গোলারুটির দৌড় বাঙালির রান্নাঘর থেকে খাওয়ার থালা অবধি– দেশের বাইরে কেন, বাংলার বাইরে অবধি পৌঁছতে পারল না। এদিকে গোলারুটির দুই ভাই ‘আপ্পাম’ আর ‘ক্রেপ’ নাম নিয়ে দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। ফ্রান্সে তাদের দোসরা ফেব্রুয়ারির ছুটি ‘লা শান্দেলিয়ঁ’-র অপর নাম হল ‘জ্যর দ্য ক্রেপ’– কারণ সেদিন লোকে সারাদিন ধরে প্রচুর ক্রেপ খায়।
কিছুদিন আগে বিলু বলল গ্রহের সাহায্য ছাড়া নাম-প্রতিপত্তি হয় না। উদাহরণ দিল বাংলার এক অভিনেতার আর উত্তর ভারতের এক ক্রিকেটারের– প্রতিভা আর নৈপুণ্য নিয়ে যাঁদের ব্যাপারে কারওর কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁরা এক সীমারেখার মধ্যেই আবদ্ধ থেকে জীবন কাটিয়েছেন। প্রাপ্য সম্মান থেকে সারাজীবন বঞ্চিত থেকে গেলেন, তাঁদের নাম বিশ্বের দরবারে কোনও দিন পৌঁছল না। সেখানেই না থেমে বিলু বলল ‘আর দরকার প্যাকেজিং। দেখেছিস সিনেমায় নামার আগে নায়ক-নায়িকারা নাম বদলে নিত আগে। হরিহর জেঠালাল জরিওয়ালা যদি নিজের নাম না বদলাতেন, ভারতীয় সিনেমা কোনও দিন সঞ্জীব কুমারকে পেত? কেউ সুযোগই দিত না! কলকাতার এসি ট্যাক্সি আর মুম্বইয়ের কুল ক্যাব-এর কথা ভাব!’
আমার মাথায় এল গোলারুটির কথা, যার দুই ভাই ‘আপ্পাম’ আর ‘ক্রেপ’ নাম নিয়ে দুনিয়া কাঁপাচ্ছে। ফ্রান্সে তাদের দোসরা ফেব্রুয়ারির ছুটি ‘লা শান্দেলিয়ঁ’-র অপর নাম হল ‘জ্যর দ্য ক্রেপ’– কারণ সেদিন লোকে সারাদিন ধরে প্রচুর ক্রেপ খায়। বিশ্বাস করে, ডান হাতের মুঠোয় একটা কয়েন রেখে বাঁ হাতে ক্রেপ রান্না করতে করতে ক্রেপটাকে শূন্যে ‘টস’ করলে যদি সেই ‘টস’ করা ক্রেপ আবার চাটুর ওপর এসে পরে, বাকি বছরটা পরিবারের কোনও অভাব থাকবে না। পোড়া ক্রেপ ‘ক্রেপ্ সুজেত’ নাম নিয়ে গল্পের পিঠে চড়ে বিশ্বের সবচেয়ে নামজাদা পদের একটা হয়ে উঠেছে। যেমন, এক ইংরেজ রাজপুত্র এক অন্য দেশের এক মেয়ের প্রেমে পড়লেন। একদিন রাজপুত্র ঠিক করলেন সেই মেয়েটিকে নিয়ে এক নামী রেস্তরাঁয় খেতে যাবেন। রেস্তরাঁয় সাজো-সাজো রব, রাজপুত্র খেতে আসবে বলে কথা! রুপোর পিরিচ, সোনার থালা– সে এক এলাহি ব্যাপার! এক-একজন এক-একটা কাজের দায়িত্ব নিয়েছে– এক অল্পবয়সি বাবুর্চিকে শেষ পাতের মিষ্টি বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হল। রাজপুত্র অন্যান্য পদ খেয়ে যখন শেষ পাতের মিষ্টির অপেক্ষায়, সেই ছোকরা বাবুর্চির একটা ভুলে ক্রেপ আগুনে পুড়ে গেল। নতুন করে আবার ক্রেপ বানানোর সময়ও নেই, তাই সেই ছোকরা ক্রেপটা অল্প চেখে দেখতে গিয়ে চমকে গেল– আগুনের ধরা গন্ধে ক্রেপের স্বাদ তো নষ্ট হয়ইনি, বরঞ্চ আরও খোলতাই হয়েছে। ইষ্টনাম জপতে জপতে সেই ক্রেপটা পরিবেশন করা হল আর রাজকুমার গল্প করতে করতে ক্রেপটা মুখে দিলেন। ধীরে ধীরে পুরো ক্রেপটা তারিয়ে তারিয়ে খেয়ে ওয়েটারকে এই অপূর্ব ক্রেপটার নাম জিজ্ঞেস করলেন। প্রত্যুৎপন্নমতি ওয়েটার উত্তর দিল, ‘ক্রেপ প্রিন্সেস হুজুর!’ বকশিস-স্বরূপ এক রত্ন-খচিত আংটি দিয়ে রাজকুমার অনুরোধ করলেন নামটা বদলে ‘ক্রেপ সুজেত’ রাখতে।
