Robbar

শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য– এভাবেই তৈরি হয়েছিল বিরিয়ানি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 23, 2023 6:16 pm
  • Updated:November 23, 2023 6:20 pm  

নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্‌কে যখন কলকাতায় নির্বাসনে পাঠানো হল, কলকাতার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে মেটিয়াবুরুজে এক ‘ছোটা লখনউ’ বানিয়ে ফেলেছিলেন এখানে এসে। দর্জি থেকে নর্তকী– সবাইকে নিয়ে এসেছিলেন, তাই সেই পুরনো বিলাসে আবার গা ভাসালেন। চিড়িয়াখানা থেকে পতং‌বাজি– কিছুই বাকি রইল না সেখানে। রসুইখানা থেকে তাঁর প্রিয় বিরিয়ানির বাস চারদিক আমোদিত করতে লাগল।

পিনাকী ভট্টাচার্য

১৫.
যে খাবারের নামের অর্থ ‘ভেজে নিয়ে রান্না’– ভাজারদুয়ারির ওপাশে তাকে কী করে বেশিদিন রাখা যায়! কিন্তু বিরিয়ানির গাড়ি চলতে শুরু করলে মহাকাব্য না হওয়ার আগে গাড়ি থামবে না। খাজা যেমন কাকিনারায় একরকম, বিহারে অন্যরকম, আবার পুরীতে তার অন্য রূপ– তেমনই বিরিয়ানি হায়দরাবাদে একরকম, পাকিস্তানে আরেক রকম, আবার কলকাতাতে তার অন্য রূপ। তাই স্বাদের গল্পের বদলে সৃষ্টির গপ্প নিয়েই বিরিয়ানির গাড়ি গড়াক। নামটা আদপে ফারসি, সেখান থেকে বোঝা যায় মধ্যপ্রাচ্য থেকে এর যাত্রা শুরু। আরব মুলুকের যাযাবর জাতি মাটিতে গর্ত করে হাজার বছর আগে হাঁড়িতে চাল, মাংস আর মশলা মিশিয়ে যে রান্না করত, সেইটাই নাকি বিরিয়ানি। আর এই যাযাবর জাতির হাত ধরে বিরিয়ানি ছড়িয়ে পড়েছিল সারা মধ্যপ্রাচ্যে। তারপর তৈমুর লং-এর সঙ্গে কাজাখিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে বিরিয়ানির ভারত প্রবেশ। কিন্তু ঝামেলা বাঁধাল ২ খ্রিস্টাব্দে তামিল ভাষায় লেখা ‘উনসুরু’ বলে এক গ্রন্থে পাওয়া গেল এক পদ, যা কিনা সৈন্যদের জন্য তৈরি হত চাল, ঘি, মাংস, হলুদ, ধনে, গোলমরিচ আর তেজপাতা দিয়ে। এর মানে তো বিরিয়ানি-গোত্রীয় খাবারের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ তৈমুর ভারতে আসার হাজার বছরেরও আগে থেকে! তাই বিরিয়ানির গপ্প সাবেক বেঙ্গল প্রভিন্সের দুই শহর– লখনউ আর কলকাতার মধ্যেই রাখা যাক আপাতত।

Double Masala Chicken Dum Biryani Recipe | Homemade chicken Dum Biryani | How to make Chicken Dum Biryani

ঔরংজেবের উত্তরসূরিদের হাতে দিল্লির দাপট যখন অস্তমিত, দিল্লি থেকে মাত্র সাড়ে তিনশো মাইল দূরে আওধের রাজধানী লখনউ তখন দেশের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে তার সংস্কৃতি, রীতি-রেওয়াজ আর বিলাসী জীবন নিয়ে। ১৭৮৪ সালে লখনউয়ের নবাব যখন আসাফ-উদ-উল্লা, আওধে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে এল। সাধারণ মানুষ মরতে শুরু করল অনাহারে, বৈভবে ডুবে থাকা আমাত্যরাও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ল এই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। অনাহারে ক্লিষ্ট গ্রামবাসীরা নবাবের প্রাসাদে হাজির হল সাহায্য প্রার্থনা করতে, অন্যদিকে নবাবের আমাত্যরাও সাহায্যের আর্জি নিয়ে নবাবের কাছে দরবার করল সাধারণের চোখ বাঁচিয়ে নিজেদের সম্মান রক্ষা করে।

নবাব পড়লেন আতান্তরে, কারণ কাঁধে বিস্তর ঋণের বোঝা– ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক কর্জ বাকি। ত্রাণ বিলি করতে গেলে ওয়ারেন হেস্টিংস ছিঁড়ে খাবে তাকে, এমনিতেই তক্কে-তক্কে আছে তার সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। অন্যদিকে দুর্ভিক্ষের প্রকোপে শ্রেণি নির্বিশেষে সবার অবস্থা সঙ্গিন, সবাই নবাবের সাহায্যপ্রার্থী– নবাব হিসেবে তাঁর কর্তব্য দেশবাসীর দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানো। অনেক ভেবে তিনি এক সকালে রাজ্যবাসীদের ডেকে জানালেন যে, তিনি তাদের খাবারের দায়িত্ব নেবেন যদি তারা শ্রমদান করে। শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য– এই হবে শর্ত। প্রজারা একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। নবাব আসাফ-উদ-উল্লা তখন তাদেরকে নিয়োগ করলেন এমন এক ইমারত বানানোর কাজে, যা দেখার জন্যে দূরদূরান্ত থেকে লোকে লখনউ ছুটে আসবে। বিশাল বড় বড় হাঁড়িতে চাল, মাংস, মশলা, ঘি, কন্দ একসঙ্গে নিয়ে কাঠের আগুনে চড়িয়ে দেওয়া হল, আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রজারা এসে খেয়ে যেতে থাকল। কাঠের আঁচ বাড়িয়ে কমিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা দম দিয়ে রান্না হতে থাকল বিরিয়ানি। এই আঁচ আর দম বিরিয়ানির স্বাদ আরও খোলতাই করল। নবাব এবার তাঁর আমাত্যদের গোপনে দায়িত্ব দিলেন গ্রামবাসীরা যা তৈরি করবে, প্রতি চতুর্থ দিনের রাতে এক্কেবারে সেরা অংশটা বাদ দিয়ে বাকিটা ভেঙে দিতে। আর এই কাজের জন্যে তাদের খাদ্য বরাদ্দ হল, যাতে আমাত্যদের কৌলীন্য বজায় থাকে। ২০,০০০ লোক শুরু করল সেই ইমারত বানানো আর বাড়ি ভাঙার কাজ। লখনউয়ের বিখ্যাত বড়া ইমামবাড়ার সৃষ্টি এইভাবেই হয়েছিল।

Wajid Ali Shah - Wikipedia
ওয়াজেদ আলী শাহ

নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্‌কে যখন কলকাতায় নির্বাসনে পাঠানো হল, কলকাতার দক্ষিণ পশ্চিম কোণে মেটিয়াবুরুজে এক ‘ছোটা লখনউ’ বানিয়ে ফেলেছিলেন এখানে এসে। দর্জি থেকে নর্তকী– সবাইকে নিয়ে এসেছিলেন, তাই সেই পুরনো বিলাসে আবার গা ভাসালেন। চিড়িয়াখানা থেকে পতং‌বাজি– কিছুই বাকি রইল না সেখানে। রসুইখানা থেকে তাঁর প্রিয় বিরিয়ানির বাস চারদিক আমোদিত করতে লাগল। নবাব ভুলেছিলেন যে তাঁর বাৎসরিক আয় তখন ১২ লাখে সীমিত আর সেই টাকায় এই এতগুলো লোকের দায়দায়িত্ব নিতে হবে তাঁকে। মনের সুখে একের পর এক প্রাসাদ বানিয়ে শেষে বানালেন ইমামবাড়া– যেমন তাঁর পূর্বপুরুষ আসাফ-উদ-উল্লা বানিয়েছিলেন। ইমামবাড়া সম্পূর্ণ হলে আনন্দে মাতোয়ারা নবাব সব শ্রমিকদের বিরিয়ানি খাওয়াতে গিয়ে দেখেন রাজকোষে পর্যাপ্ত মাংস কেনার মতো টাকা নেই। নবাবের খানসামারা তখন বুদ্ধি করে মাংসের পরিমাণ কমিয়ে পরিবর্তে আলু দিয়েছিল। আলু তখন শুধু নৈনিতাল-দেরাদুন অঞ্চলে হত। পর্তুগিজদের হাত ধরে পশ্চিম ভারতে পৌঁছলেও পূর্ব ভারতে পৌঁছে কৌলীন্য হারায়নি, তাই শ্রমিকরা খুশিতে মাতোয়ারা হয়েছিল। নবাবি বিরিয়ানির সম্মান রক্ষা করা খানসামারা সেদিন জানত না তারা এক ইতিহাস সৃষ্টি করছে। কলকাতা বিরিয়ানি, যা আজও সোনালি রঙের একটা বড় আলুর টুকরো ছাড়া অসম্পূর্ণ।