শুধু দেবদেবীই নন, বাহনরাও যুগে যুগে, কালে কালে শিল্প, সংগীতে আলোচিত ও উল্লিখিত হয়ে এসেছে। আর ভারতশিল্পের জীববৈচিত্রের স্বাক্ষর তো অনন্য। পুরাণ থেকে জীববিজ্ঞান– সবেতেই তাদের উপস্থিতি। রাজপুত, মুঘলচিত্র থেকে শুরু করে এ যুগের গণেশ পাইন– ‘শকুনে ছবি’ আঁকার নমুনা আছে সবার। পুরাণের বর্ণনায় জটায়ুকে ‘শকুন পাখি’ বলেই মনে করা হয়। রাজা রবি বর্মার এক বিখ্যাত ছবিতে (জটায়ু বধ) সীতাহরণকারী রাবণের তলোয়ারের ঘায়ে জটায়ুর ডানা কাটার বর্ণনা আছে।
৯.
সৌরজগতে সূর্যের থেকে গ্রহাবস্থানে ষষ্ঠ, বৃহদায়তনে দ্বিতীয় এবং বলয়যুক্ত গ্রহ হল শনি। তিনি গ্রহরাজ। ন্যায়ের দেবতা। পান থেকে চুন খসলেই শনির রোষানলে পড়তে হবে। অন্যায় অবিচার তিনি মোটেই সহ্য করেন না। তাঁর বাহন শকুন।
মানুষ পাপাচারী। সে সদাই বেঁচে থাকার অর্থে নানাবিধ পাপে লিপ্ত থাকে। লোভে পাপ, পাপই জীবন। ফলে সে সংশয়ী আর ভীত। তাই শনিতে আমাদের বড়ই ভয়। তার বাহনের ওই কদাকার রূপ সেই ভয়কে ভয়াবহ করে তোলে।
প্রায় ২৩টি প্রজাতির শকুন দেখা যায়, যার মধ্যে কয়েকটি বিলুপ্তির পথে। তাদের জীবনকাল মোটামুটি ১০ থেকে ৩০ বছর। একাকী বা ঝাঁক বেঁধে অনেক উঁচুতে উড়তে পারে। রূপেল না রাপেল শকুনের ৩৭,০০০ ফুট উচ্চতায় উড়তে পারার নিদর্শনও আছে।
কদাকার রূপকে আরও ভয়ানক করেছে এদের খাদ্যাভ্যাস। জীবিত এবং মৃত প্রাণী এদের আহার্য। শকুনের সঙ্গে ‘ভাগাড়’ শব্দটাও তার পার্শ্বচরিত্র হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে পাখিটি এক ভয়-ধরানো জীবের প্রতীক হয়ে গেছে।
ন্যায়াধীশ শনিদেবকে পিঠে বয়ে নিয়ে যায়। এই শনিঠাকুরকেই একমাত্র দেখি বাইকে চড়ার মতো দু’দিকে পা দিয়ে বসে থাকতে। তবে রাস্তার ধারে যত শনি মন্দির আছে, তাতে শনিঠাকুর বাহন-সহ চেন-তালাতে আটকানোই থাকে!
পোটোপাড়ায় নানাধরনের নীল রং পাওয়া যায়। একধরনের নীল রবিন ব্লু-এর মতো, আলট্রামেরিন। ঠাকুরের চালির ফ্ল্যাট জায়গায় লাগানো হয়। পালমশাইদের কথায় আরেক ধরনের নীল আছে, যা ডেলা আকারে পাওয়া যায়। সেটা হল রাজা নীল। পোশাকি ভাষায় প্রুসিয়ান ব্লু। এই রাজা নীল কার্তিকের ময়ূরের গলায়, আর তার সঙ্গে একটু কালো মিশিয়ে শকুনের দেহ রাঙানো হয়। কখনও এই রাজা নীল শনিঠাকুরের দেহেও মাখানো হয়। গ্রহরাজ কৃষ্ণকায়, ঘন নীলবর্ণ, আর তার বাহন ধূসর নীল বর্ণ, লালচে গলা।
পুরাণের বর্ণনায় জটায়ুকে ‘শকুন পাখি’ বলেই মনে করা হয়। রাজা রবি বর্মার এক বিখ্যাত ছবিতে (জটায়ু বধ) সীতাহরণকারী রাবণের তলোয়ারের ঘায়ে জটায়ুর ডানা কাটার বর্ণনা আছে। ভারতশিল্পের অনন্য নজির।
কেরলে জটায়ু মন্দির প্রসিদ্ধ। এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাখির আকারের মন্দির। এক অতিকায় পাখির (মনে করা হয় রামায়ণের বর্ণিত জটায়ু) আহত অবস্থায় পড়ে থাকার ভঙ্গিতে মন্দিরটি নির্মিত।
শুধু দেবদেবীই নন, বাহনরাও যুগে যুগে, কালে কালে শিল্প, সংগীতে আলোচিত ও উল্লিখিত হয়ে এসেছে। আর ভারত শিল্পের জীববৈচিত্রের স্বাক্ষর তো অনন্য। পুরাণ থেকে জীববিজ্ঞান– সবেতেই তাদের উপস্থিতি। রাজপুত, মুঘলচিত্র থেকে শুরু করে এ যুগের গণেশ পাইন– ‘শকুনে ছবি’ আঁকার নমুনা আছে সবার।
১৬২৯ সালে কবি করমচাঁদ সীতাহরণের এক উপাখ্যান রচনা করেন (রাজা চন্দন ও রানি মলয়াগিরির কথা)। সেই সূত্রে কিষাণগড় মিনিয়েচারের একটা ছবি দেখা যায়। সেখানে রাবণকে কবি বর্ণিত এক ব্যবসায়ীর চরিত্রে দেখানো হয়েছে। সে তার ঝোলাতে করে সীতাকে নিয়ে যাচ্ছে। পটের একটি ক্ষেত্রে জটায়ুকে তিনি তলোয়ার দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত, আরেকটা অংশে তার মুখে লাল রং করা (ধারণা রক্তমাখা), পাথর নিক্ষেপ করে দম বন্ধ করে তাকে মারতে উদ্যত। মুঘল মিনিয়েচারের বিখ্যাত শিল্পী মনসুরের আঁকা লাল গলা এবং লম্বা ঠোঁটের শকুন যুগলের জলরঙের ছবি বর্তমানে আমেরিকার মেট মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।
মানুষের শেষকৃত্য সম্পাদনের প্রথায় স্মরণযোগ্য পার্সিদের ‘টাওয়ার অফ সাইলেন্স’-এর কথা। শকুনের ভোগ্যে শবের উপস্থাপনা। যদিও এ প্রথা বর্তমানে বিলুপ্ত, তবুও শকুনকে পৃথিবীর যাবতীয় মলিনতার মোচনের দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে, তার ভয়াল দর্শনকে আরও প্রকট করে দেওয়া হয়েছে সন্দেহ নেই।
তিব্বতে স্কাই ব্যুরিয়াল এখনও সক্রিয়। নির্জন পাহাড়ের সুউচ্চ উপত্যকায় শবের অপেক্ষায় রয়েছে ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন। (এক ঝাঁক শকুনকে বলা হয় ‘কমিটি’)। নিস্তব্ধ, নিরালা, শীতল উপত্যকায় শেষকৃত্যের উদ্যাপন।
১৯৯৩-তে দক্ষিণ আফ্রিকার চিত্র সাংবাদিক, কেভিন কার্টার তুলেছিলেন পৃথিবী কাঁপানো সেই ভয়ংকর ছবি। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ ছাপানো হয়েছিল তা। সুদানের দুর্ভিক্ষপীড়িত এক মৃতপ্রায় শিশুর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকানো শকুনের ছবি। জানা যায়, কেভিন পরের বছরই আত্মহত্যা করেন।
খাদ্যান্বেষণের যাবতীয় ক্রূরতার স্বাদ সেদিন পৃথিবী পেয়েছিল ওই শকুনের স্থির দৃষ্টিতে। শনির দৃষ্টি কোথায় লাগে সেখানে।
… পড়ুন বাহনকাহন-এর অন্যান্য পর্ব …
৮. জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে যে বাহনের অবাধ বিচরণ
৭. দেবতার চেয়ে মানুষের বাহন হিসেবেই কুকুর বেশি জনপ্রিয়
৬. বিশ্বকর্মার বাহন, রাজারও বাহন
৩. বাহন বিড়ালের ভার লাঘব করতে হয়েছিল স্বয়ং ঠাকুরকেই
১. মন্দিরের লাগোয়া তার আসন, তার কানে মনের বাসনা জানালে সরাসরি পৌঁছে যায় বাবার কাছে