এই অনুষ্ঠানটার পরে দেখলাম ওদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজটা বদলে যেতে শুরু করল। ওরা অনেক কনফিডেন্ট, একটা তৃপ্তি ওদের ঘিরে ধরেছিল। আমি তখন ভাবতাম, এই বদলটার কারণ কী? ওই একটা সন্ধ্যা!
৩.
গৌরপ্রাঙ্গণে ওই হাজার হাজার লোক এক একটা দৃশ্যের পর ‘সাধু’, ‘সাধু’ বলে উঠছে। স্টেজ থেকে ওই আওয়াজটা অবিশ্বাস্য লাগছিল, ভাবছিলাম এটা কী বাস্তবে ঘটছে! সাতানব্বইতম বাল্মিকী প্রতিভা হয়ে গেল। ইচ্ছে আছে একশোতম পারফরম্যান্সটা বড় করে করার। কিন্তু এতগুলোর মধ্যে কিন্তু সকলের মনে আছে প্রথম দিনেরটা। কী আশ্চর্য!
ওরা কিন্তু খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ‘মা’ ডাকাটা শুরু করেছিল। প্রথম এক-দু’দিন কানে লেগেছিল এই ডাকটা। হঠাৎ কেন ডাকছে আমাকে মা বলে? আমি কি তেমন কিছু করেছি ওদের জন্য? একবার একটি ছেলে নাচতে নাচতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। টিলের চালের তলায় মে মাসের গরমে রিহার্সাল করা কি কথার কথা নাকি? আমি মাটিতে বসে, ওর মাথাটা কোলে নিয়ে নিই। অন্যদের বলি জল আনতে। ওরা জল এনে ওকে জলটা খাওয়াতে চাইল। আমি বারণ করে উঠি। ওই অবস্থায় তো জল খাওয়ানো যায় না। আমি জলটা হাতে নিয়ে ছেলেটির মাথায়, মুখে দিতে থাকলাম। ধীরে ধীরে ও জ্ঞান ফিরে পেল। চোখ খুলেছে সবে। তখন আমি ওকে একটু একটু করে জল খাওয়াতে থাকি। ও আমার দিকে দেখি তাকিয়ে আছে। খুব অদ্ভুত ওই চেয়ে থাকাটা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, একটু ভাল লাগছে? তখনও তাকিয়ে আছে, কোনও উত্তর দিচ্ছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবে আমাকে? কিন্তু কিছুই বলল না। উঠে বসল ধীরে ধীরে। বললাম, পাশে বসে নাচটা দেখো আজ। আজ আর তোমাকে প্র্যাকটিস করতে হবে না। দু’দিন পর আবার গেছি ওখানে। ছেলেটি এগিয়ে এসে আমাকে একটা কাগজ দিল। তাতে লিখে দিয়েছে, মায়ের কথা আমার খুব একটা মনে পড়ে না আমার। অনেক দিন আগে এসেছি এখানে। কিন্তু এখন মায়ের কথা ভাবলে তোমার মুখটা দেখতে পাই।
আমি পরে বুঝেছি কেন। আসলে ওদের গায়ে কেউ হাত দেয় না। কেউ ওদের কাছে আসে না। ভয় পায়। ওই ছোট্ট মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়াতেই ওর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল। পরে যখন আমি ওদের নিয়ে অর্গানাইজেশন করি, ওদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য, তার নামি রাখি ‘টাচ ওয়ার্ড’। কারণ আমার মনে হয়, সবটাই হয়েছিল ওই ছোট্ট স্পর্শের জন্য। ওই স্পর্শটাই ছিল মোড় ঘোরানো ঘটনা।
আমি সবসময় জানতাম ‘টাচ ইজ হিলিং’, তারপর কোভিড এল। সবটা বদলে গেল তখন থেকে। তবুও আমি বিশ্বাস করি স্পর্শের মাধ্যমেই বেঁচে ওঠা যায়। যখন ওরা প্রথম অনুষ্ঠানটা করে ফিরে এল, আমিও ওদের সঙ্গে ফিরেছিলাম। ওদের ছাড়তে গেছিলাম। কিন্তু ওটাই শেষ। আমি শুধু ওদের বের করে আনতে যাই, ফেরাতে যাই না। প্রথমবার ওদের ফেরাতে গিয়ে আমি একটা সাংঘাতিক কষ্ট পেয়েছিলাম। এত আনন্দের পর ওদের ফিরে যেতে হবে ওখানে?
এই অনুষ্ঠানটার পরে দেখলাম ওদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজটা বদলে যেতে শুরু করল। ওরা অনেক কনফিডেন্ট, একটা তৃপ্তি ওদের ঘিরে ধরেছিল। আমি তখন ভাবতাম, এই বদলটার কারণ কী? ওই একটা সন্ধ্যা! সমাজের কাছে ওরা ব্রাত্য, ঘৃণ্য। এই প্রথমবার বাইরের মানুষ, সমাজ ওদের জন্য হাততালি দিল। এটা ওদের মধ্যে বড় একটা পরিবর্তনের সূচনা ঘটাল। ওরা দোষ করেছে, তার জন্য শাস্তি পাচ্ছে, এই শাস্তি তো ওদের পাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু ভাল কিছু করলে যে বাহবাও পাওয়া যায়, এই বোধটা ওদের ছিল না। এই প্রথমবার ওরা শিল্পীর সম্মান পেল। আমরা কিন্তু সবাই আসলে ভাল হয়েই থাকতে চাই, আমরা কেউ চাই না আসলে খারাপ হতে, খারাপ করতে। কোন পরিস্থিতি আমাদের খারাপ হতে বাধ্য করে, সেটা কি কেউ খতিয়ে দেখে? এই প্রশ্নটা কি কেউ করে? আমরা ওই পরিস্থিতিতে পড়লে কী করতাম? ওরা কিন্তু সেদিনের পর এটাই ভেবেছিল। এমন কিছু করব এবার থেকে, যাতে সবাই আমাদের ভালবাসার সুযোগ পায়। ভালবাসা হয়তো চট করে আসবে না। কিন্তু সেদিকের পথে হাঁটা তো যায়।