অবন ঠাকুরের সেই বিখ্যাত চিত্রকলার কথা নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে। শিশু গণেশকে নিয়ে খেলা করছেন পার্বতী। পটচিত্রেও গণেশজননীর রূপ সেরকমই। কখনও আবার পার্বতীর পাশে সেখানে দেখা যায় শিব ঠাকুরকেও। আমাদের বাংলার পুতুলশিল্পে, বিশেষত মজিলপুরের পুতুলের দিকে তাকালেও দেখব, মায়ের কোলে খেলা করছেন শিশু গণেশ। অর্থাৎ, গণেশজননী নিয়ে বাঙালির সম্মিলিত ধারণায় যে ছবি ভেসে ওঠে, তাতে মায়ের কোলে এক শিশুর খেলা করার চিত্ররূপই প্রধান।
‘ওমা! কলা বউয়ের শাড়িটা কী সুন্দর রে! তোর বউকেও এরকম একটা শাড়ি পরিয়ে তোর পাশে বসাব।’– বক্তা আমার এক মাসি। শুনে আমি দু’-মুহূর্ত থমকে গেলাম। মনে মনে ভাবি, উত্তরে বলবটা কী! কলা বউ না বলে যদি আলিয়া-দীপিকার কথা বলতেন, তাহলেও নয় কথা ছিল। তা বলে কলা বউ! না, কলা বউকে আমার পাশে বসানোর প্রস্তাবে আপত্তি নেই। তবে কথাটা হল, আমাকে গণেশ ভেবে এই প্রসঙ্গের অবতারণা, নাকি নেহাতই না জেনে বলে ফেলা একটা কথা! ঘোমটা মাথার ‘বউ’টি তো আসলে গণেশের স্ত্রী নন, তিনি গণেশজননী।
ঠাকুরদালানে গণেশের পাশে মাথায় ঘোমটা দিয়ে তন্বী লাজুক রমণীর মতোই পাঁচটা দিন তিনি থাকেন। অতএব দু’-এ দু’-এ চার করতে অসুবিধা হয়নি। আমরা, বাঙালিরা তাঁকে অবলীলায় গণেশের স্ত্রী সাব্যস্ত করেছি। এখন যদি বলি, তিনি গণেশের মা, অনেকেই হয়তো যারপরনাই অবাক হবেন। কেননা তাহলে আমাদের মনে একেবারেই অন্যরকম ছবি ভেসে ওঠে। অবন ঠাকুরের সেই বিখ্যাত চিত্রকলার কথা নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে। শিশু গণেশকে নিয়ে খেলা করছেন পার্বতী। পটচিত্রেও গণেশজননীর রূপ সেরকমই। কখনও আবার পার্বতীর পাশে সেখানে দেখা যায় শিব ঠাকুরকেও। আমাদের বাংলার পুতুলশিল্পে, বিশেষত মজিলপুরের পুতুলের দিকে তাকালেও দেখব, মায়ের কোলে খেলা করছেন শিশু গণেশ। অর্থাৎ, গণেশজননী নিয়ে বাঙালির সম্মিলিত ধারণায় যে ছবি ভেসে ওঠে, তাতে মায়ের কোলে এক শিশুর খেলা করার চিত্ররূপই প্রধান। কলা বউয়ের সঙ্গে তার বহুদূর পর্যন্ত কোনও যোগাযোগ নেই।
কিন্তু এই কলা বউ আসলে কী? তা তো আসলে নবপত্রিকা। কলা গাছের নামে বিখ্যাত হলেও আসলে সেখানে যা যা থাকে, তা হল এই–
রম্ভা, কচ্চী, হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্বদাড়িমৌ
অশোকা মানকঞ্চেব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা
সপ্তমীর দিন গঙ্গার ঘাটে গিয়ে মহাস্নান হয় নবপত্রিকার। উদ্ভিদ থেকে তা তখন দেবীর ন’টি রূপের প্রতীক হয়ে ওঠে। যেমন, জয়ন্তীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকী। বেলের অধিষ্ঠাত্রী শিবা। অশোকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা। মানকচু গাছে অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুণ্ডা। আর ধানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মী। এই যে শস্যকে পূজা করা হচ্ছে, এ তো ভারতীয় সনাতন আরাধনারই রীতি। সাকার মূর্তির পূজার বহু আগে থেকেই এই আরাধনার প্রচলন। দুর্গাপুজোর মধ্যে সেই রীতি একাত্ম হয়ে আছে। আসলে আমাদের এই পূজা এবং পূজা পদ্ধতির মধ্যে আমাদের অস্তিত্বের ইতিহাস নিহিত আছে। খেয়াল করে পরত সরিয়ে যদি দেখা যায় তো দেখব, তা দুরূহ-দুর্বোধ্য জটিল কিছু নয়। মানুষের আত্মিক ও সার্বিক উন্নতির জন্য যুগে যুগে যে মহৎ ধারণা এসেছে, তাই-ই নানা রূপে নানা প্রতীকে বিধৃত হয়ে আছে এইসব রীতি-নীতির মধ্যে। আমরা যদি তা অবজ্ঞাভরে পালন না করি, তাহলে প্রকৃত প্রস্তাবে নিজেদের অতীতকেই অস্বীকার করি। আর স্মৃতিহীন জাতির যে কী বিপদ, তা আর নতুন করে বলে দেওয়ার কিছু নেই। যাই হোক, আবার প্রসঙ্গে ফিরি। কলা বউ তাহলে স্রেফ ঘোমটা মাথায় কলাগাছ নয়। তা ৯টি উদ্ভিদ, এবং যা অধিবাস শেষে দেবী দুর্গার প্রতীক হয়ে ওঠে। আধুনিকতার সঙ্গে প্রাচীন শস্যপূজা বা উদ্ভিদ পূজার রীতি এভাবেই আমরা উদযাপন করি। আর যিনি স্বয়ং দুর্গা, তিনি গণেশের বউ হবেন কী করে! তিনিই তো গণেশজননী। আমাদের চোখের সামনেই এ ছবি আছে, অথচ গণেশজননীর ধারণার সঙ্গে আমরা তা মিলিয়ে নিতে পারি না।
এখন বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো শিল্পের উদযাপন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা মন্দ কিছু নয়, বরং জরুরি। তবে সেই সঙ্গে আরও জরুরি যা, তা হল পূজার পরতে পরতে মিশে থাকা সংস্কৃতির এই সূত্রগুলিকে চিনে নেওয়া। মানুষ এখন সাড়ম্বরে পুজো করে, কোটি অর্থ ব্যয়ে ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট পুজো আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আর তার দরুনই বোধহয় ক্রমশ অন্তরালে চলে যায় সত্যিকার পুজো। বাঙালি কি আজ জানে, সন্ধিপুজোয় দুর্গা নয়, আরাধনা হয় চামুণ্ডার, আর সেখানে নৈবেদ্য চালের নয়, হয় চিনির? বোধহয় জানে না।
এই হচ্ছে ঠাকুরদালান। প্রায় নিরুচ্চারেই এসব শিখিয়ে দেয় সে। ঠাকুরদালানের প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা সেই পুজোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠি।