রিমি বি চ্যাটার্জির ‘সিগন্যাল রেড’ নামের ইংরেজি উপন্যাস বের হয় ২০০৫-এ। এই উপন্যাসটি নিয়ার ফিউচার মানে অনতিভবিষ্যতের গল্প। এবং হার্ড সাই-ফাই। বিষয়, সেই সময়েই, হিন্দু মৌলবাদীদের অধীনস্থ ভারত। সে সময়টা কল সেন্টারের প্লাস্টিক মুখমণ্ডলের সুখী যুবক-যুবতীদের গল্প লেখার কাল। এই ধরনের গল্প মেনে নিতে পারেনি পাঠককুল। পরে রিমি আসেন অ্যান্টিভার্স বা বিপরীতবিশ্বের কাহিনিবয়নে।
২৪.
ইংরেজি ভাষায় রিমি বি চ্যাটার্জি ইতিমধ্যেই একটি সমান্তরাল জগত সৃষ্টি করে ফেলেছেন। ব্রিটেনে জন্ম রিমির, তারপর ভারতে এসে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন ও পরে অধ্যাপনা করেছেন। ইংরেজি সাহিত্যের এই স্নাতকোত্তর ও ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপকের হাতে একের পর এক এসেছে কল্পবিজ্ঞানের গল্প।
তাঁর ‘সিগন্যাল রেড’ নামের ইংরেজি উপন্যাস বের হয় ২০০৫-এ। রিমি বি চ্যাটার্জির এই উপন্যাসটি নিয়ার ফিউচার মানে অনতিভবিষ্যতের গল্প। এবং হার্ড সাই-ফাই। বিষয়, সেই সময়েই, হিন্দু মৌলবাদীদের অধীনস্থ ভারত। সে সময়টা কল সেন্টারের প্লাস্টিক মুখমণ্ডলের সুখী যুবক-যুবতীদের গল্প লেখার কাল। এই ধরনের গল্প মেনে নিতে পারেনি পাঠককুল। পরে রিমি আসেন অ্যান্টিভার্স বা বিপরীতবিশ্বের কাহিনিবয়নে।
পরের বই ‘দ্য সিটি অফ লাভ’-এ, মশলা ব্যবসায়ী বিদেশি এবং ভারতীয় গুহ্যতন্ত্র নিয়ে কাজ করেছিলেন রিমি। সর্বদা তাঁর কাজ থেকেছে সবার থেকে আলাদা। আইআইটি খড়্গপুরে পড়ানোর চাকরি ছেড়ে তিনি তখন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। এর পর তাঁর যাদবপুরে পড়াতে আসা। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস, ‘বিচ ওয়ার’ ও ‘ব্ল্যাক লাইট’। যথাক্রমে ২০০৯ ও ২০১০-এ বেরিয়েছে। ভবিষ্যতের যে ডিসটোপিয়া আঁকেন তিনি, তাঁর মতে, আমরা ইতিমধ্যেই তার ভেতরেই বসবাস করছি। আর এ-কথা এতটাই তেতো সত্যি, যে কেউ মানতে চায় না, তাই তাঁর লেখাও কেউ পড়তে চায় না!
অ্যান্টিসেন্স ইউনিভার্স-এর এক কল্পিত কাল ও ভূমির কল্পিত যন্ত্রমানবীর প্রেমের কথা লেখেন রিমি। মেরিলিন নামের সেই যন্ত্রমানবীকে প্রায় মানুষ করে তুলেছিল এক বিজ্ঞানী। তাকে ক্লাউন বলে ডাকা হয়। মেরিলিন কাঁদতে পারে, রাঁধতে পারে, ভালবাসতেও পারে। অ্যাটউড বলেছিলেন, ‘দ্য ডেভিল ইজ ইন দ্য ডিটেল’, তাই কল্পগল্পের ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং-এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছোট ছোট বিষয়গুলোকে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে উপস্থাপিত করা। গোটা ব্যাপারটাই যেখানে দাঁড়িয়ে আছে কল্পনার ওপরে, গালগল্পের ওপরে। সেখানে সিং হরিণের শিং, বা গিরগিটিয়ার ল্যাজ ও ডানার গঠনেই আছে রচনাকর্তার কারিগরি সূক্ষ্মতার প্রমাণ, তাঁর ধুরন্ধর ও বেমিসাল কল্পনাশক্তির শেষ চাবিকাঠি।
তাই মেরিলিনের গল্প এই প্রকারে এগোয়:
মেরিলিন আকর্ণ লাল হল এবার। ‘অবশ্যই করেছিল। আমাকে যখন ও ওর মনের মানচিত্র তৈরি করা শেখাচ্ছিল, ও আমাকেও ম্যাপ করছিল তো। ও দেখেছিল, আমার কুণ্ঠা, দ্বিধা– এসব কোথায়, কোথায় আমার প্রোগ্রামিং আমাকে কোনও একটা পরিস্থিতির জন্য অপ্রস্তুত রেখেছে। তখনই ও সেই কোড পালটে নতুন করে লিখতে বসত। যেমন, আমার প্রোগ্রামিং আমাকে প্রশংসার জবাবে কিছু বলার সাবরুটিন দেয়নি। ক্লাউন আমাকে কোনও ভালো কথা বললেও আমি চুপচাপ বোকার মতো বসে থাকতাম, জানতাম না কী বলা উচিত বা করা উচিত। বা একঘেয়ে, ভ্যাম্পসুলভ কোনও অঙ্গভঙ্গি করে ফেলতাম। শুরু থেকেই এতে ওর খুব কষ্ট হত, ও প্যাঁচ বানিয়ে এই ত্রুটিটা ঠিক করতে বসে গিয়েছিল। এইভাবে আমরা একটা প্রতিক্রিয়ার সংকলন করছিলাম, প্রতিটি মেজাজ-মর্জি, প্রতিটি আবেগের আবেশের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে। ও আরও চেয়েছিল, আমার বায়ো-ফিডব্যাক সিস্টেমটার সঙ্গে রিয়েল টাইমে কথোপকথন চালাতে। ও বলেছিল, সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক হল সাইন তরঙ্গের সঠিক ও নিখুঁত সম্মেলন। উত্তেজক আর প্রতিক্রিয়া যেখানে মিলেমিশে যাবে, পরস্পরকে ধারণ করবে এবং একসুরে বাজবে। ওর চুম্বন আর আমার রাঙা হয়ে ওঠা, আমার আদর আর ওর কাতরোক্তি– এগুলো যাতে একটা আজীবনের কথোপকথনের অঙ্গ হয়ে ওঠে, ও চেয়েছিল, আঙুলে আঙুল জড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে অফুরান এক কথোপকথন হবে তা।’
………………………………………………………………………………………………………………………..
অ্যান্টিসেন্স ইউনিভার্স-এর এক কল্পিত কাল ও ভূমির কল্পিত যন্ত্রমানবীর প্রেমের কথা লেখেন রিমি। মেরিলিন নামের সেই যন্ত্রমানবীকে প্রায় মানুষ করে তুলেছিল এক বিজ্ঞানী। তাকে ক্লাউন বলে ডাকা হয়। মেরিলিন কাঁদতে পারে, রাঁধতে পারে, ভালবাসতেও পারে। অ্যাটউড বলেছিলেন, ‘দ্য ডেভিল ইজ ইন দ্য ডিটেল’, তাই কল্পগল্পের ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং-এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছোট ছোট বিষয়গুলোকে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে উপস্থাপিত করা। গোটা ব্যাপারটাই যেখানে দাঁড়িয়ে আছে কল্পনার ওপরে, গালগল্পের ওপরে।
………………………………………………………………………………………………………………………..
‘এটা অসম্ভব, সেন্সরি ওভারলোড হয়ে তোমার সার্কিট তো জ্বলে যাবার কথা। সেক্সবটদের কেন এত সীমিত সংখ্যক ইন্দ্রিয়বোধ দেওয়া হয়, তার তো কারণ আছে রে বাবা। আমরা যদি তোমাকে রিয়েল টাইমে প্রতিটি আচরণের মধ্যে বেছে নেবার স্বাধীনতা দিই, তুমি অতিরিক্ত ডেটার চাপে পুড়ে যাবে, নয়তো অতিরিক্ত বেছে নেবার সম্ভাবনায় হ্যাং হয়ে যাবে। তাই তো তোমার সব প্রতিক্রিয়া আগে থেকে স্ক্রিপ্ট করা থাকে। যদি একজন ব্যবহারকারী তোমাকে চড় মারে, আর তুমি পাঁচ মিনিট ধরে সেটা প্রসেস করে তবে আর্ত চিৎকার করো, লাভ কী তাতে? হাস্যকর হয়ে যাবে তো এরকম হলে!’
‘ক্লাউন তো সব স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে ফেলেছিল। বলেছিল টাইম ল্যাগ নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই। ও বলত, ও আমাকে আস্তে আস্তে চুমু খাবে, তারপর আমার প্রতিক্রিয়াটাকে ফুটে উঠতে দেখবে ধীরে ধীরে, যেভাবে মানুষ সূর্যোদয় দেখে। ও বলত, আমার প্রতিক্রিয়া দেবার জন্য চাই আমার হার্ডওয়্যারের সাইবারনেটিক কমপোনেন্টগুলির চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি কিছু। তারা যেন হয় আমার জেস্টাল্ট, মানে আমার সার্বিক সত্তা, যা কিছু দিয়ে আমি তৈরি, তার এক পরিপূর্ণ প্রকাশ… এক অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে রিয়েল টাইমে ক্রিয়াশীল।’
“ও আমাকে বলত, ‘আমাদের অনুভূতিই হল আসলে স্টেটাস রিপোর্ট, কারণ তাদের ইচ্ছাশক্তি হল ইঞ্জিন বা চালিকাশক্তি, আর বোধবুদ্ধি হল তার জন্য সিকিয়োরিটি সিস্টেম আর অ্যান্ড ডি। আনন্দ হল এই পুরো ব্যাপারটার অপটিমাল ক্রিয়াশীলতা। অন্য সব অনুভূতিই তো সাব-অপটিমাল, এবং তারা দাবি করে, কিছু একটা ব্যবস্থা নিয়ে তাদের ঠিক করা হোক। সুষম অবস্থা, শমিত সাম্যাবস্থাই হল আমাদের কাঙ্ক্ষিত।’ এই কথাগুলো আমাকে ও বারবার বলত। প্রতিবার যখন কথাগুলো শুনতাম, প্রতিবার ফিরে ফিরে এগুলোর অর্থ সম্পর্কে আমার বোধ গাঢ়তর হত।”
এআইকে ক্রমশ মানবেতর থেকে মানবসম ও মানবোত্তর করে তৈরি করছে আজ মানুষই। তাই, এ গল্প নতুন নয় আর। কল্পনার এই বিশ্ব প্রায় আমাদের কাছাকাছিই এসে পড়েছে এখন। নিঃসন্দেহে আমরা সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে আছি।
………………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………..
মার্কিন সাই-ফাই লেখক, কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের প্রতিভূ অক্টাভিয়া বাটলার একবার বলেছিলেন:
‘I was attracted to science fiction because it was so wide open. I was able to do anything and there were no walls to hem you in and there was no human condition that you were stopped from examining.’
আমাদের সবার কথা এইই। নারীর কলমে কল্পবিজ্ঞানের কথা, অনুচ্চারের ও অদৃশ্যতার ঘেরাটোপের কথা, ভাবনায় নারীর নিজস্ব পহেচান নির্মাণের কথা, আপাতত এখানেই ইতি।
(সমাপ্ত)
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৩। যেখানে যন্ত্রমানবীর মন আছে, মন খারাপও আছে
পর্ব ২২। ইরানের এই মেয়ে নিজের দেশ নিয়েও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি তাঁর কল্পবিজ্ঞানে
পর্ব ২১। সারা শহর যখন এক মহানিষ্ক্রমণের দরজায়, তথ্য রাখার দায়িত্ব কে নেবে?
পর্ব ২০। বাড়িকেই জামার মতো পরেছে মানুষ
পর্ব ১৯। আলো-অন্ধকারে হেঁটে যে কল্পবিজ্ঞান বলতে চেয়েছে দলিত কাহিনি
পর্ব ১৮। পৃথিবীর শেষ লড়াই পানীয় জলের দখলের জন্য
পর্ব ১৭। একটি সন্তান অজৈবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীতে
পর্ব ১৬। অজানা জগৎ ঘিরে যে মুগ্ধতা, বন্দনা সিংয়ের কল্পবিজ্ঞানের সেটাই চালিকাশক্তি
পর্ব ১৫। মানুষ খুন না করেও যুদ্ধে জেতা সম্ভব, দেখিয়েছে এলিজাবেথ বেয়ারের কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই