‘বাঙালির ভয়’ নামক ধান ভানতে শিবের গীত, কারণ ক্ষীণতনু জাতির মনে যে একটি ওইরকমই ডেভিড জন্ম নিচ্ছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এই জল-হাওয়ায় ভার্টিকালি চ্যালেঞ্জড পাঁচ-ফুটিয়াদের বাইশ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে ‘এ মাহ ভাদর, ভরা বাদর’ ইত্যাদি আওড়াতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হওয়ার কথা নয়– হয়ওনি কোনওকালে। বচ্চনকে আড়ালে লম্বু বললেও, ‘আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে’ ইত্যাদি গর্ব করা একসময় স্বাভাবিক ছিল।
১১.
গত কিস্তিতে উল্লেখ করেছিলাম, দড়ি দিয়ে পাথর ছোড়ার গ্রামীণ অস্ত্র হাতে গোটা পশ্চিম এশিয়া কেমন তোপ-কামানের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে লড়াই পুরোদস্তুর জমিয়ে দিয়েছে। বই ঘেঁটে দেখি, মারামারি বাঁধলে টক্কর নিতে খাটোখোটোরাই বরাবর প্রথম সারিতে হাজির থাকে। সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন না, সেই বিখ্যাত মাস্তানের গল্প– যার হিম্মতের সামনে গোটা কাবুল মাথা ঝুঁকিয়েছিল! অতএব লড়াইটা বোধহয় সবসময়ই ডেভিড আর গোলিয়াথের মধ্যে। খটকা বাঁধল অন্য কারণে। মুসেও-এ-গ্য়ালেরিয়া বর্হেস-এ জিয়ান লোরেনজো বারনিনি-র ‘ডেভিড’ (১৬২৪) দেখে মনে হল, এই বীরপুঙ্গবের দেহসৌষ্ঠবের সঙ্গে রিয়ালিটির বিস্তর ফারাক। অবিশ্যি আর্ট আর রিয়ালিটির ফারাক যদি নাই থাকে, তাহলে খামোখা অমন ঝকমারি সয়ে পাথর কেটে মূর্তি বানিয়ে মিউজিয়ামে রাখার মেহন্নত সইতে যাবেই বা কেন? তাও, আমাদের ভয়গুলো যেহেতু সব চারপাশ ঘেঁটে কুড়িয়ে-কাঁচিয়েই তৈরি, তাই গরিবের ছেলে ডেভিডের মাঠেঘাটে খেটে নির্মেদ চেহারা নিয়ে আপত্তি না থাকলেও, অমন তেলতাগড়া শালপ্রাংশু-সম আকৃতি গোড়ায় আশ্চর্যজনক ঠেকেছিল। গল্পের সার কথা তো এ-ও বটে যে, গোলিয়াথের বপুটির সামনে– ফের একবার আলী সায়েবের স্মরণাপন্ন হই– ডেভিডের তনুটি অকিঞ্চিৎকর ঠেকার কথা, যেখানে খুশি রাখলেই হত এবং জাদুঘর তৈরির আদপে কোনও দরকারই ছিল না।
পরে মনে হল গোলমালটা আমার মগজে। পাঁচ-ছশো বছর পিছিয়ে যাওয়ার দরকার নেই, সে যুগের সাধারণ মানুষের রোজকার খাওয়াদাওয়া এবং নিউট্রিশন নিয়েও গবেষণা নেহাতই অপ্রয়োজনীয়। বেরনিনির ডেভিড আমরা যা হতে চাই, সেই আকাঙ্ক্ষাটির পাথর খোদাই চিত্র– এবং এটিই সহজ সরল, বহু-কথিত সারসত্য।
‘বাঙালির ভয়’ নামক ধান ভানতে শিবের গীত, কারণ ক্ষীণতনু জাতির মনে যে একটি ওইরকমই ডেভিড জন্ম নিচ্ছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এই জল-হাওয়ায় ভার্টিকালি চ্যালেঞ্জড পাঁচ-ফুটিয়াদের বাইশ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে ‘এ মাহ ভাদর, ভরা বাদর’ ইত্যাদি আওড়াতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হওয়ার কথা নয়– হয়ওনি কোনওকালে। বচ্চনকে আড়ালে লম্বু বললেও, ‘আমাগো জয়ার বরের ফিগারটা দ্যাখোনের মতো হইসে’ ইত্যাদি গর্ব করা একসময় স্বাভাবিক ছিল– অনেকে অবশ্য ‘আমাগো সইত্যজিতের মতো না’ বলে গোলমাল পাকানোর চেষ্টা চালাত, তবে সে বখেরা ওই আসরেই সীমাবদ্ধ থাকত। ‘কাবলেটাকে’ দেখে বিস্ফারিত নেত্রে শিশুদের ঝোলায় পুরে দূরদেশে পাচারের ভীতিপ্রদর্শনও চার দেওয়ালের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল, এবং তাও হয়তো খানিকটা চলচ্চিত্রে হাস্যরস অবতারণার খাতিরেই। পশ্চিমা সংস্কৃতি বাঙালির জীবনকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করেছে সম্প্রতি, এবং হালে পানি পেতে বেচারা হনুমানের লেজ ধরে দোদুল দুলেও পার পায়নি, ইদানীং করবা চৌথের ফুটো নৌকা, থুরি, ঝাঁঝরি চেপে প্যান ইন্ডিয়ান কালচার নামক বিক্ষুব্ধ দরিয়ায় ভাসতে বাধ্য হয়েছে।
ভয়টা একা হয়ে যাওয়ার। ভারতীয় ডেভিডকে পাথর জোগাবে কে, এই প্রশ্নে রাজনৈতিক মহল বহুকাল দীর্ণ। দক্ষিণপন্থী নেতারা ভেবেছে বহুকাল যাবৎ কংগ্রেসের তাঁবেদার বাণিজ্য গোষ্ঠীগুলোকে কীভাবে বশে আনা যায়, উল্টোদিকের উমেদারগণ পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়া ঠেকাতে পারেনি কোনওভাবেই। হঠাৎ গোলমালের মধ্যে এনআরআইদের আগমন। দেশের দুখ্যে যাদের বুক ফাটার আওয়াজ সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে দিল্লি থেকে বর্মা এমনই হানা দিচ্ছে যে, মশায় কান পাতা দায় হয়েছে! যাঁরা দেশের উন্নতিকল্পে টাকাপয়সা দেন, তাঁরা ঠিক করেছেন মুসলমানরাই দেশের শত্রু। কীভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন তা জিগাবেন না– আমাকে তো নয়ই, তাঁদেরকেও নয়। বেশ কয়েক দশক যাবৎ একটানা প্রচার চালালে কোন ধরনের সমর্থন তৈরি করা যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মিলবে বিজেপির তহবিলে বৈদেশিক মুদ্রার স্রোত খেয়াল করলে। তাও তো সবটা দেখার উপায় নেই! ভাবছেন সবটাই, পশ্চিমা হিন্দি বলয়ের গোমাতা পুজুরিদের দান? আজ্ঞে না। বাঙালি ওই দাতাকর্ণদের কাতারে খুব একটা পিছিয়ে নেই। ‘মচ্ছিখোর’ হিসেবে আমাদের বামুনদের দুচ্ছাই করা হয়, ওদের বাহনের হাতেও গদা– সেই তুলনায় আমাদের কেষ্ট বেশিরভাগ সময়েই বাঁশি বাজিয়ে সেক্স করে বেড়াচ্ছেন, একেবারে যা-তা বললেও অত্যুক্তি হয় না। ওদের ভক্তরা মাটি কুপিয়ে দুধ-ঘি খেয়ে কুস্তির আখড়ায় একে-তাকে আছাড় মারছে, আমরা চিরায়ত দ্বন্দ্বে ‘আমি বনফুল গো’ বলে শুরু করে ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’– আউড়ে থমকেছি। আমাদের যে করে হোক একটা ডেভিড না হলে চলবে?
অতএব গোড়ায় একখানি সফট টার্গেট বা নরম মাটির প্রয়োজন ছিল। গরিব, নিরন্ন, উদ্বাস্তু, শ্রমজীবী মুসলমান ছাড়া আর কাকেই বা চাঁদমারি করা যায়? আসলে তাও না। সমস্ত গরিব মানুষকেই ঠেসে ধরা হল দেওয়ালে। কোথাও মুসলমান, কোথাও দলিত, কোথাও কারখানার শ্রমিক মজুর, কখনও আবার পরিযায়ী মানুষ। সকলেই ফিসফিস করে বলতে শুরু করেছে, ‘হিন্দু জাগরণের দরকার ছিল, কতকাল আর পরে পরে মার খাব?’ খোঁজ নিয়ে দেখুন, যারা এ ধরনের কথা বলছে, তারাই সুবিধাভোগী শ্রেণির মানুষ, তারাই আত্মীয়-পরিজনদের মাঝে বিঘার পর বিঘা ধানজমি আর আম-জাম বাগানের গল্প শোনায়।
লড়াইটা আসলে গরিব-বড়লোকের– সবসময়ই প্রায় তাই। ডেভিড গরিব ছিল, ইদানীং বড়লোকরা টাকার থলে নিয়ে তার বাড়িতে হাজির– জার্সি বদল করাতে পারলে মার দিয়া কেল্লা! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোনও দু’টি বড়লোক দেশের মধ্যে যুদ্ধের নিদর্শন বাজার অর্থনীতি স্থাপন করতে দেয়নি। তবে হ্যাঁ, বহুজাতিক অস্ত্র তৈরির কোম্পানিগুলো নিজেদের মধ্যে টুঁটি টেপাটিপি, আঁচড়া-আঁচড়ি, কামড়াকামড়ি করেছে এন্তার, এবং সেটি ধনতন্ত্রের ভাষায় ‘কম্পিটিশন’। ধনতন্ত্রের বাজার সর্বস্বতাও সুস্থ জীবনবোধের বাণী শোনায় বটে– ওই অযোদ্ধার লোক যোদ্ধা হয়েছে যেমন! সে শোনাগ্গে যাক, তবে কারা শোনায়– এক্ষেত্রে সেটির উল্লেখ জরুরি। নতুন অর্থনীতির বিশ্বেও দুই বড়লোকে লড়াই হবে না। বাঙালি আর ডেভিডকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই জাতীয় রাজনীতির পাল্লা ঝুঁকবে ‘আমাদের’ দিকে। এখন কাঠবেড়ালীর মতো পাথর মুখে করে লন্ডন, নিউ ইয়র্ক থেকে কলকাতা অবধি সেতুবন্ধনের কাজ করে যাও মন দিয়ে। কাঠবেড়ালীও কি স্টোনম্যান? সেই দিক দিয়ে দেখলে প্রস্তর মানবের সংজ্ঞা পাল্টে নিতে হবে। যাঁরা পাথর সাপ্লাই দেন, তাঁরাও স্টোনম্যান। শুধু আদানিরা নয়, খাদানিরাও তালিকাভুক্ত হলেন।