আপ্পাম তো আরও এক কাঠি সরেস– এক্কেবারে দুই-তিন হাজার বছর পিছিয়ে গিয়ে যে জাল বিস্তার করেছে, প্রায় অর্ধেক বিশ্ব সেই জালে বন্দি। মোজেস যখন ফ্যারাওকে ইহুদি ক্রীতদাসদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন, আসন্ন দশটা মহামারী নিয়ে ফ্যারাওকে সাবধান করে দিয়েছিলেন– যেখানে সমস্ত পরিবারের প্রথম পুত্র সন্তানের মৃত্যু হবে। মিশরের ইহুদিদের এই মহামারী থেকে বাঁচার উপায় আর প্রতিষেধক জানিয়ে তার সঙ্গে বাড়িতে যে রুটি বানিয়ে খেতে বলেছিলেন, সেই রুটিই আজকের আপ্পাম। কেরালার খ্রিস্টানরা ‘মন্ডি থার্সডে’-তে (গুড ফ্রাইডে-র আগের দিন) পেষা-আপ্পাম বা ‘ইন্দ্রিয়াপ্পাম’ নামে এক বিশেষ আপ্পাম বানায়, আর তাতে তালপাতা দিয়ে ক্রুশচিহ্ন আঁকে। পরিবারের প্রধান সেই আপ্পাম নারকেল দুধ আর গুড় দিয়ে তৈরি ‘পাল’-এ ডুবিয়ে পরিবারের সবার হাতে তুলে দেন যিশুখ্রিস্টের ‘লাস্ট সাপার’-এর স্মৃতিতে। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মাথার ওপরে যে INRI লেখা থাকে, সেখান থেকে INRI-আপ্পাম আর সেটার অপভ্রংশ এই ইন্দ্রিয়াপ্পাম। কারণ যিশু তাঁর শেষ ভোজের পরে তাঁর শিষ্যদের হাতে এইরকম আপ্পামের মতো একটা রুটি টুকরো করে তাঁর শিষ্যদের হাতে তুলে খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, এই রুটির মধ্যেই তিনি আছেন। তাঁর এই কথার মর্মার্থ বুঝে শিষ্যরা রুটি খেয়ে নিয়েছিলেন আর তাঁর অবর্তমানে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে ব্রতী হয়েছিলেন। তাই যিশুর সাক্ষাৎ শিষ্য সেন্ট টমাসের সঙ্গে তাঁর মুলুকের আচার শুধু ভারতবর্ষে এসে পৌঁছয়নি, বাকি শিষ্যদের হাত ধরে অনেক জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল, তার প্রমাণ এই আপ্পাম লাতিন আমেরিকাতেও গুড ফ্রাইডের আগের দিন ইন্দ্রিয়াপ্পাম খাওয়ার রীতি আছে।
আর সেখানে আমাদের গোলারুটি– যতই সুস্বাদু হোক, যা রবিবার সকালের লুচি-পরোটাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার দৌড় বাঙালির রান্নাঘর থেকে খাওয়ার থালা অবধি– দেশের বাইরে কেন, বাংলার বাইরে অবধি পৌঁছতে পারল না। কারণ তার পিছনে কোনও গল্পের সম্পর্ক নেই, আছে শুধু জিভের আর স্বাদের সম্পর্ক। সেটা বিপণনের আভাবে, না অন্যদের মতো বুধাদিত্য যোগ না হয়ে বিয়োগ হয়ে গিয়েছে, তাই নিয়ে দ্বন্দ্বে আছি।