Robbar

সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 9, 2025 5:16 pm
  • Updated:January 9, 2025 9:10 pm  

আসলে অদ্ভুত এই ময়দান। অদ্ভুত তার চরিত্র। রাজার মুকুট যেখানে কাঁটার মুকুটে বদলে যায় চোখের পলকে। ফুটবল-প্রমত্ত জনতার নয়নের মণি থেকে খলনায়কে পরিণত হয় তারকা-প্লেয়ার। নতুন তারার জন্ম হয় এখানে, অপমৃত্যু ঘটে বিপথগামী ফুটবল-জ্যোতিষ্কের। এই ময়দান সাফল্য-ব্যর্থতার জোয়ার-ভাঁটায় সাগরতুল্য। সেই ঢেউয়ের মধ্যে কিছু খাঁটি মুক্তোর সন্ধান মেলে, সঞ্জয় সেন তেমন‌ই এক মুক্তো। ‘ময়দানের ক্রাইসিসম্যান’, বিপদের মুখে পরিত্রাতা।

অরিঞ্জয় বোস

জীবন-সফরে নানা মণিমুক্তের সন্ধান মেলে। কতিপয় তার মধ্যে জ্ঞান রূপে ধরা দেয়। যা থেকে যায় অবিনশ্বর শিক্ষা হিসেবে। শচীন রমেশ তেন্ডুলকরের ইন্টারভিউটাও তাই– এক অনির্বাণ জ্ঞান!

কবে, কোথায়, কোন কাগজে কথাটা বলেছিলেন শচীন, আজ আর অত মনে নেই। এটুকু স্মরণে আছে যে, স্মৃতিচারণ করছিলেন। মন দিয়ে নৈবেদ্য সাজাচ্ছিলেন, দ্রোণাচার্য রমাকান্ত আচরেকরের পদতলে। ইস্কুল জীবনে ফিরে গিয়ে।

Sachin Tendulkar Thrilled by Achrekar Sir's Statue at Shivaji Park
‘গুরু’ রমাকান্ত আচরেকরের সঙ্গে শিষ্য শচীন তেণ্ডুলকর

শচীন তখন সারদাশ্রম বিদ্যামন্দিরের ছাত্র। ক্রিকেট খেলেন। তবে জুনিয়র টিমে। তা, একদিন হঠাৎ ডাক পড়ল গুরু আচরেকরের কাছে। সিনিয়র টিম হ্যারিস শিল্ডের ফাইনাল খেলবে ওয়াংখেড়েতে, তার আগে শচীনের জন্য প্রাকটিস ম্যাচের ব্যবস্থা করেছেন ‘স্যর’। সিনিয়র টিমের ক্যাপ্টেনকে বলা আছে, স্কুল থেকে শচীন মাঠে যাবে, গিয়ে ব্যাট করবে চার নম্বরে। বোলিং বা ফিল্ডিং করার দরকার নেই। গুরুর আদেশ, তাই বেদবাক্য, খণ্ডায় কে!

আচরেকরের কথামতো ইস্কুল শেষ করে শচীন মাঠে ছুটলেন বটে। কিন্তু খেলতে নামলেন না! বরং গ্যালারির স্ট্যান্ডে বসে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করলেন সিনিয়র টিমকে! তারপর ম্যাচ শেষ হতে হাজির হলেন আচরেকরের সামনে। শিষ্যকে হাতের কাছে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কোচ রমাকান্ত, ‘কী রে, কত রান করলি?’ শচীন বলেন যে, তিনি ব্যাট করেননি। গ্যালারিতে বসে সিনিয়রদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন একটু!

No photo description available.
শচীনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন কোচ আচরেকর

‘কত রান’-এর বদলে প্রিয় শিষ্যের কাছ থেকে এমন উত্তর পাবেন, ভাবেননি আচরেকর। রাগে ফেটে পড়লেন সবার সামনে। ভর্ৎসনা করে শচীনকে বললেন, ‘নিজের খেলায় মন দাও। অন্যের জন্য হাততালি দেওয়ার দরকার নেই। বরং এমন কিছু করো, যাতে সবাই তোমার জন্য হাততালি দেয়।’

আচরেকরের সেই তিরস্কার বদলে দিয়েছিল শচীনের ক্রিকেট-দর্শন। পরবর্তীতে ভারতীয় ক্রিকেটে বিস্ময়-বালক থেকে মহীরূহ হয়েছেন শচীন। কিন্তু গুরুর আদেশ কখনও ভোলেননি। সযত্নে তার লালন করেছেন আপন অধ্যাবসায়ে।

ক্রিকেট বলে নয়। শচীন বলে নয়। খেলার মাঠে কোচ নামক ব্যক্তিত্বটির ভূমিকা যেন তাই। পথভ্রষ্টকে সাফল্যের পথটুকু চিনিয়ে যেন তার মোক্ষলাভ। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া সেখানে উপেক্ষিত, অযাচিত। মুম্বই হোক কিংবা কলকাতার ময়দান, এমন সব চরিত্র কাল্পনিক নয়, বরং ঘোর বাস্তব। রক্তমাংসে গড়া, রোদঝড়ে পোড়া সেই মুখগুলো এক ছাঁচে গড়া। ভৌগোলিক সীমারেখা পেরিয়ে‌ও সেই মুখগুলোর অক্লান্ত মনোভাব পড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হয় না।

সন্তোষ ট্রফি নিয়ে সঞ্জয় সেন। ছবি: কৌশিক দত্ত

উদাহরণ চান? চলুন, ফিরে যাই, ২০১৮-র ২ জানুয়ারি। বছর সাত আগের এক রাতে, মোহনবাগান মাঠে। খেলা তখন সবে শেষ। টানেল দিয়ে বেরিয়ে আসছে একটা ন্যুব্জ শরীর, হারের পুঁজরক্ত সমেত। ভদ্রলোকের গন্তব্য মোহনবাগান তাঁবু। গ্যালারিতে তখন উন্মত্ত জনতা। ক্ষোভের আগ্নেয়গিরি যাঁদের গলায় মুহুর্মুহু ফাটছে, লাভাস্রোত বিষ-নদী হয়ে নামছে। চাঁদমারি স্রেফ একজন, একটা মানুষ। যাঁর মাথা নিচু, অশ্রাব্য শব্দের নাগপাশ, গালিগালাজ অসহায় ‘অভিমন্যু’-র মতো ঘিরে ধরেছে যাঁকে, অপমানের ‘চক্রব্যূহ’ রচনা করে। দেখলাম, একদলা থুতু এসে পড়ল ভদ্রলোকের গায়ে! দেখলাম তারপর ভদ্রলোকের মুখাবয়ব। কী অদ্ভুত নির্লিপ্ত সে মুখ! চারদিকের এত আলোড়ন উপেক্ষা করে তা কী আশ্চর্য নির্বিকার! যেন সাক্ষাৎ নীলকণ্ঠ তিনি, হলাহল হজমে সিদ্ধহস্ত! দেখলে কে বলবে, ঈষৎ সময় পর অন্ধকারের নিকষ কালোয় মিলিয়ে যাবেন তিনি, মোহনবাগানে অতীত হয়ে যাবেন সঞ্জয় সেন!

মোহনবাগান কোচের পদ ছেড়ে কী বলছেন সঞ্জয় সেন? | Mohun Bagan | Sanjoy Sen - YouTube
সঞ্জয় সেন, মোহনবাগানের আই লিগ জয়ী প্রশিক্ষক

ইয়েস, সেন, সঞ্জয় সেন। বাংলাকে দীর্ঘ সময় পর সন্তোষ ট্রফি জেতানো ‘সেনসেশনাল’ সেন! বাংলা ফুটবলের ‘এল মায়েস্ত্রো’ কিংবা সেন ‘মায়েস্ত্রো’!

মাঝে মাঝে ভাবি, গঙ্গাপাড়ের বাংলার জন্য কী করেননি কোচ সঞ্জয়? সন্তোষ ট্রফির শাপমোচন আগে লিখলাম। তার বাইরেও আছে, রাশি-রাশি আছে। সঞ্জয়ের হাত ধরেই প্রথম আই লিগ জয় করছিল মোহনবাগান। জিতেছিল ফেডারেশন কাপ। মহামেডান স্পোর্টিং উঠে এসেছিল আই লিগের মূল পর্বে। জিতে নিয়েছিল আইএফএ শিল্ডের শিরোপা। অথচ সেই ময়দান‌ই অপাংক্তেয় করে দিয়েছে সঞ্জয় সেনকে। নয়তো বাংলার সন্তোষ-জয়ের ভগীরথ হতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় ২৭ বছর! আইএস‌এলের বিদেশি কোচেদের মামুলি পারফরম্যান্সের ভিড়ে তাঁকে আড়াল হতে হয় ‘বেকার কোচ’-এর তকমায়।

বাংলার সন্তোষ ট্রফি জয়ী কোচ সঞ্জয় সেন

আসলে অদ্ভুত এই ময়দান। অদ্ভুত তার চরিত্র। রাজার মুকুট যেখানে কাঁটার মুকুটে বদলে যায় চোখের পলকে। ফুটবল-প্রমত্ত জনতার নয়নের মণি থেকে খলনায়কে পরিণত হয় তারকা-প্লেয়ার। নতুন তারার জন্ম হয় এখানে, অপমৃত্যু ঘটে বিপথগামী ফুটবল-জ্যোতিষ্কের। এই ময়দান সাফল্য-ব্যর্থতার জোয়ার-ভাঁটায় সাগরতুল্য। সেই ঢেউয়ের মধ্যে কিছু খাঁটি মুক্তোর সন্ধান মেলে, সঞ্জয় সেন তেমন‌ই এক মুক্তো। ‘ময়দানের ক্রাইসিসম্যান’, বিপদের মুখে পরিত্রাতা।

কেমন সেই পরিত্রাতা? যিনি ডুবন্ত নৌকার হাল ধরতে পারেন। যেমনটা সঞ্জয় সেন ধরেছিলেন ২০১৪-তে। মরশুমের মাঝপথে। সুভাষ ভৌমিকের ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলিয়েছিলেন দুঃসময়ে, সেই পরিস্থিতি থেকেই মোহনবাগানকে আই লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন চেতলার ‘ডাকাবুকো’ সঞ্জয়, নিজের কোচিং-মগজাস্ত্রে শান দিয়ে।

ফুটবল কোচিং সম্পর্কে আধুনিক ধ্যানধারণা, আর তুখোড় ম্যাচ-রিডিং দক্ষতা, বাংলা তো বটেই ভারতের কোচেদের ভিড়ে আলাদা করে নিজেকে চিনিয়েছেন সঞ্জয়। সাধে বব হাউটন তাঁকে কোচ হিসেবে লেটার মার্কস দেন? জহুরি জহর চেনে, পিকে‌ও চিনেছিলেন। রেল টিমের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন সঞ্জয়ের কাঁধে। সেখান থেকে জাতীয় স্তরে হোক কিংবা ক্লাব কোচিং- ফুল ফুটিয়েছেন কোচ সঞ্জয়। তুলে এনেছেন প্রণয়, প্রীতম, শৌভিক, দেবজিৎদের মতো একঝাঁক মুখ। ভারতীয় ফুটবলে যাঁরা আজ প্রতিষ্ঠিত।

সন্তোষ ট্রফি জয়ের পর সঞ্জয় সেনের বাংলা দল

কিন্তু তাতে কী? পরিশেষে, বাঙালি যে এক আত্মবিস্মৃত-জাতি। কোচ সঞ্জয়ের সে অবদানকে আমরা হেলায় ভুলেছি। যেমন ভুলেছি, তাঁরই পূর্বসূরি এক পাগলাটে কোচকে। যিনি ফুটবল জ্ঞানের নেশায় দেশে-বিদেশে ঘুরতেন, খেলা দেখে বেড়াতেন সম্পূর্ণ নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে। অমল দত্ত কত বড় কোচ ছিলেন, জীবিত থাকতে বোঝেনি বাঙালি। ঠিক তেমনই বুকে পেসমেকার বসানো সঞ্জয়ের কোচিংয়ে ফেরার তাগিদ দেখেও উপেক্ষা করেছে। আমল দেয়নি, শারীরিক অসুস্থতাকে হেলায় তুচ্ছ করে কাঠফাটা রোদে মোহনবাগান মাঠে তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমকে। প্রো-লাইসেন্সের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সঞ্জয়কে বরং হাবাসের সহকারী হিসেবে দেখতেই বেশি পছন্দ করেছে বাঙালি। পছন্দ করেছে, তাঁর সাফল্যের উত্তরীয়তে বিক্ষোভের ‘থুতু’ দিতে। ভুলে গিয়েছে, জাতীয় দলের দায়িত্ব থেকে সঞ্জয় ব্রাত্য হওয়ার পর, তার প্রতিবাদ করতে। ঠিকই আছে। গেঁয়ো যোগী আর কবে ভিখ পেয়েছে এ বাংলায়?

…………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………………

তবু সঞ্জয় সেন দমেননি। দমে যাওয়ার পাত্র তিনি নন, বরং বরাবরের অদম্যের মতো তিক্ততার বিষ আত্মস্থ করেছেন সাফল্যের অভিলাষে। যার ঝলক দেখা গেছে রবি হাঁসদা, নরহরিদের দুরন্ত পারফরম্যান্সে। আসলে বাংলা ফুটবলের সেন মহাশয় এমনই। আমরা যতই তাঁকে অপাংক্তেয় করি তুলি না কেন, তিনি দিন শেষে ঠিকই ছিটকে বেরোন। অবিকল ‘নায়ক’ সিনেমার অরিন্দমের মতো। অস্ফুটে এক স্বগতোক্তি করতে করতে।

‘আই উইল গো টু দ্য টপ! দ্য টপ! দ্য টপ!’

 

…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….

পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা

পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে

পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু

পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?

পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে

পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ

পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী

পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?

পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব

পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস

পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল

পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত

পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না

পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে