দেশের সফলতম চেজমাস্টারকে কেন বিদায় নিতে হবে শুষ্ক ইমেল-বার্তায়? কেন শতকোটি জনতার চোখের জলে আর্দ্র রাজপথ ধরে মিলিয়ে যাবে না কোহলির গর্বের ক্রিকেট-যাত্রা? আসলে তাঁর জন্য দ্বিতীয় কোনও পথ খুলেই রাখেনি ভারতীয় বোর্ড। রাখেননি গৌতম গম্ভীর। অস্ট্রেলিয়ায় ভরাডুবির পর দশ দফা কড়া নির্দেশিকায় অশনিসংকেত ছিল। বিদেশ সফরে পরিবারকে ছেড়ে স্রেফ ক্রিকেটে ‘মনোনিবেশ’-এর আদেশ ছিল বোর্ড মারফত। সেই নির্দেশিকা যে দলের সিনিয়রদের উদ্দেশে, তা ওপেন সিক্রেট। এবং তা নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। সিনিয়র ক্রিকেটারদের পরিবারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সেই মান্যতা দেয়নি বোর্ড।
২০.
সুদূর লন্ডনের সেন্ট পলস কনভেন্ট গার্ডেনের পাইন গাছের ছায়ায় চিরশান্তিতে নিদ্রারত থাকুন কার্ডাস সাহেব। তবু, এক টেস্ট সাধকের এই মহাপ্রস্থান লগ্নে আপনার শরণাপন্ন না হয়ে পারছি না। ঠিকই বলেছেন আপনি। ‘স্কোরবোর্ড একটা গাধা!’ স্কোরবোর্ডের ক্রমিক সংখ্যা আর জমে ওঠা পরিসংখ্যানের তুলাযন্ত্রের পুঁজি একজন ক্রিকেটারের মাপকাঠি হবে, তাতে আপনার ঘোরতর আপত্তি ছিল। পরিসংখ্যান নিতান্তই একটা মাপকাঠি হতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত বিচারক? আপনি সেই দাবিকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।
বিরাট কোহলি নামক এক ক্রিকেট পুণ্যার্থীর টেস্ট থেকে বিদায়ের আকস্মিকতা সেই কথাই মনে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
লাল বলের সাম্রাজ্যে আর কখনও পায়ের চিহ্ন পড়বে না বিরাট-রাজার। ক্রিকেটে আভিজাত্যের সর্বোত্তম পর্যায় হিসেবে খ্যাত টেস্ট ফরম্যাটে, ভাবীকালে যখনই বিপন্ন বোধ করবে ভারতীয় দল, আমরা দেখব না ভয়-ভাঙানো মানসিকতা নিয়ে কোনও ‘কিং কোহলি’ ২২ গজে শস্ত্র চালনা করছেন, পরাজয়ের স্রোত ঠেলে টিম ইন্ডিয়াকে মারের সাগর পার করিয়ে দিচ্ছেন। ১২ মে, ২০২৫– সেই সুখস্মৃতিতে চিরকালের মতো দাঁড়ি টেনে দিল। ক্রিকেটতটে জমে থাকল কিছু শুকনো পরিসংখ্যান।
ইতিহাস জানবে, ১২৩ টেস্টে ৯২৩০ রান নিয়ে টেস্টের সফরনামায় যবনিকা টেনেছিলেন বিরাট কোহলি। নামের পাশে ৩০টি শতরান। টেস্টের নিরিখে প্রশংসনীয় বটে, কিন্তু ‘স্টার মার্কস’-এর কৌলিন্যের ধারেকাছে তা নয়। যে পূর্বসূরির সঙ্গে তাঁকে অনন্তকাল ছায়াযুদ্ধ করতে হয়েছে, সেই ‘আইডল’ শচীন তেণ্ডুলকরের থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে থেমে যেতে হল বিরাটকে। অপূর্ণ থাকল টেস্টে দশ হাজারের ‘এলিট’ ক্লাবে প্রবেশাধিকারও। কিন্তু ওই যে বললাম, পরিসংখ্যান মাপকাঠি হতে পারে, চূড়ান্ত বিচারক নয়। কার্ডাস সাহেব তাই ভুল বলেননি কিছু। বিদায়বেলায় বিরাট কোহলি আরও একবার প্রমাণ করলেন– স্কোরবোর্ড সত্যি গাধা!
তবু, আচমকা হ্যাঁচকা টানে এই যে টেস্টরথ থামিয়ে দিলেন, বলা ভালো দিতে বাধ্য হলেন কোহলি, এটা কি প্রাপ্য ছিল তাঁর? দেশের হয়ে শতাধিক টেস্ট খেলা প্রাক্তন ভারত অধিনায়কের আরও একটু সম্মান প্রত্যাশিত ছিল না? ছিল। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট কবেই বা যোগ্যকে যথোচিত সম্মান দিতে শিখেছে! তাই শচীন-সরণি নয়, সৌরভ, দ্রাবিড়, ধোনিদের মতো তারকার নীরব নিষ্ক্রমণের পথেই নাম লেখালেন বিরাট। ঠিক তাঁর বন্ধু-সতীর্থ রোহিত শর্মার মতো! অথচ অপ্রিয় প্রশ্ন ভারতীয় ড্রেসিংরুমের আনাচকানাচে ভিড় করবেই। সেটাই তো স্বাভাবিক।
তারুণ্যের স্বপ্নে বিভোর বর্তমান ভারতীয় দলে কি এতটাই নিষ্প্রয়োজন ৩৬ বছরের ‘ফিটনেস-পাগল’ কোহলির? উত্তরের অনুসন্ধান চালালে কোন হলাহল উঠে আসবে, তা জানা নেই। তবে কাঠিন্যে-ভরা একটা মুখ জাগ্রত হবে প্রশ্নব্যাকুল ক্রিকেট-জনতার সামনে। সেই মুখ, গৌতম গম্ভীরের। ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাটন এখন আর কোনও অধিনায়কের হাতে নয়, বরং নেপথ্যচারী কোচের জিম্মায়। সেই পরিচালকের ভূমিকায় গম্ভীর শুরু থেকেই নিষ্ঠুর, হন্তারক, দ্রাবিড়-সভ্যতার উল্টোমেরুতে তাঁর অবস্থান।
বর্ডার-গাভাসকর ট্রফিতে বিপর্যয়ে সলতে পাকানোর কাজটা শুরু করে দিয়েছিলেন ভারতীয় দলের ‘হেড স্যর’। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে রোহিত-বিরাটদের সাফল্য হয়তো সেই গতিকে মন্থর করেছিল, কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত করেনি। তাই রোহিতের আচমকা অবসরের মতো বিদায়ের পথটা প্রশস্ত হচ্ছে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি বিরাটের। টেস্টে তাঁর ধারাবাহিক ব্যর্থতা প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করছিল। কিন্তু বিপক্ষের বিষাক্ত ছোবলে টেস্ট কেরিয়ারে দাঁড়ি না টেনে, আপনমর্জিতে টেস্টকে বিদায় জানানোর ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দিতে ভুল করেননি বিরাট-রাজা, রাজকীয় ভঙ্গিমায়। সাফল্যের অনেক শৃঙ্গ-জয়ের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রেখে আলবিদা বললেও মানতে হবেই কোহলি টেস্টকে চিরবিদায় জানালেন ‘মাই ওয়ে’-তে। রাজার মতো।
কিন্তু কেন? দেশের সফলতম চেজমাস্টারকে কেন বিদায় নিতে হবে শুষ্ক ইমেল-বার্তায়? কেন শতকোটি জনতার চোখের জলে আর্দ্র রাজপথ ধরে মিলিয়ে যাবে না কোহলির গর্বের ক্রিকেট-যাত্রা? আসলে তাঁর জন্য দ্বিতীয় কোনও পথ খুলেই রাখেনি ভারতীয় বোর্ড। রাখেননি গৌতম গম্ভীর। অস্ট্রেলিয়ায় ভরাডুবির পর দশ দফা কড়া নির্দেশিকায় অশনিসংকেত ছিল। বিদেশ সফরে পরিবারকে ছেড়ে স্রেফ ক্রিকেটে ‘মনোনিবেশ’-এর আদেশ ছিল বোর্ড মারফত। সেই নির্দেশিকা যে দলের সিনিয়রদের উদ্দেশে, তা ওপেন সিক্রেট। এবং তা নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। বিদেশ সফর মানেই কয়েক মাস পরিবার-পরিজন ছাড়া হোটেলবন্দি জীবন। গাভাসকর, শচীনরা পেরেছেন। কিন্তু কোভিড-পরবর্তী সময়ে সেই জীবনকে আত্মস্থ করা সহজসাধ্য নয়। ক্রিকেটকে ভালোবাসে রোহিত, বিরাটরা সেই পারিবারিক দায়িত্ববোধকে অস্বীকার করতে চাননি। কিন্তু সিনিয়র ক্রিকেটারদের পরিবারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সেই মান্যতা দেয়নি বোর্ড। ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে তাঁদের হয়তো মনে হয়েছে বিরাটরা ঘরকুনো! সিনিয়রদের নিষ্ক্রমণের পথ দেখাতে গিয়ে ভুলে গিয়েছেন, ৩৬-এর এই বিরাট কোহলি একদিন রনজির লড়াইয়ে চোয়ালচাপা লড়াই করেছিলেন, বাবার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে। সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই ভারতীয় ক্রিকেট!
আর তাই চলে যাওয়াই শ্রেয়। অশ্বিন আগেই সে পথ বেছে নিয়েছেন। দিনকয়েক আগে রোহিত । এবার কোহলি। অন্তরের ক্ষতকে আড়াল করেই। তাঁদের ছেড়ে যাওয়া শূন্য আসন ভরাটে গম্ভীরের হাতে তারুণ্যের অপশন! দলের নিয়ন্ত্রাশক্তি এখন তিনিই। তিনিই শেষকথা। কিন্তু বিপর্যয় ঘনিয়ে উঠলে? স্তব্ধ গ্যালারিকে আশার বাণী শোনাতে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে আসবে না আর সাদা পোশাকে ‘১৮’ নম্বর জার্সিধারী। ২২ গজে ঠিকরে বেরবে না কোনও নয়নাভিরাম কভার ড্রাইভ। চেজমাস্টারের রানের খিদে। ভারতীয় ক্রিকেটকে প্রতিপদে প্রমাদ গুনতে হবে, ‘টেস্ট ক্যাপ নম্বর ২৬৯’ এখন অতীত।
ওহে টেস্ট ক্রিকেট, মনকে শক্ত করো, বিরাট কোহলি আর ফিরবেন না!
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ১৯: মুকুল কিংবা ফিলিস্তিনি বালক, খুঁজে চলেছে যে যার ঘর
পর্ব ১৮: ধোনিবাদ: ধাঁধার চেয়েও জটিল তুমি…
পর্ব ১৭: সাদা সাদা কালা কালা
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে