রঙের বর্ণমালায় সব রঙের আলাদা গুরুত্ব। লাল হোক কি হলুদ, সবুজ হোক কি মেরুন। সাদা, কালো– তারও নিজস্ব অর্থ আছে বইকি। তবে সাদাকে শুধু শান্তি, পবিত্রতা, শুদ্ধতায় যেমন বেঁধে ফেলা যায় না, তেমনই কালোকে মাপা যায় না শোক, অন্ধকার কিংবা মৃত্যুর ঘেরাটোপে। সাদা এবং কালো যেন সেই চেতনার দ্বৈত-বাহক। আশ্বিনের শ্বেতশুভ্র কাশবন, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা যেমন মনে পরিতৃপ্তির জোয়ার এনে দেয়, ঠিক তেমনই যুদ্ধবিধ্বস্ত ধাত্রীভূমির বুকে শুয়ে থাকা সাদা-কাফনে মোড়া ওই মৃতদেহের উপস্থিতি যেন শোকের শীতলস্রোত বইয়ে দেয়। মোহনবাগান হোক কিংবা ইস্টবেঙ্গল, ফুটবল আবেগসঞ্জাত। ভরা-গ্যালারির উন্মাদনার ঢেউ সামলে কখনও চোখ আটকে যায় সাদা কাপড় জড়িয়ে বসা বিধ্বস্ত শরীরে। শোকের পৃথিবীকে দূরে ঠেলে আবেগ জিতিয়ে দেয় ফুটবল-প্রেমকে।
১৭.
দশ বছরের এক বালক। আপনভোলা। আলের পথ ধরে আনমনে এগিয়ে চলেছে। সহসা চোখ গেল আকাশপানে। আকাশজুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা। তার বুক চিরে উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক বলাকা। অনিন্দ্যসুন্দর সেই দৃশ্য, মায়াময়। সেই দৃশ্যপটে চোখ রেখে ভেসে গেল বালকের মন। গভীর তন্ময়তায় ভাবসমাধি ঘটল। সাদা রং, কালো রং। বিপ্রতীপে থাকা দুই বর্ণ। চোখের সামনে ধরা দিলে বারবার মনে পড়ে যায় বালক গদাধরের জীবনের এই বিশেষ মুহূর্ত। মনে হয়, সাদা-কালো নিছকই রং নয়, জীবনস্রোত। একে অপরের পরিপূরক দুই গতিধারা। যার মোহনায় মিশে থাকে স্বরূপ-সন্ধানের আত্মজিজ্ঞাসা।
জীর্ণ যা কিছু, তার নিষ্ক্রমণ ঘটিয়ে বসন্তোৎসব নিয়ে আসে আগমনী সুর। ঋতু এবং মনে। নতুনের পদধ্বনি জাগে রঙের শামিয়ানায়। সেই সমাবেশে সাদা আর কালো ব্রাত্যজন! রঙের লাইনে দাঁড়াতে পারে না সাদা কিংবা কালো। সাদা যে সমাহার, সব রঙের। আর কালো অনুপস্থিতির, শূন্যতার। তবু সেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রতীয়মান যে সাদা-কালো ম্যাজিক, খালি চোখে যা ধরা দিয়ে যায়, তাকে অগ্রাহ্য করি কোন উপায়ে? যে রঘু রাইয়ের ফোটোগ্রাফি হোক, কিংবা স্বর্ণযুগের বাংলা ছবি। নিভৃতচারী জেব্রা হোক কিংবা শশব্যস্ত জেব্রা ক্রসিং। সাদা মেঘ কালো করে আসে বলেই না বাকি রঙের গুরুত্ব টের পাওয়া যায়।
রঙের বর্ণমালায় সব রঙের আলাদা গুরুত্ব। লাল হোক কি হলুদ, সবুজ হোক কি মেরুন। সাদা, কালো– তারও নিজস্ব অর্থ আছে বইকি। তবে সাদাকে শুধু শান্তি, পবিত্রতা, শুদ্ধতায় যেমন বেঁধে ফেলা যায় না, তেমনই কালোকে মাপা যায় না শোক, অন্ধকার কিংবা মৃত্যুর ঘেরাটোপে। সাদা এবং কালো যেন সেই চেতনার দ্বৈত-বাহক। আশ্বিনের শ্বেতশুভ্র কাশবন, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা যেমন মনে পরিতৃপ্তির জোয়ার এনে দেয়, ঠিক তেমনই যুদ্ধবিধ্বস্ত ধাত্রীভূমির বুকে শুয়ে থাকা সাদা-কাফনে মোড়া ওই মৃতদেহের উপস্থিতি যেন শোকের শীতলস্রোত বইয়ে দেয়। মোহনবাগান হোক কিংবা ইস্টবেঙ্গল, ফুটবল আবেগসঞ্জাত। ভরা-গ্যালারির উন্মাদনার ঢেউ সামলে কখনও চোখ আটকে যায় সাদা কাপড় জড়িয়ে বসা বিধ্বস্ত শরীরে। শোকের পৃথিবীকে দূরে ঠেলে আবেগ জিতিয়ে দেয় ফুটবল-প্রেমকে। প্রলেপ দেয় পরিজন-বিয়োগের ক্ষতে। ব্যস্ত শহরের গতি মন্থর হয়ে আসে বিকেলের ম্লান আলোয়। ফুটপাতজুড়ে গরম ভাতের ঘ্রাণ বলে দেয় সাদা-র অর্থ কত গভীরে। যেভাবে সাদা অর্থবহ হয়ে ওঠে ‘শোলে’র সাদা শাড়ি-পরিহিত জয়া ভাদুড়ির চলনে, নীরব-চাহনিতে।
কালো? সে কি শুধুই সাদার বিপরীত? দাবার চৌষট্টি খোপে সাদার পড়শি দেশ? কালো যে সৃষ্টির আদিরূপ। ধ্বংসেরও। কৃষ্ণগহ্বরের রহস্য নিয়ে কালো যেন চিরজাগরিত। অন্ধকারের সত্তা নিয়ে কালো আসলে রঙিন। জীবন্ত। নয়তো কবির মানসকল্পনায় কেন পঞ্চমীর চাঁদ ডুবে গেলে মৃত্যুর সাধ নিয়ে সে হাজির হয়! নিমজ্জমান চিরঘুমে যেন জেগে ওঠে কালো রং, নিজের ব্যাপ্তিকে সঙ্গী করে। কালো হরিণ চোখের কথা কবি বললেও, এই যুগেও ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ স্লোগান তুলে জানান দিতে হয়। ‘ব্ল্যাক’ ছবির অমিতাভ-রানিকে মনে করুন। কালো পৃথিবীতে সাদা বরফ পড়ার সেই দৃশ্য, আর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা। ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে’– রবীন্দ্রনাথের এই গানের বোঝাপড়া প্রসঙ্গে জয় গোস্বামী ধরিয়ে দিচ্ছেন, অপূর্ব সেই উচ্চারণ– ‘মহাকাল’ নয় সেই উচ্চারণ– ‘মহাকালো’।
………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………….
কালো বললেই মনে পড়ে আলোর নাচন– কালী। মনে পড়ে, কালো কালি দিয়ে লেখা অপূর্ব সব পুরনো হস্তাক্ষর। আমাদের কালো কি-বোর্ড তার কতটুকুই বা জানে? কালো, তা সে যতই কালো হোক?
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে