৎ শীতঘুমে ডুবে যায়। শতাব্দী আগে এক দত্তকুলোদ্ভব বলে গিয়েছিলেন, ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন/ তা সবে (অবোধ আমি!) অবহেলা করি।’ দিলজিৎ সেই ফারাকটাই কুয়াশাঘন সকালে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলেন। এটাও বুঝিয়ে গেলেন বাঙালির আত্মদর্শনের প্রয়োজন।
……………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে
তবে সত্য চক্রবর্তীর সঙ্গে জুটি বেঁধে অভয়দার আরেকটা বইও খুব জনপ্রিয় হয়– শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘এক পাত্র সুধা’। এর মূল পরিকল্পনা সত্যবাবুরই, তিনিই শক্তিদার নানা বই থেকে কবিতা বেছেছিলেন। তবে অভয়দার অনুরোধে শক্তিদা সুনীলদাকে একটা চিঠি লিখে এ-বইয়ের সম্পাদনা করতে বললে সুনীলদা তাতে সাড়া দিয়ে সম্পাদকীয় তুল্য এক টুকরো গদ্য লিখে দেন।
বন্ধুরা তাঁকে বলতেন, ‘রঙ্গিন মিজাজ ফকির’। সেই আদতে উদাসী, অথচ বহিরঙ্গে সদা-হাস্যময় মিশুকে যুবক অকালমৃত সফদর হাশমির স্ত্রী ও নাট্যকর্মী মলয়শ্রী হাশমির সঙ্গে সুদীর্ঘ আড্ডায় বসেছিলেন উদয়ন ঘোষচৌধুরি ও অম্বরীশ রায়চৌধুরী। উঠে এল ছোটবেলা, রাজনীতির একাল-সেকাল, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, ‘জনম’-এর কাজকর্ম, সফদরকে হত্যার কারণ ইত্যাদি নানা কথা। আজ সফদরের ৭১-তম জন্মদিন উপলক্ষে রোববার.ইন-এর বিশেষ নিবেদন সেই সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব।