সাবধান হয়েই এসেছিলাম দেশ থেকে। নিউ মার্কেট থেকে গরম কাপড়ের এক জোড়া লেগিংস এবং গেঞ্জিও কিনে ফেললাম, মহম্মদ আলির দোকানে অর্ডার দিয়ে সাজ কাপড়ের গলাবন্ধ কোট আর প্যান্টও বানিয়ে ফেললাম, বাটার পুরু সোল দেওয়া অ্যাম্বেসেডার জুতোও একজোড়া কিনে ফেললাম। বুদ্ধি খাটিয়ে এক সাইজ বড়ই কিনলাম, যাতে ভেতরে ডবল মোজা পরা যায়। সেগুলোর কোনওটাই বিশেষ কোনও কাজে এল না। এসেছিলাম সেপ্টেম্বর নাগাদ, এরা যাকে ‘সোনালি শরৎ’ বলে সেই সময়টাতে। সোনালি পাতা ঝরার সময়। সত্যিকারের শীতকাল আসতে তখনও প্রায় মাস দুয়েক বাকি।
৪.
প্রথম এসেছিলাম ১৯৬৭ সালে এক বছরের জন্য মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ফেলোশিপ নিয়ে। তখন সেটা ছিল স্বপ্নের দেশ। স্বপ্ন সাদা-কালো হয় না রঙিন– ঠিক বুঝতে পারি না। কিন্তু যখনকার স্বপ্নের কথা বলছি তখন হয়তো সাদা-কালোতেই দেখতাম– দেখতাম সাদা-কালো ছায়াছবি আর স্থিরচিত্রের মাধ্যমে– অধিকাংশই তখন পর্যন্ত হত সাদায়-কালোয়। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। দেশটার অনেকটাই আমার আগে থাকতে জানা হয়ে গিয়েছিল সেই সুবাদে।
আসার কয়েক দিন পরে প্রমোদভ্রমণে মস্কো ঘুরিয়ে যা যা দেখানো হল তার কোনওটাই আমার অচেনা ছিল না– সবই তো আমার পর্দায় চেনা–সাদায়-কালোয়। এমনই ছিল তখনকার দিনের সোভিয়েত প্রচার মাধ্যম। যেটা আমার কাছে নতুন ছিল তা তখনকার মানুষজন, যাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না। ছবিতে দেখা এক কথা, তাদের সঙ্গে মেলামেশা– সে আরেক কথা, এক নতুন অভিজ্ঞতা! আর হ্যাঁ, আবহাওয়া– তারও সঠিক পরিচয় ছবিতে পাওয়া ভার। আমার দৌড় মুসৌরি বা কাশ্মীর পর্যন্তও নয়, বড়জোর দার্জিলিং পর্যন্ত– তাও তেমন একটা শীতে নয়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অনুষ্ঠানের দিন কয়েক আগে আমাদের প্রত্যেকের নামে নামে লেখা, যথারীতি সরকারি ছাপমারা আমন্ত্রণ পত্রও হাতে চলে এল। আগের দিন রাতে উত্তেজনায় ভালোমতো ঘুমই হল না। খুব ভোরে বাস এসে যাবে আমাদের জন্য। ভোর মানে সকাল আটটা, কিন্তু এখানে এখনও রাতের অন্ধকার পুরোপুরি কাটে না। দশটায় সামরিক কুচকাওয়াজ ও অস্ত্র প্রদর্শনী শুরু। ভীষণ কড়াকড়ি। অন্তত আধঘণ্টা আগে না পৌঁছলে আমন্ত্রণপত্র থাকলেও ঢুকতে দেওয়া হবে না। ঠান্ডা, বিশেষত হিমেল হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করার জন্য একটা ভারী ওভারকোট আর একটা কান ঢাকা ফারের টুপিও ইতিমধ্যে জোগাড় হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরের গরম জামাকাপড়গুলোই তো বিদেশি, এখানকার শীত তা মানবে কেন? জুতোজোড়ার অবস্থাও তথৈবচ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সাবধান হয়েই এসেছিলাম দেশ থেকে। নিউ মার্কেট থেকে গরম কাপড়ের এক জোড়া লেগিংস এবং গেঞ্জিও কিনে ফেললাম, মহম্মদ আলির দোকানে অর্ডার দিয়ে সাজ কাপড়ের গলাবন্ধ কোট আর প্যান্টও বানিয়ে ফেললাম, বাটার পুরু সোল দেওয়া অ্যাম্বেসেডার জুতোও একজোড়া কিনে ফেললাম। বুদ্ধি খাটিয়ে এক সাইজ বড়ই কিনলাম, যাতে ভেতরে ডবল মোজা পরা যায়। সেগুলোর কোনওটাই বিশেষ কোনও কাজে এল না। এসেছিলাম সেপ্টেম্বর নাগাদ, এরা যাকে ‘সোনালি শরৎ’ বলে সেই সময়টাতে। সোনালি পাতা ঝরার সময়। সত্যিকারের শীতকাল আসতে তখনও প্রায় মাস দুয়েক বাকি।
একটা সুসংবাদ। রেড স্কোয়ারে অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকীর সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে আমরা নাকি আমন্ত্রিত হতে চলেছি। এমন সুযোগ কদাচিৎ কারও ভাগ্যে জোটে। কিন্তু ৭ নভেম্বর দিনটাই বড় গোলমেলে। শরৎ শেষ হয়ে শীতের শুরু। তাপমাত্রা যখন তখন হিমাঙ্কের নিচে নেমে যেতে পারে, বরফও পড়তে পারে। আকাশের মুখও বেশির ভাগ সময়েই গোমড়া।
অনুষ্ঠানের দিন কয়েক আগে আমাদের প্রত্যেকের নামে নামে লেখা, যথারীতি সরকারি ছাপমারা আমন্ত্রণ পত্রও হাতে চলে এল। আগের দিন রাতে উত্তেজনায় ভালোমতো ঘুমই হল না। খুব ভোরে বাস এসে যাবে আমাদের জন্য। ভোর মানে সকাল আটটা, কিন্তু এখানে এখনও রাতের অন্ধকার পুরোপুরি কাটে না। দশটায় সামরিক কুচকাওয়াজ ও অস্ত্র প্রদর্শনী শুরু। ভীষণ কড়াকড়ি। অন্তত আধঘণ্টা আগে না পৌঁছলে আমন্ত্রণপত্র থাকলেও ঢুকতে দেওয়া হবে না। ঠান্ডা, বিশেষত হিমেল হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করার জন্য একটা ভারী ওভারকোট আর একটা কান ঢাকা ফারের টুপিও ইতিমধ্যে জোগাড় হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতরের গরম জামাকাপড়গুলোই তো বিদেশি, এখানকার শীত তা মানবে কেন? জুতোজোড়ার অবস্থাও তথৈবচ। ডবল মোজা পরেও তেমন সুবিধা হচ্ছে না। এদেশের শীতের জুতোগুলোর ভেতরে ফার দেওয়া থাকে– আমার তো ওসব কিছুই নেই। বরফ এখনও পড়ছে না বটে, কিন্তু পড়তে কতক্ষণ?
রেড স্কোয়ারের কাছাকাছি যখন চলে এসেছি ততক্ষণে শীতের দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে গেছে। ঝিরঝির বৃষ্টির মতো ভিজে বরফ পড়তে শুরু করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। আমাদের জায়গা হয়েছে উৎসব উপলক্ষে রেড স্কোয়ারে ক্রেমলিনের প্রাচীর ঘেঁষে, লেনিন স্মৃতিসৌধের দু’-ধারে সাময়িকভাবে তৈরি গ্যালারির বাঁ-দিকে। সে জায়গা পর্যন্ত পৌঁছতে পাঁচটা নিরাপত্তার বলয় পার হতে হল, পাঁচবার পরীক্ষা করা হল আমাদের পরিচয়পত্র। না না, আজকের দিনের মতো মেটাল ডিটেক্টর বা কুকুর দিয়ে শরীর তল্লাশির কোনও ব্যবস্থা ছিল না। গ্যালারি শুধুই দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা। ওই ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে আরও অন্তত আধঘণ্টা। ততক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা দাবড়ানো এবং দেশাত্মবোধক সংগীত শোনা ছাড়া আর কিছু করার থাকছে না। অনুষ্ঠান শুরু হল কাঁটায় কাঁটায় দশটায়।
ক্রেমলিনের তোরণ থেকে প্রথমে খোলা গাড়িতে বেরিয়ে এলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, লেনিন স্মৃতিসৌধের মাথার ওপর থেকে বিশিষ্ট রাষ্ট্রনেতারা তাঁর অভিনন্দন গ্রহণ করলেন। এরপর সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়কের অভিবাদন এবং তাঁকে অনুসরণ করে একে একে স্থলবাহিনীর ঘোড়সওয়ার, ট্যাঙ্ক ও পদাতিক সৈন্যদলের এবং নৌ ও বিমানবাহিনীর কুচকাওয়াজ ও অভিবাদন। বর্ণাঢ্য সমারোহ, অস্ত্র প্রদর্শনী, সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্বমূলক মিছিল। সেই প্রথম দেখলাম, মিছিলের সারির মধ্যে পতাকা হাতে মানুষের পর মানুষ সাজিয়ে একের পর এক ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে কাস্তে হাতুড়ি চিহ্ন আর বিচিত্র সমস্ত স্লোগান। পরবর্তীকালে আমাদের দেশের মতো অন্য অনেক দেশও তাদের জাতীয় অনুষ্ঠানে এই জাতীয় শিল্পকলা প্রদর্শনের শিক্ষা গ্রহণ করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। কিন্তু এখানকার এই প্রদর্শনীর বর্ণবৈচিত্র ও ভাবগাম্ভীর্যই আলাদা। সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী তার যে তাৎপর্য, সে তো একেবারেই অন্য চরিত্রের। ঘণ্টাখানেকের এই অনুষ্ঠানের শেষে নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। এই মিছিল অবাধ– বিপুল জনসমাবেশ, জনতার উল্লাসমুখরিত, কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ, ফুল বেলুন আর ফেস্টুনের সমারোহ– অনেকেই এসেছেন সপরিবার, অনেক বাবার কাঁধে তাঁদের শিশুসন্তানরা। সবটাই যেমন বর্ণসুষমামণ্ডিত তেমনই সুসংগঠিত, অথচ আবেগ উচ্ছ্বাসময় এবং ব্যঞ্জনাধর্মী। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।
এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মিছিল শেষ হতে এবারে শারীরিক অনুভূতিটা প্রবল হয়ে উঠল। এতক্ষণ ঠান্ডায় একঠায় দাঁড়িয়ে পা অবশ হয়ে গেছে। হাত পা খেলানো দরকার। একটু গরম চা খেলে ভালো হত। কিন্তু এখানে আর কে রাস্তায় গরম চা বিক্রি করবে! বাইরে বেরিয়ে দেখি রাস্তায় গেলাসে ঈষদুষ্ণ রেড ওয়াইন বিক্রি হচ্ছে, সেই সঙ্গে গরম গরম মাংসের প্যাটিস। ধড়ে প্রাণ এল।
কেটে গেছে আরও আড়াই দশক। শতাব্দী শেষ হতে চলল। থমকে গেল বিপ্লবের জয়যাত্রা, পালটে গেল ইতিহাসের গতি।
(চলবে)
...রুশকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।