১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সময়কালে পৃথিবী ‘বিউবনিক প্লেগ’ নামে এক মহামারির সাক্ষাৎ পেয়েছিল। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল এই মহামারিতে। রোগের ধারক এবং বাহক হিসাবে দায়ী করা হয় মাছি এবং ইঁদুরকে। পৃথিবীতে ‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ’ নামে কুখ্যাত এই অধ্যায়। পরে অবশ্য এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, ইঁদুর এই রোগের ধারক ছিল না। কিন্তু সারা পৃথিবীতে এখনও ইঁদুরকে এই রোগেরই ধারক মনে করা হয়। কৃষক থেকে সাধারণ মানুষের কাছে সে সন্ত্রাসের বাহন।
১০.
গণেশের বাহন ইঁদুর। ‘ইঁদুর মরবে, আরশোলা মরবে, ছারপোকা মরবে’, হাঁকতে হাঁকতে এখনও যায় ফেরিওয়ালা। একটা কাঠের খোলা বাক্স হাতে। তাতে ছোট ছোট প্যাকেটে নানাবিধ বিষ। প্রধানত জিঙ্ক ফসফাইড। এই বিষবিক্রেতা সমাজে স্বীকৃত।
ইঁদুর মারলে ফসল বাঁচে। ইঁদুর শস্যভোজী। সে শস্য সংগ্রহ করে, খায় আর জমায়। এরা স্তন্যপায়ী। মাসখানেকের গর্ভাবস্থার শেষে ছানা পাড়ে। সাঁতারু হয় আবার গাছও বাইতে পারে। ঝাঁকে ঝাঁকে চলাফেরা করে। অন্ধকারেও প্রচণ্ড অ্যাকটিভ। আর সেসবই আমাদের কাছে নানাবিধ অকাজ।
ফসল নষ্ট, বই নষ্ট, অকাজের খাতা, কলেজবেলার ছবি, দস্তাবেজ নষ্ট, টেবিলের কাঠের পায়া নষ্ট। সবই নেংটির থেকে ধেড়ের কর্ম। তাই বিষওয়ালার কদর। আমাদের বিষওয়ালা আসলে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। ইঁদুর কল ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট।
তা এহেন ইঁদুরই হল গণেশের বাহন। তবে অতি ক্ষুদ্র ইঁদুর ওই বিশাল বপুকে পিঠে নিয়ে ঘোরাফেরা করছে, এ এক বিষম কল্পনা। গণেশ হস্তীমুণ্ড ধারণকারী। জু-মর্ফিক। হাতির মাথা এবং ইঁদুর বাহন থেকে অনেক পণ্ডিত মনে করেন তিনি পশু সংস্কৃতির প্রতীক।
এদিকে পাল মশাইয়ের বিপদ। তাঁরা বাহনকে বৃহদাকারে করতে আগ্রহী নন। তাহলে ইঁদুর শুয়োরে পরিণত হয়ে যেতে পারে। তাঁরা ছোটখাটো চেহারাতেই তাকে বানাতে থাকেন। নির্ভেজাল ইঁদুর গণেশের পায়ের কাছে বসে দু’ হাতে একটা লাড্ডু ধরে খেতে থাকে। বাহন পুজোর এটাও একটা রকম কিন্তু।
অকাজের ইঁদুর বিজ্ঞানীদের খুব ভরসার। পরীক্ষাগারে জীবনদানের জন্য কোনও পুরস্কার নেই। দু’-একটা কুকুর-বিড়ালের মূর্তি বসেছে বটে, তবে ইঁদুরদের স্মৃতি তর্পণের কোনও ইতিহাস নেই। শুধু তাদের মতো গর্ত করার প্রক্রিয়া রপ্ত করলে খনি লুঠ করা যায়, আবার ভূগর্ভে আটকে পড়া শ্রমিকের প্রাণ বাঁচানো যায়।
ইঁদুরের গর্ত কাটা রত্নাকররা কখনও-সখনও মহাপ্রাণে পরিণত হয়ে যায়। যদিও বিজ্ঞানী থেকে বিষওয়ালা– সবাই তার কাছে কালান্তক যমের মতো। সবই অবশ্য মানুষের উপকারের কথা ভেবে করা হয়।
আদিবাসীরা ইঁদুর খায়। ইঁদুর শস্য খেয়ে বেঁচে থাকে বলে তাদের মাংসে কলুষ নেই। এটাই তাদের বিশ্বাস। আসলে অতি দ্রুত বংশবৃদ্ধি এদের ভোক্তা বানিয়েছে। বিড়াল থেকে বিষওয়ালা সবাই তাই এদের তাড়িয়ে ফেরে। তাই মনে হয়, বাল্যশিক্ষা থেকেই আমাদের শেখানো হয় ইঁদুরছানা ভয়ে মরে।
১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সময়কালে পৃথিবী ‘বিউবনিক প্লেগ’ নামে এক মহামারির সাক্ষাৎ পেয়েছিল। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকার নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল এই মহামারিতে। রোগের ধারক এবং বাহক হিসাবে দায়ী করা হয় মাছি এবং ইঁদুরকে। পৃথিবীতে ‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ’ নামে কুখ্যাত এই অধ্যায়।
পরে অবশ্য এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, ইঁদুর এই রোগের ধারক ছিল না। কিন্তু সারা পৃথিবীতে এখনও ইঁদুরকে এই রোগেরই ধারক মনে করা হয়। কৃষক থেকে সাধারণ মানুষের কাছে সে সন্ত্রাসের বাহন। পূর্ববঙ্গে এক ধরনের ইঁদুরের বিষের বাজারি নাম ‘ত্রাস’।
গণেশ হয়তো পায়ের কাছে তাকে আশ্রয় দিয়ে মানুষের কাছে একটা ‘অ্যাকসেপ্টেন্স’ তৈরি করে দিয়েছে। চিরকালের তাড়া খাওয়া ইঁদুর তার পায়ের কাছেই একটু জিরোবার আর লাড্ডু খাওয়ার জায়গা পেয়েছে। তাতেই তার সিদ্ধিলাভ।
… পড়ুন বাহনকাহন-এর অন্যান্য পর্ব …
৯. শনির চেয়েও ভয়ংকর তার বাহনের দৃষ্টি
৮. জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে যে বাহনের অবাধ বিচরণ
৭. দেবতার চেয়ে মানুষের বাহন হিসেবেই কুকুর বেশি জনপ্রিয়
৬. বিশ্বকর্মার বাহন, রাজারও বাহন
৩. বাহন বিড়ালের ভার লাঘব করতে হয়েছিল স্বয়ং ঠাকুরকেই
১. মন্দিরের লাগোয়া তার আসন, তার কানে মনের বাসনা জানালে সরাসরি পৌঁছে যায় বাবার কাছে