স্বাধীনতা আন্দোলনের গোড়ার দিনগুলিতে মিলিটারির বিরুদ্ধে রাস্তার শিশু-কিশোরদের লড়াইয়ের শহুরে ময়দানেও সেই এক বুলেটের বিরুদ্ধে পাথর ছোড়ার গল্প। জেনারেল ন্যাপলাকে মনে আছে? প্রবল প্রতিপক্ষকে কাবু করেছিল আগে থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে জমিয়ে রাখা পাথর ছুড়ে। ওই সময়কার বাংলা বাজার, তাঁতি বাজার, ভিক্টোরিয়া পার্কের ছবি দেখে মনে হয় গোটা শহরটাই ন্যাপলার যুদ্ধক্ষেত্র, সর্বত্র ছোড়ার জন্য রেডি পাথরের স্টক।
১০.
ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতেদের ঢেলা মারার খোয়াইশ নিয়ে শৈশবের মাথাব্যথা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ওই কয়েক ঘণ্টা খামোকা ভয় পেলে যে চলত না, তার প্রধান কারণ, গোটা দুপুরটাই ছিল দাপিয়ে বদমায়েশির সময়। কান মুলে গাট্টা মারার লোকজন বেশিরভাগই নিদ্রাভিভূত, ইয়ার-দোস্তদের প্রত্যেকেরই একপেট ভাত জুটেছে ডাল, ঘ্যাঁট, চচ্চড়ি, মাছ জাতীয় কোনও না কোনও ব্যাঞ্জন-সহ, এবং সবচেয়ে যেটা জরুরি বিষয়– যদ্দুর দু’চোখ যায়, একটানা ঘাসবন, শালের জঙ্গল আর ঢেউ-খেলানো চা বাগিচা যে পরবরদিগার কেবল আমাদের দৌরাত্তির জন্যই গড়েছেন, এ বিষয়ে কারও মনেই কোনও প্রকার সন্দেহ ছিল না। যারা ফাঁক পেলেই খড়ম হাতে পিটতে ছুটত, তারা তো প্রকাশ্যেই দিনদুনিয়ার মালিকের এহেন ভীমরতি সম্পর্কে কেয়ামতের দিনে কী হবে সেসবের পরোয়া ফুৎকারে উড়িয়ে, যা নয় তাই বলে বেরিয়েছে! অতএব, তাদেরও যে শৈশবের শিষ্টাচার নিয়ে বেজায় মাথাব্যথা ছিল, এমনটা– ইন রেট্রোস্পেক্ট– বলতে পারছিনে। অতএব মোবাইল, টেলিভিশন, শপিং মল এবং ভিডিওগেম-হীন পৃথিবীতে আহ্লাদে ডগমগ হয়ে ডিগবাজি খেয়ে বেড়ানোর জন্য আর বিশেষ কিছুর প্রয়োজন ছিল না।
ছিলও না আর কিছু, কেবল ভটচাজ বাড়ির বইয়ের আলমারি ছাড়া। আর সেখান থেকে টেনে বের করা একটি ঝকঝকে পাতাওলা বিদেশি ম্যাগাজিনে প্রথম দেখি লায়লা খালেদের, আমার এক তুর্কি দোস্তের উচ্চারণে ‘লাইলা খালেদি’, ছবি। বন্দুক হাতে বাপের সঙ্গে লেবাননের রাস্তায় বসে সোজা চেয়ে আছে আমার দিকে। নামটা ভুলে গেছিলাম, তাকিয়ে থাকাটা চোখে ভেসে ওঠে এখনও, মাঝে মাঝেই। কৈশোরের পর্নোগ্রাফি, ওই আলমারির ম্যাগাজিনের সম্ভারেই খুঁজে পাওয়া ল্যাংটো মহিলাদের ছবি, হালে নারী স্বাধীনতার পরাকাষ্ঠা সানি লিওনির দেহসৌষ্ঠব ইত্যাদি সব জড়িয়েমড়িয়ে একাকার হয়ে গেছে বিশ্বায়ন নামক বিশ্বরূপ প্রদর্শনের আখ পেষাইয়ের কলে পড়ে। কেবল লায়লা খালেদের ঝকঝকে সাফ চোখদুটো পরিষ্কার সংকল্পে নিবিষ্ট জীবনের ছবি এঁকে দিয়ে যায়। পিছনে সফট ফোকাসে সরু রাস্তা। কফিখানার বাইরে রেডিও পারিতে মারিয়া কালাস বাজছে উচ্চৈস্বরে। হুঁকো চলছে দেদার। মুদি দোকানে কুর্গি রমণী দেশে ফিরে যাওয়ার আগে সওদায় ব্যস্ত। পল বাওয়েলস এককোণে বসে জেরুজালেম, জেরিকো ঘুরে আসার মতলব আঁটছেন। হঠাৎ একদল কিশোর মসজিদের দেওয়াল ফুঁড়ে বাঁক নিল– হাতে তাদের গুলতি আর আমাদের দেশে পশ্চিমা চাষিরা যেমন স্লিং দিয়ে অব্যর্থ নিশানায় অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করে পাখি থেকে বুনো শুয়োর, এমনকী, ছোটখাটো চিতাবাঘ অবধি সব তাড়ায়, তেমনই পাথর ছোড়ার রশি, মাঝখানে একটুকরো কাপড় বাড়ির মহিলারা পরম যত্নে সেলাই করে দিয়েছে। প্যালেস্তাইন!
ঢাকা। স্বাধীনতা আন্দোলনের গোড়ার দিনগুলিতে মিলিটারির বিরুদ্ধে রাস্তার শিশু-কিশোরদের লড়াইয়ের শহুরে ময়দানেও সেই এক বুলেটের বিরুদ্ধে পাথর ছোড়ার গল্প। জেনারেল ন্যাপলাকে মনে আছে? প্রবল প্রতিপক্ষকে কাবু করেছিল আগে থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে জমিয়ে রাখা পাথর ছুড়ে। ওই সময়কার বাংলা বাজার, তাঁতি বাজার, ভিক্টোরিয়া পার্কের ছবি দেখে মনে হয় গোটা শহরটাই ন্যাপলার যুদ্ধক্ষেত্র, সর্বত্র ছোড়ার জন্য রেডি পাথরের স্টক। স্বাধীনতার এক দশক পার না হতেই বাংলাদেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যাটি তিন-চারগুণ বৃদ্ধি পেল এবং জামাত-এ ইসলামের তত্ত্বাবধানে মুসল্লিরা প্রকাশ্য দিবালোকে একাধিকবার মহিলাদের নগ্ন করে বেত মারা ছাড়াও পাথর ছুড়ে হত্যার নিদান দেয়। হাতবদলি পাথর, টার্গেট, এবং পিচ্চিদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আখ্যান। সে ঐতিহ্য সমানে চলিতেছে, এবং এ বছর এপ্রিল মাসে এক হুজুর-সহ চারজন গ্রামীণ মাতব্বরকে পুলিশ এক মহিলাকে বিরাশি বার বেত্রাঘাত এবং ৮০টি পাথর ছোড়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করে। যে জাতি বাংলা ভাষা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জোয়াল বর্জনের জন্য লড়েছিল, তারা আজ থ্রি-কোয়ার্টার পায়জামা আর উর্দুর অনুকরণে কিম্ভূত বাংলা আউড়িয়ে তালিবানি শাসনে মুক্তির উপায় খুঁজছে মহিলাদের হিজাব নকাবে ঢেকে– কিছু অশিক্ষিত প্রতিক্রিয়াশীল সেটাকেও স্বাধীনতার নামে চালানোর চেষ্টা করছে এমন একটি দেশে, যেখানে বেশ কয়েক কোটি মহিলা কাপড়ের অভাবে দিনের বেলায় খোঁদোলোর বাইরে পা রাখতে পারে না। দক্ষিণ ভারতে নিম্নবর্ণের মহিলাদের স্তন ঢাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল বামুনরা, অন্যদিকে সৌদি আরবে মহিলাদের গোড়ালি দেখা গেলে চাবুক, বেত, পাথর ছুড়ে হত্যা। কাবুলে এই নিপীড়নের পিছনে আসল ক্রিমিনালটি অবশ্য কারজাই– মশাইটি চুপিচুপি পার্লামেন্টে মহিলাদের আসন সংখ্যা কমায় এবং পাথর ছুড়ে হত্যাকে আইন হিসেবে বলবৎ করার প্রক্রিয়াটি শুরু করে। মার্কিন সমর্থন ছাড়া এহেন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবনাও অসম্ভব ছিল। তবে আজকাল অনেকেই ঐতিহ্যের নামে এমনকী, সতীদাহকেও ফিরিয়ে আনতে চাইছে।
সেটা বড় কথা নয়। দেখলাম প্যালেস্তাইনের রাস্তায় দলবেঁধে লায়েলারা নেমে পড়েছে আরাফতদের সঙ্গে। ১০-১২ হাত দূরে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেকে একটানা বুলেট বৃষ্টির সামনে একটু আড়াল পেল কি পেল না তাই সই, নিচু হয়ে পাথর কুড়িয়েই ছুড়ছে হানাদারদের তাক করে। অস্ত্রের অসম বণ্টন তো কী হয়েছে, একেবারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই! আজকাল কারা যেন আরবান নকশাল না কীসব বলে মোমবাতি হাতে– মোমবাতি আর পাথরের তফাতটা এই লড়াই থেকে পরিষ্কার বোঝা গেছে।
আসলে বিশ্বজুড়ে একটা বড় যুদ্ধ দানা বেঁধে উঠেছে কিছুকাল হল– যুদ্ধক্ষেত্রগুলো রয়েছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। অর্থাৎ দিল্লির রাস্তায় শিখরা পাথর ছুড়ছিল মাত্র কিছুদিন আগে হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে গেরুয়া হাফপ্যান্ট শেয়ার করে। সে কী পেয়ার-পিরিতি রে ভাই! সবাই সিধুর ‘একটা জোক্স’ শুনে হাসছে! দিল তো ফট করে নিজ্জরটাকে মেরে? আর হাসবি দাঁত বের করে? রামমন্দির গড়ার সব ইট ভেঙে আধলা বানিয়ে রেখেছিল ঠিক সময়ে ছুড়বে বলে, তোরা ধরতে পারিসনি! কিছু ‘মাইল প্রতি পনেরো কোটি’-র রাস্তা বানানোর কাজে লাগিয়েছে, কিছু সিংঘলরা মেরে দিয়েছে মানবসভ্যতার গোড়ার দিকে। বহু স্তরে সমান কার্যকর ‘মারা’ শব্দের গূঢ়ার্থ বাঙালিকে শেখাতে হয়নি। কিছু লোক রেডি, তারা ইজরায়েলি মিলিটারিকে ‘কমান্ডো’ এবং প্যালেস্তাইনের মুক্তিযোদ্ধাদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে দেগে পারিতোষিকের অপেক্ষায় ঠোঁট ফাঁক করে ঊর্ধ্বমুখে বসে আছে– নিম্নে উতলা ধরণিতল। ক্রৌঞ্চমাতা বোমাবিধ্বস্ত হাসপাতালে শিশুদের মৃতদেহ নিয়ে কামড়াকামড়ি, ল্যাং মারামারি, ভাগ-বাটোয়ারা সাঙ্গ হলে বিগ ব্রাদারদের ভুক্তাবশেষ খুঁটে বাড়ি ফিরবে। তারপর মাঞ্চোভাত।