এইচ-আই-ভি সিফিলিস বা গনোরিয়ার মতো যৌনরোগকে হেসে খেলে ক’য়েক গোল দেয়। আমরা একটু সিরিয়াস হই। এইচ-আই-ভি সংক্রান্ত খবরাখবর রাখতে শুরু করি। রক হাডসন, আরথার অ্যাশ, ফ্রেডি মারকিউরির মৃত্যুর খবর পুনর্বার পড়ি এবং এই প্রথম মুখে চুকচুক শব্দ করি। ক্রমে জানতে পারি এবং নিজেকে বোঝাতে পারি যে, শুধু অবাধ যৌন সংসর্গেই এই রোগ হয় না, ইনফেক্টেড সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন দিলেও এই রোগ এক রোগীর থেকে সুস্থ মানুষের শরীরে ঢুকে পড়তে পারে। কাগজে, ম্যাগাজিনে শিশুদের এইডস নিয়ে নিবন্ধ ছাপা হয়।
আটের দশকের শেষের দিকে পয়লা ডিসেম্বর তারিখটি ‘বিশ্ব এইডস দিবস’ হিসেবে ঘোষিত হয়। ঘটনাচক্রে ওই দিনটি আমার ছোটবেলার এক বন্ধুর জন্মদিন। উঠতি বয়স থেকেই বন্ধুমহলে তার বেশ খাতির, বিশেষ করে মহিলা মহলে। ইদানীং আরও বেড়েছে। এর ফলে যা হয়। সেইসময় আমরা ১৭-১৮। বন্ধুর জন্মদিন পালনের সময় ব্যাপক খিল্লি শুরু হল। এই গাল ভরা নামাঙ্করণের বছর পাঁচেক বাদে ‘ফিলাডেলফিয়া’ সিনেমাটি রিলিজ হয়। টম হ্যাঙ্কস তাঁর প্রথম অস্কারটি হস্তগত করেন। ব্রুস স্প্রিংস্টিনের ‘স্ট্রিটস অফ ফিলাডেলফিয়া’ মনকে ভারাক্রান্ত করে এবং মারিয়া কালাসের ‘লা মোমা মোরতা’-র সঙ্গে হ্যাঙ্কসের সামাজিক অবিচারকে বরণ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার দৃশ্য আমাদের বাক্রুদ্ধ করে। ডেঞ্জেল ওয়াশিংটনের অসহায়তাকে আমরা নিজেদের ব্যর্থতা বলে মনে করি। এবং এইডস রোগটি আমাদের মননে গেঁথে যায়। সে সিফিলিস বা গনোরিয়ার মতো যৌনরোগকে হেসে খেলে ক’য়েক গোল দেয়। আমরা একটু সিরিয়াস হই। এইচ-আই-ভি সংক্রান্ত খবরাখবর রাখতে শুরু করি। রক হাডসন, আরথার অ্যাশ, ফ্রেডি মারকিউরির মৃত্যুর খবর পুনর্বার পড়ি এবং এই প্রথম মুখে চুকচুক শব্দ করি। ক্রমে জানতে পারি এবং নিজেকে বোঝাতে পারি যে, শুধু অবাধ যৌন সংসর্গেই এই রোগ হয় না, ইনফেক্টেড সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন দিলেও এই রোগ এক রোগীর থেকে সুস্থ মানুষের শরীরে ঢুকে পড়তে পারে। কাগজে, ম্যাগাজিনে শিশুদের এইডস নিয়ে নিবন্ধ ছাপা হয়। এইডস রোগীদের একঘরে না করার জ্ঞান বিনিপয়সায় বিতরণ করা হয়। ভবিষ্যতে বুলাদি-র মতো চরিত্র সৃষ্টি হয় টিভিতে। তিনি বড় রাস্তার ব্যানারে শোভা পান। অথচ নিজের কমপ্লিট ব্লাড স্ক্রিনিং-এ ওই টেস্ট করতে হলে এখনও থমকে যাই, ঢ্যাঁড়া মেরে দিই। হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস-কে বুঝে ফেলি নিজস্ব ডাক্তারি মতে কিন্তু মন থেকে তার ভূত তাড়াতে পারি না কিছুতেই। যেমন ঘটল হ্যাপিদার (নাম পরিবর্তিত) ক্ষেত্রে, বছর কয়েক আগে। উনি আমার দাদাস্থানীয়, ছোটবেলায় যাকে মনে হত বলিউডের হিরো।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পাল্টি। পর্ব ১৮: আরে নামের সামনেই পেছন নিয়ে ঘুরছিস?
.………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ডিনার শেষ হয়নি তখনও, ফোনটা এল। হ্যাপিদা আর নেই। ওঁর দু’-একজন আত্মীয়-বন্ধু ক্যাওড়াতলায় পৌঁছেছেন। আমিও ছুটলাম। হ্যাপিদা তাঁর অশীতিপর মা’র সঙ্গে থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে। বাবা অনেক দিন আগেই গত হয়েছেন। নিজে অকৃতদার কারণ কৈশোর থেকেই তাঁর টালমাটাল মানসিক অবস্থান। ভাই-বোন দীর্ঘদিনের প্রবাসী, বিদেশের নাগরিক। তাঁরা যখন খবর পেলেন তখন সেইসব দেশে ভোররাত। একজন জানালেন আসা সম্ভব নয়, কারণ এই কিছুদিন আগেই ঘুরে গেছেন মা-কে দেখতে। অন্যজনেরও ব্যবসা সংক্রান্ত সমস্যা, ছেলে-মেয়ে ইত্যাদি। সুতরাং ‘বডি’ রেখে লাভ নেই। দু’-তিনটে অ্যাপ ক্যাবের প্রত্যাখানের পর একটি সনাতন হলুদ ট্যাক্সি ধরে শ্মশানে পৌঁছলাম। শুনলাম চুল্লি খালি ছিল বলে হ্যাপিদা পুড়তে শুরু করেছেন। আর আধঘণ্টাও লাগবে না। সময়মত যখন ডাক পড়ল আমি এবং এক আত্মীয় ভিতরে গেলাম। মাটি ভরা মালসায় হ্যাপিদার নাভি এল। ডোম সামান্য দক্ষিণা নিলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
শুধু অবাধ যৌন সংসর্গেই এই রোগ হয় না, ইনফেক্টেড সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন দিলেও এই রোগ এক রোগীর থেকে সুস্থ মানুষের শরীরে ঢুকে পড়তে পারে। কাগজে, ম্যাগাজিনে শিশুদের এইডস নিয়ে নিবন্ধ ছাপা হয়। এইডস রোগীদের একঘরে না করার জ্ঞান বিনিপয়সায় বিতরণ করা হয়। ভবিষ্যতে বুলাদি-র মতো চরিত্র সৃষ্টি হয় টিভিতে। তিনি বড় রাস্তার ব্যানারে শোভা পান। অথচ নিজের কমপ্লিট ব্লাড স্ক্রিনিং-এ ওই টেস্ট করতে হলে এখনও থমকে যাই, ঢ্যাঁড়া মেরে দিই। .…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আদিগঙ্গার পঙ্কিল সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় আত্মীয়কে জিগ্যেস করি, ‘আচ্ছা, ওঁর ভাইবোন এলেন না কেন?’ বাবা-র সময় তো একজন অন্তত এসেছিলেন। আমরা বডি রেখে দিয়েছিলাম হিমঘরে দিন-তিনেক, মনে আছে। উনি বললেন, যদি কেউ আসতে না পারে তাহলে আর কী-ই বা করা যেতে পারে। তারপরেই গলা খাদে নামিয়ে জানালেন, হ্যাপিদার শেষ ব্লাড টেস্টে এইচ-আই-ভি ধরা পড়েছিল। শোনামাত্র আমার মনে প্রশ্ন জাগে। এটাই কি তবে ওঁর সহোদর-সহোদরার না আসার কারণ? অথবা আমিই হয়তো বেশি ভাবছি, কে জানে। শ্মশানের কাজ শেষ করে যখন হ্যাপিদার মা’র সঙ্গে দেখা করতে যাই, অনেক রাত। তা সত্ত্বেও বেরনোর সময় সদর দরজা অবধি এগিয়ে দিলেন। ‘কী হয়ে গেল বলতো?’– এই প্রশ্নের উত্তর আমরা কেউই দিতে পারিনি। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনও ছিল না। বাড়ি ফেরার পথে মাথায় প্রশ্ন জাগল, সারাজীবন দম আটকে থাকা, সবার মধ্যে থেকেও নিজের মনকে আঁকড়ে থাকা, কারওর কোনও কাজে না আসে অথচ কারওর অপকারও না করা মধ্য-ষাটের এক মানুষের এইচ-আই-ভি হল কী করে! নিয়মিত বেশ্যালয় গমন? অবাধ সেক্স? বহুব্যবহৃত সিরিঞ্জ? ড্রাগের নেশা? না কি রিপোর্টটাই ভুল? পরক্ষণেই মনে হল টম হ্যাঙ্কসের ক্ষেত্রে কিন্তু এই প্রশ্ন জাগেনি মনে! হ্যাপিদা ওই মালসায় চেপে আদিগঙ্গার পাঁকে আটকে না গিয়ে যদি পৌঁছে যেতেন অস্কারের মঞ্চে, তাহলে নিশ্চয়ই কয়েক হাজার ওয়াটের স্পটলাইট এসে পড়ত তাঁর ওপর আর আমরা দেদার হাততালি দিতাম।
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।