প্রাচীন ভারতবর্ষে কালো বিড়ালের ইজ্জত ছিল খুব উঁচুতে। বেদব্যাসের বাবা দোরদণ্ডপ্রতাপ মুনি পরাশর উল্লেখ করলেন গৃহলক্ষ্মীর আটটি পবিত্র চিহ্ন– দাহ্যকাঠ, চন্দন, ঘি, শালগ্রাম শিলা, তিল, ছাগ, কৃষ্ণমৃগচর্ম আর কালো বিড়াল। বললেন গৃহশান্তির জন্য এগুলো মাস্ট। গোলটা বাঁধল মধ্যযুগে। গির্জার পাদ্রিরা যখন রাজ অনুগ্রহে অভ্যস্থ হয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল সাধারণ মানুষের থেকে তখন মানুষ তাদের জীবনের সমস্যার সমাধান খুঁজতে আশ্রয় নিল কালাজাদু প্র্যাকটিস করা প্রাচীর্ণ যোগিনীদের কাছে। হাতে-গরম সমাধানও আসতে লাগল চটজলদি। চার্চের যাজকদের রেপুটেশন চরচর করে পড়তে লাগল শীতকালের পারদের মতো। অনেক যুক্তি করে পাদ্রিরা ঠিক করল মার্কেটে কামব্যাক করতে হলে কন্সপিরেসি থিওরি নামাতে হবে।
প্রচ্ছদ লেখক
১.
কালো বেড়াল
দূরদর্শনের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রথম দেখেছিলাম দু’জন লোক কালো কোর্ট-প্যান্ট-চশমা পরে প্রধানমন্ত্রীর পিছনে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। আর কিছুই করছেন না। নড়ছেন না চড়ছেন না। শুধু দাঁড়িয়ে আছেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগারই কথা! কৌতূহলের বুদবুদ্ ফোটা আরও স্বাভাবিক। আমার ডাগড় ডাগড় চোখ দেখে বাবা বলল ‘ওবেব্বাবা! ওরা ব্ল্যাক কাট।’ ব্ল্যাক ক্যাট শব্দটা প্রথম শুনলেও কালো বিড়ালের ব্যাপারে আমি তখন সব জানি। ওরা অলক্ষ্মী, ওরা অপয়া, ওরা বিচ্ছিরি। ধারে-কাছে এলেই ওদের তাড়িয়ে দিতে হয়। কয়েকটা কালো বিড়াল তো ভূত-টুতও হতে পারে। হাইলি। তাই কোনও রিস্ক নেওয়ার দরকারই নেই। বড়দের নিদান ছিল খুব স্পষ্ট– তিন প্রকার বিড়াল আছে আর তার তিন রকম উপশম। মেনিদের আদর করে দুধ খাওয়াতে হয়। হুলো দেখলে পালিয়ে আসতে হয়। আর কালো বিড়াল? তার কোনও জেন্ডার হয় না, জাত হয় না, নাম হয় না, ধাম হয় না। দেখা মাত্রই সোজা ‘আই হুস্’, ‘হ্যাট হ্যাট’। মামাবাড়ির কয়লার ঝুড়িতে বাদামি মেনিটা যেবার পাঁচটা বাচ্চা দিল, তার মধ্যে ODD MAN OUT ছিল কুচকুচে কালো একটা বিড়াল ছানা। পান্নার মতো চোখ। কান্নার মতো নরম, একা। কে জানে কেন ওকেই তুলে নিয়েছিলাম সবার আগে? ফি রোববার JUNGLE BOOK গিলে গিলে তখন মোগলির ভূত মাথায় ম ম করছে। তাই ওই সবজে চোখের কালো ক্যাটের নাম রাখলাম ‘বাগিরা’। বাগিরাকে ঘরে নিয়ে আসা মাত্রই মাসি রে রে করে উঠল। না জানি কোন অশনি সংকেত চড়ে এসেছে আমার কোলে! কিন্তু বাগিরাকে যখন ‘খুউব অশুভ’ বলে তক্ষুনি গিয়ে গঙ্গার পারে নামিয়ে দিয়ে আসার অর্ডার এল, দিদিমা সবার আগে অ্যাত্ত বড় জিভ কাটল। দু’হাত জোড় করে, কপালে ঠেকিয়ে বলল ‘খবরদার!’ বিড়াল আসলে কালো হলেই ভালো। মা ষষ্টীর বাহন। বাচ্চাদের ওরা প্রোটেক্ট করে ছেলেধরার হাত থেকে। বাগিরার তখনও প্রোটেক্ট করার মুরোদ হয়নি। ওর গোটা দেহটাই আমার হাতের মুঠোয়। করার মধ্যে শুধু দু’বার চোখ পিটপিট করেছিল। কিন্তু আমার চোখ খুলে গেছিল সেদিন থেকে। কুসংস্কার আর সংস্কারের তফাতটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার করে দিয়েছিল আমার গ্রামবাংলার লোকশিক্ষায় মানুষ হওয়া দিদিমা।
কালো বিড়ালের পিঠপিছে পলিটিক্স কিন্তু কম হয়নি। শুরু হয়েছিল পশ্চিমি দুনিয়ায়, গ্রিক সভ্যতার হাত ধরে। কথিত আছে হেরাক্লেস, যাকে হারকিউলিস নামে চেনে গোটা বিশ্ব, সে পৃথিবীর আলো দেখেছিল দাসি গ্ল্যানথিয়সের বুদ্ধির জোরে। হেরাক্লেসের জন্মের সময় ওর মা যখন প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে, তখন স্বর্গের দেবদেবীদের চিন্তায় মাথায় হাত। ওরা চায়নি ওই দৈত্যকায় শিশু ভূমিষ্ট হোক। তাই তারা ফন্দি করে লুসিয়ানা নামের এক দেবীকে পাঠায় হেরাক্লেস-এর জন্ম ভেস্তে দিতে। লুসিয়ানা এসেই প্রথমে হেরাক্লেস-এর মা অ্যালকিমিনির হাত পা টাইট করে বেঁধে দেন যাতে প্রসব না হয়। অসহনীয় যন্ত্রণায় অ্যালকিমিনির চিৎকার আর কাতর আর্তি দেবী লুসিয়ানাকে টলাতে না পারলেও দাসি গ্ল্যানথিয়সের মন কিন্তু ভিজিয়েছিল। দেবতাদের অভিসন্ধির জবাবে দাসিও একটা পাল্টা ফন্দি আঁটে। সুযোগ বুঝে চুপি চুপি এসে হেরাক্লেসের মাকে বলল হাল না ছেড়ে প্রেশারটা দিয়ে যেতে। জন্মমূহূর্ত যখন আগত, তখন গ্ল্যানথিয়াস চেঁচিয়ে উঠল, যেন অঘটন ঘটে গেছে কিছু একটা। পাশের ঘর থেকে দেবী লুসিয়ানা ছুটে আসতেই দাসি বলল ‘বাচ্চাটা তো বেরিয়ে গেছে!’ মাথায় বাজ পড়ল দেবীর ‘বেরিয়ে গেছে? সর্বনাশ! কই দেখি তো’ বলে যেই না লুসিয়ানা অ্যালকিমিনির পায়ের বাঁধন খুলল, ওমনি মুক্ত যোনিদ্বার দিয়ে ভলক্যানোর মতো বেরিয়ে এল হেরাক্লেস। সন্তান ও মায়ের প্রাণ বাঁচানোর জন্য পুরস্কারের বদলে অভিশাপ জুটল গ্ল্যানথিয়সের কপালে। আদিম দেবী হেরার অভিশাপে কুচকুচে একটা কালো বিড়াল হয়ে গেল অপরূপ সুন্দরী গ্ল্যানথিয়স। তাতেই শেষ হল না শাস্তি। দাসি হয়ে দেবতাদের যজ্ঞে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্যে আর দেবী লুসিয়ানাকে মিথ্যে বলার অপরাধে বয়কট করল সবাই তাকে। কী আর করার? দুটো খাবারের জন্যে গ্ল্যানথিয়স ঘুরতে থাকল এদিক সেদিক কালো লেজ নেড়ে, কিন্তু সিঁকে ছিঁড়ল না। শেষমেশ কালাজাদুর দেবী হেকেটির খুব মায়া হল তাই সে আশ্রয় দিল কালো বিড়ালরূপী গ্ল্যানথিয়সকে। তবে ঝামেলাটা হল অন্য জায়গায়, বেচারা কালো বিড়ালদের গোটা গুষ্টির নাম জড়িয়ে গেল উইচক্রাফ্টের সঙ্গে, সেই থেকে। আর আমাদের শুভ্রসভ্য সমাজে ওরা হয়ে গেল অশুভ, অপয়া, কালাজাদুর অমুঙ্গুলে প্রতীক।
……………………………..
সাদা, বাদামি, ছোপছোপ, ছাইরঙা সব রঙের বিড়াল যখন মানুষের আদর যত্নে হুঁদকো হয়ে উঠল, তখন কালো বিড়ালরা দূর থেকে দেখত ফরসা বিড়ালদের খাতির যত্ন। জুলজুলে চোখে লোভ দিত ওদের দুধের বাটি, মাছের পিসে। ওটুকুই তার অধিকার। ওর থেকে এক পা এগোলেই অ্যাই হুস্, হ্যাট হ্যাট, যাঃ। লজ্জার বিষয় এই যে শয়ে শয়ে বছরের গন্ডা গন্ডা পশ্চিমি আগ্রাসনের ফলে ঋষিমুনির ভারতবর্ষেও ঢুকে পড়ল এই কালচার। পরাশরের গৃহলক্ষ্মী স্টেটাস হারাল সবার অগোচরে। বেচারা ষষ্টী দেবীর বাহন এত বদনাম কুড়োল যে স্বয়ং দেবীকেই পাঠিয়ে দিল সাবলটার্ন ইতিহাসের বিস্তৃত পাতায়।
………………………………
ভারত আবার পশ্চিমিদের থেকে সবেতেই উল্টো। প্রাচীন ভারতবর্ষে কালো বিড়ালের ইজ্জত ছিল খুব উঁচুতে। বেদব্যাসের বাবা দোরদণ্ডপ্রতাপ মুনি পরাশর তাঁর স্মৃতিতে উল্লেখ করলেন গৃহলক্ষ্মীর আটটি পবিত্র চিহ্ন– দাহ্যকাঠ, চন্দন, ঘি, শালগ্রাম শিলা, তিল, ছাগ, কৃষ্ণমৃগচর্ম আর কালো বিড়াল। বললেন গৃহশান্তির জন্য এগুলো মাস্ট। তাই সেকালে আমাদের দেশে কালো বিড়াল ছিল প্রিভিলেজড্। গোলটা বাঁধল মধ্যযুগে। গির্জার পাদ্রিরা যখন রাজ অনুগ্রহে অভ্যস্থ হয়ে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল সাধারণ মানুষের থেকে তখন মানুষ তাদের জীবনের সমস্যার সমাধান খুঁজতে আশ্রয় নিল কালাজাদু প্র্যাকটিস করা প্রাচীণ যোগিনীদের কাছে। হাতে-গরম সমাধানও আসতে লাগল চটজলদি। চার্চের যাজকদের রেপুটেশন চরচর করে পড়তে লাগল শীতকালের পারদের মতো। পসার ভোঁ ভাঁ। মুলোটা, কলাটা আর যা যা কিছু ছিল খেটে খাওয়া মানুষের সঞ্চয়ে, সব নিয়ে তারা ছুটল কালাজাদুর প্রসাদ পেতে। অনেক যুক্তি করে পাদ্রিরা ঠিক করল মার্কেটে কামব্যাক করতে হলে কন্সপিরেসি থিওরি নামাতে হবে। রাজার সঙ্গে সেটেলমেন্ট-এর পরদিন রাজদূত তাই ঢিঢি পিটিয়ে দিল। বলা হল কালাজাদুর যোগিনীরা শুধু যে ধর্মের শত্রু তাই নয় তারা ছলনাময়ী, চতুর, WICKED। আর এই WICKED নারীদের নাম দেওয়া হল WITCH। বেচারা কালো বিড়ালের যদিও এসব ঝামেলায় জড়ানোর কথা ছিল না, কিন্তু উইচক্রাফ্টের পূজোর জন্য মরা ইঁদুরের প্রয়োজন ছিল খুব। আর এই কালোবিড়ালই হয়ে উঠল রাতের অন্ধকারে শ্রেষ্ঠ ইঁদুর শিকারি। ব্যস যাবে কোথায়? কালাজাদুর যোগিনীরা দেদার পুষতে লাগল কালো বিড়াল। একটা নয়, দুটো নয় ডজন ডজন। আর ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগাল পাদ্রিরা। প্রাচীন গ্রিসের সেই অভিশপ্ত গ্ল্যানথিয়স আর উইচ হেকেটির গল্প শুনিয়ে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিল মানুষের মনে