ঠাকুরদালানের কেনাকাটার মধ্যে শুধু আত্মীয়-প্রিয়জন থাকেন না। থাকেন, স্বয়ং সপরিবার সবাহন দেবী দুর্গা। পুজোয় নিজের ক-টা জামা হল, জীবনে খেয়াল করিনি। খেয়াল রেখেছি, প্রতিমার জন্য কেনাকাটা সম্পূর্ণ হল কি-না। নিজেদের জন্য যে কেনাকাটা হয় না, তা বলছি না; তবে সবার উপরে শপিং ফর দুর্গা।
পুজো আসছে আসছে ভাবটা বাঙালির ভারি প্রিয়। শরতের এই প্রিয়বরেষু রোদ্দুরের গায়েই যেন একরকমের আদুরে ভাব। মনে পড়ে যায় প্রিয়জনের কথা। আসলে সময়টাই ভিতরই তো কাছের মানুষের কাছে ফেরার টান। সেই কৈলাশ থেকে মা দুর্গা সপরিবারে আসছেন মর্তে। আর মর্তের মানুষ ফিরছে তার মনের মানুষের কাছে। হয়তো বছরভর দেখা হয়নি, কথাও হয়নি সেভাবে, দু-একটা হোয়াটসঅ্যাপে টিকে আছে মাত্র যোগাযোগের সুতো। তবু এই পুজো-পুজো রোদ বাঙালির অন্তরমহলে খেলে গেলেই মনে পড়ে যায়, আহা, ওর জন্য একটা নতুন পোশাক কেন হল না তো এখনও! পুজো আসার আগে যত রকমের প্রস্তুতি বাঙালির গেরস্থালিতে, তার মধ্যে সবথেকে বড় হল এই কেনাকাটা। ঠিক কোন সূত্রে যে দুর্গাপুজোর সঙ্গে এই কেনাকাটা যোগ হয়েছে, তার কূল পাই না। অনুমানে বুঝি, বছরকার মালিন্যলাঞ্ছিত জীবনে এই যে দিন পাঁচেকের অলীক আলো নেমে আসে, সেই সময়টুকুকে সাধ্যমতো আয়োজনে সাজিয়ে তুলতে চায় বাঙালি। হয়তো সেই কারণেই নতুন পোশাক কেনা, পরে তার সঙ্গে যোগ হয়ে গিয়েছে দুর্গাপুজোকেন্দ্রিক বাজার-অর্থনীতিও। বেশি তত্ত্বকথায় গিয়ে কাজ নেই। এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায়, শাস্ত্রে উল্লেখ থাক বা না-থাক, পুজোয় কেনাকাটা বাঙালির কাছে রিচুয়াল-ই।
অতএব বাঙালি হইহই করে বেরিয়ে পড়ে পুজোর কেনাকাটায়। ঠিক এই সময়টায় রাস্তায় রাস্তায় ভিড়। ধর্মতলা-গড়িয়াহাট-হাতিবাগান জমজমাট। ফলে খানিক জ্যামজমাটও। তবে তাতে কী! বৃষ্টিতে-ঘামে নাজেহাল হয়েও হাসিমুখে মানুষ কেনাকাটায় বেরিয়েছেন। বচ্ছরকার পুজো বলে কথা! মেট্রো-বাস-ট্রেনে ঢাউস ঢাউস ব্যাগগুলো যেন প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছে, পুজো এসে গিয়েছে। এদিকে ঠাকুরদালানের পাঠক মাত্রই জানেন, এখানে সবই তো অন্যরকম হয়। তাহলে এতক্ষণ ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার কারণখানা কী? তা হল, ঠাকুরদালানের কেনাকাটার মধ্যে শুধু আত্মীয়-প্রিয়জন থাকেন না। থাকেন, স্বয়ং সপরিবার সবাহন দেবী দুর্গা। পুজোয় নিজের ক-টা জামা হল, জীবনে খেয়াল করিনি। খেয়াল রেখেছি, প্রতিমার জন্য কেনাকাটা সম্পূর্ণ হল কি-না। নিজেদের জন্য যে কেনাকাটা হয় না, তা বলছি না; তবে সবার উপরে শপিং ফর দুর্গা।
তা সে কেনাকাটার বহরও কম কিছু নয়। তারও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। মা দুর্গা অর্থাৎ মূল দেবীপ্রতিমার জন্য কেনা হয় লাল বেনারসী। লক্ষ্মী-সরস্বতীও পুজোর পাঁচদিন বেনারসীতেই সাজেন। এদিকে কার্তিক, গণেশের জন্য আবার বেছে বেছে কিনতে হয় সিল্কের জোড়। যদি ভাবেন, এই তো শপিং শেষ তবে ভুল হয়ে গেল। মহিষাসুর বেচারা কী করবে? হাজার হলেও এই পুজোয় তো তাঁরও মস্ত ভূমিকা আছে। অতএব মহিষাসুরের জন্যও রইল সিল্কের জোড়। নাহ্ এখনও শেষ হল না। গণেশের পাশে যে ঘোমটা পরা কলা-বউটি থাকেন, তাঁর জন্যও তো পোশাক বাছতে হয়। অতএব তাঁর জন্য কেনা হয় কাতান বেনারসী। এ ছাড়া পুজোর সময় নানা কাজে শাড়ি ও ধুতি লাগে। সব মিলিয়ে প্রায় গোটা ষাটেক শাড়ি-ধুতিও এই সঙ্গে কিনে নিতে হয়। এই গেল পোশাকের সাতকাহন। এবার আসা যাক গয়নার কথায়। আমাদের বাড়ির প্রতিমা ডাকের সাজে সাজে না। তাঁর নিজস্ব গয়নাগাটি আছে। তা-ই দিয়েই আমরা মাকে সাজিয়ে তুলি। আমরা বাড়ির সকলে মিলেই মাকে আর তাঁর সন্তানসন্ততিদের সাজাই যতনে।
এই-ই হল আমার শপিং। সারা শহর যখন হাল ফ্যাশনে দিকে চোখ রেখে মগ্ন, আমি তখন ভাবি কোন বেনারসীতে মাকে চমৎকার মানাবে। সত্যি বলতে, দুর্গা আমার কাছে কখনই দূরের কেউ নন। তিনি তো আমাদের বাড়িরই একজন। দূরে থাকেন এই যা। তারপর শরতের সোনা রোদে বাপের বাড়ি ফেরার টান আকুল হলে তিনি ফিরে আসেন আমার ঠাকুরদালানে। আমি তাঁকে সাজিয়ে তুলি। রবি ঠাকুরের কথা ধার করেই বলি, আমরা তো চিরকাল ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’। সেই প্রিয়জনের জন্য এই শারদবেলায় শপিং করব না, তা-ই আবার হয় নাকি!