ভাইরাসের মতো। রাজপেয়াদারা ধরপাকড় শুরু করল উইচদের। কারও কারও মৃত্যুদণ্ডও হল। কিন্তু ধর্মভীরু মানুষের সাহস ছিল না উইচদের চট করে কিছু করার। তাই যত ঝাল গিয়ে পড়ল ওই কালো বিড়ালের ওপর। শোনা যায় উইচদের তুলনায় সে যুগে কালো বিড়াল মারা হয়েছিল কয়েকশো গুণ বেশি। তবে দিন তো সবারই আসে। শুধু কি ডগ? এভরি ক্যাটও হ্যাস্ ইট্স ডে। কালো বিড়ালদের এই দুদর্শা দেখে প্রকৃতি হোক বা ষষ্ঠী দেবী যে কেউ একটা বিহিত করল। প্লেগ এল মহামারী হয়ে। বিড়াল যেহেতু ইঁদুর মারে তাই তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন পড়ল সুযোগ সন্ধানী মনুষ্যকুলের। হাঁফ ছেড়ে প্রাণে বাঁচল কালো বিড়ালরা সে যাত্রায়।
কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও প্রেস্টিজটা ওরা আর ফিরে পেল না। সাদা, বাদামি, ছোপছোপ, ছাইরঙা সব রঙের বিড়াল যখন মানুষের আদর যত্নে হুঁদকো হয়ে উঠল, তখন কালো বিড়ালরা দূর থেকে দেখত ফরসা বিড়ালদের খাতির যত্ন। জুলজুলে চোখে লোভ দিত ওদের দুধের বাটি, মাছের পিসে। ওটুকুই তার অধিকার। ওর থেকে এক পা এগোলেই অ্যাই হুস্, হ্যাট হ্যাট, যাঃ। লজ্জার বিষয় এই যে শয়ে শয়ে বছরের গন্ডা গন্ডা পশ্চিমি আগ্রাসনের ফলে ঋষিমুনির ভারতবর্ষেও ঢুকে পড়ল এই কালচার। পরাশরের গৃহলক্ষ্মী স্টেটাস হারাল সবার অগোচরে। বেচারা ষষ্টী দেবীর বাহন এত বদনাম কুড়োল যে স্বয়ং দেবীকেই পাঠিয়ে দিল সাবলটার্ন ইতিহাসের বিস্তৃত পাতায়। পশ্চিমি পাদ্রিদের মতোই এ দেশের বামুন পুরুতরা আরও বেশি করে ঘি দিল সে যজ্ঞে। ভয় না দেখালে মানুষ বশে থাকবে কেন? কালো বিড়ালের সূত্র ধরে তারা বাতিল করে দিল সমস্ত কিছু, যা যা রঙে কালো। অবাক করা কাণ্ড হল একবারও কেউ প্রশ্ন করল না শিবের গলার সাপটার কথা, মোহন বাঁশি বাজিয়ে বকাসুর বধ করা কৃষ্ণকায় ছেলেটার কথা, এমনকী খোদ মহাকালের বুকে দাঁড়িয়ে জিভ কাটা কালো মেয়েটার কথা। সাহেব মাইবাপ বলা ভারতীয় মধ্যবিত্ত ভাবল এই সুযোগ। ষষ্ঠী দেবী এমনিতেই আউটডেটেড সভ্য সমাজে, এবার তাড়া শালা তার অসভ্য বাহনকে। ব্যাটা দিপথেরিয়ার ডিপো, Sly মাছ চোর!
প্রকৃতির মায়া হল কি না কে জানে। কালো বিড়াল কালে কালে সত্যিই কমে গেল সংখ্যায়। মা বিড়াল বুঝি পোয়াতি কালে ষষ্টি দেবীকে বলে থাকবে– ‘আমার সন্তান যেন কালো না হয়’। তার পরেও যারা জন্মায় তারা সভ্য মানুষের সমাজ থেকে খাবার খেতে না পেলেও মার খেতে অভ্যস্থ। আদর না পেলেও তাড়া খেতে মাহির। ওদের কোনও ক্লাস নেই, বরাতে আশার আলো নেই। ওরা আসলে কালো মার্জার। ওদের কথা ভাববে না কেউ। ওরা রাস্তা মাপুক যার যার।